ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

বায়ান্ন বাজার তিপ্পান্ন গলি

প্রকাশিত: ১০:৪৪, ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২০

বায়ান্ন বাজার তিপ্পান্ন গলি

মনোয়ার হোসেন ॥ নানা কারণে উড়ন্ত ধুলায় আক্রান্ত শহর ঢাকা। দূষণ থেকে বাঁচতে মাস্ক পরে চলতে হয় নগরবাসীকে। কর্মব্যস্ত জীবনের সঙ্গে আছে যানজটের বিড়ম্বনা। তবে স্বপ্নের মেট্রোরেলের মাধ্যমে আগামীতে যাতায়াতের সুবিধার্থে মানুষ স্বাভাবিকভাবেই মেনে নিচ্ছেন এই দুই দুর্ভোগকে। অন্যদিকে ফিটনেসবিহীন যানবাহন কিংবা ইটভাঁটির ধোঁয়ার কারণে ক্রমাগত বাড়ছে বায়ুদূষণের মাত্রা। দখলবাজদের কবল থেকে চারপাশের নদীপথের স্রোতধারা ফিরিয়ে আনতে রাষ্ট্রকে নামতে হয় অভিযানে। আবার কখনো সমন্বয়হীন খোঁড়াখুঁড়ির ঝামেলায় ভুগতে হয় নগরবাসীকে। আছে সুদূর চীনের উহান থেকে সৃষ্ট করোনাভাইরাসের আতঙ্ক। আশার ব্যাপার হচ্ছে এখনও ঢাকা বা বাংলাদেশে এসে সংক্রমণ ঘটাতে পারেনি এই ভাইরাস। এখনও পর্যন্ত কারও শরীরে মেলেনি এই ভাইরাসের অস্তিত্ব। তবে এমন ঝক্কি-ঝামেলার মাঝেও শিল্প-সংস্কৃতির আলোয় প্রায়শই স্নিগ্ধতা পায় প্রাণের ঢাকা। সেই সুবাদে এই শহরের সংস্কৃতিবান মানুষের তীর্থভূমি এখন অমর একুশে গ্রন্থমেলা। সেখানে প্রতিদিনই থাকে পাঠকের ভিড়, চোখে পড়বে বই কিনে প্রিয় লেখকের অটোগ্রাফ নেয়ার দৃশ্য। দেখা মিলবে দর্শনার্থীদের ঘুরে বেড়ানো, খাইদাই আর সেলফিবাজি। স্টল বা প্যাভিলিয়নে প্রকাশনা সংস্থাকে ঘিরে আছে প্রকাশকদের ব্যস্ততার নিত্যচিত্র। সব মিলে সৃজনশীলতার হাতছানিতে ভরপুর এক উৎসব একুশের বইমেলা। এখন চলছে একুশে বইমেলার বিদায়বেলা। আরেক অর্থে ভরা মৌসুম। তাই দেখাদেখির পর্ব পেরিয়ে পাঠকরা খুঁজে নিচ্ছেন পছন্দের বইটি। কারণ, ইতোমধ্যে বের হয়ে গেছে বিভিন্ন প্রকাশনীর অধিকাংশ বই। গল্প, কবিতা, উপন্যাস, মুক্তিযুদ্ধ, ভ্রমণকাহিনীসহ বহুমাত্রিক বিষয়ের প্রবন্ধের বইগুলোর মাঝে বৈচিত্র্য খুঁজে নিচ্ছেন পাঠকরা। বৃহস্পতিবার ছিল মেলার ছাব্বিশতম দিন। বাংলা একাডেমির জনসংযোগ বিভাগের তথ্যানুযায়ী, এদিন পর্যন্ত প্রকাশিত হয়েছে ৪ হাজার ৩৯৩টি নতুন বই। আর এই বিপুলসংখ্যক বইয়ের মধ্যে সব বই মানসম্পন নয়। তবে প্রকৃত পাঠকরা ঠিকই খুঁজে নিচ্ছেন মানসম্মত বইটি। তালিকা ধরে ধরে সংগ্রহ করছেন মননের উপযোগী এক বা একাধিক বই। বৃহস্পতিবার বসন্ত বিকেলে কয়েকটি বইয়ের ব্যাগ নিয়ে স্টলে স্টলে ঘুরছিলেন বেসরকারী চাকরিজীবী আফসারুল আলম। কথা প্রসঙ্গে বলেন, মেলার প্রথম দিকে একবার এসেছিলাম। তখন বেতন হয়নি এবং খুব বেশি বইও বের হয়নি। আমার কাছে এখনই হচ্ছে বই কেনার সবচেয়ে উত্তম সময়। তাই আজ এসেছি বই কিনতে। বিভিন্ন ধরনের বই কিনলাম। প্রবন্ধের তালিকায় আছে সন্্জীদা খাতুনের ‘রবীন্দ্রকবিতার গহনে’ ও ও হাসান আজিজুল হকের ‘আমার রবীন্দ্রযাপন’। উপন্যাসের মধ্যে কেনা হয়েছে হরিশংকর জলদাসের ‘মৎস্যগন্ধা’ এবং আনিসুল হকে ‘এখানে থেমো না’। সংগ্রহ করেছি হেলাল হাফিজের কাব্যগ্রন্থ ‘বেদনাকে বলেছি কেঁদো না’ ও মারজুক রাসেলের ‘দেহবণ্টনবিষয়ক দ্বিপক্ষীয় চুক্তি স্বাক্ষর’। মাওলা ব্রাদার্সের প্রকাশক আহমেদ মাহমুদুল হক বলেন, এখন বইমেলায় কেউ আর ঘুরতে আসে না। মূলত যারা বই পড়তে পছন্দ করেন এবং সংগ্রহ করেন তারাই আসছেন মেলায়। এ কারণেই শেষ দিনগুলো প্রকৃত পাঠকের আনাগোনা জমে ওঠে বইমেলা। প্রথাবিরোধী লেখক হুমায়ুন আজাদ স্মরণ প্রথাবিরোধী লেখক হুমায়ুন আজাদের ওপর মৌলবাদী চক্রের সন্ত্রাসী হামলার বার্ষিকী উপলক্ষে অমর একুশে গ্রন্থমেলায় তাকে স্মরণ করা হয়েছে। ২০০৪ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি মেলা থেকে বের হওয়ার পথে তিনি জঙ্গী হামলার শিকার হন। বৃহস্পতিবার বিকেলে বাংলা একাডেমির বর্ধমান হাউসের সামনের খোলা চত্বরে লেখক প্রকাশক পাঠক ফোরামের যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত এ সভার শুরুতে লেখকস্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্য প্রদান করেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক হাবীবুল্লাহ সিরাজী। মুক্তিযুদ্ধে কাপাসিয়া গ্রন্থের মোড়ক উন্মোচন মুক্তিযোদ্ধা ও গাজীপুরের কাপাসিয়ার সাবেক সাংসদ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। এবারের গ্রন্থমেলায় এসেছে এই প্রবীণ রাজনীতিবিদের লেখা গ্রন্থ ‘মুক্তিযুদ্ধে কাপাসিয়া’। একাত্তরে কাপাসিয়া অঞ্চলে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ যুদ্ধ, শহীদদের কথা, নিপীড়নের চিত্র এবং সেই সময়ের সাধারণের জীবনের কথা উঠে এসেছে গ্রন্থটিতে। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় গ্রন্থ উন্মোচন মঞ্চে লেখাপ্রকাশ থেকে প্রকাশিত বইটির মোড়ক উন্মোচন করা হয়। অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে বইটির মোড়ক উন্মোচন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক। আরেফিন সিদ্দিক বলেন, একাত্তরের উত্তাল দিনগুলোয় কাপাসিয়ার চিত্র উঠে এসেছে বইটিতে। মুক্তিযুদ্ধের পাশাপাশি মুক্তিযোদ্ধাদের কথা এবং সেই সময়ে ওই অঞ্চলের সাধারণের যাপিত জীবনের তথ্য তুলে ধরা হয়েছে গ্রন্থটিতে। মেলায় তথ্যমন্ত্রী ইমরান আকন্দের ‘বিপ্লবী নূর হোসেন’ গ্রন্থের মোড়ক উন্মোচন করতে বৃহস্পতিবার বইমেলায় এসেছিরেন তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ। বাংলা একাডেমির পুকুর পাড়ে মোড়ক উন্মোচন মঞ্চে এ উন্মোচন পর্ব অনুষ্ঠিত হয়। এসময় তিনি আরও দুটি গ্রন্থের মোড়ক উন্মোচন করেন। বইগুলো হলো শিবুকান্তি দাসের ‘আমার বঙ্গবন্ধু আমার স্বাধীনতা’ এবং মোহাম্মদ হোসেনের ‘মৃত্তিকা থেকে আকাশ ছুঁয়েছে যে নাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান’। এসময় বইগুলোর মোড়ক উন্মোচন করে তথ্যমন্ত্রী বলেন, জীবন গড়ার জন্য এবং প্রত্যয়ী মানুষ হিসেবে গড়ে উঠতে বইয়ের বিকল্প নেই। অভিভাবকদের উদ্দেশে তিনি বলেন, সন্তানদের হাতে স্মার্ট ফোন না দিয়ে বই তুলে দিন। আমার রাজনীতিতে আসার পেছনেও বেশ কয়েকটি বইয়ের গুরুত্ব রয়েছে। নতুন বই বৃহস্পতিবার মেলার ২৬তম দিন সবমিলিয়ে নতুন বই এসেছ ৪ হাজার ৩৯৪টি। এরমধ্যে কবিতার বই এসেছে ১ হাজার ৩৯৯টি, উপন্যাস ৬৭৬, গল্প ৫৬৩, প্রবন্ধ ২৪৬, ছড়া ১০৪, শিশুতোষ ১৮৪, জীবনী ১৩১, মুক্তিযুদ্ধ ১৪১, বঙ্গবন্ধু ১২৬, অনুবাদ ৫১। বাংলা একাডেমির জনসংযোগ বিভাগের তথ্যানুযায়ী বৃহস্পতিবার মেলায় নতুন বই এসেছে ১৫৫টি। এর মধ্যে পাঞ্জেরী এনেছে তাপস রায়ের ‘রসিক নজরুল’। বর্ষাদুপুর এনেছে সৈয়দ শামসুল হকের ‘সীমান্তের সিংহাসন’। ভাষাচিত্র এনেছে তুষার আব্দুল্লাহর ‘তারণ্য টি টুয়েন্টি নয় টেস্ট’। চর্চা গ্রন্থপ্রকাশ এনেছে হেলাল হাফিজের ‘এক জনমের জন্মজখম’। অনিন্দ্য প্রকাশ এনেছে আহমদ রফিকের ‘পাক-ভারত সমাচার ও বিবিধ প্রসঙ্গ’। ঈসা খাঁ সমকালীন ইতিহাস বাংলার ইতিহাসের এক বর্ণিল অধ্যায়ের নায়ক ঈসা খাঁ। ষোড়শ শতকের শেষ আর সপ্তদশ শতকের শুরুতে বাংলায় সাম্রাজ্যবাদী মুঘল আগ্রাসনের বিরুদ্ধে তার দুঃসাহসী লড়াইয়ের ইতিহাস আজ রূপ নিয়েছে কিংবদন্তীতে। এ লড়াইয়ে একা ছিলেন না তিনি। সঙ্গী ছিল তারই মতো আরও একদল স্বাধীনচেতা স্থানীয় জমিদার। ইতিহাস যাদের চেনে বারো ভূইয়া নামে। ঈসা খাঁ ছিলেন তাদেরই নেতা, প্রতিরোধ সংগ্রামের রূপকার। সেই ঈসা খাঁ, বারো ভূইয়া এবং তাদের বিচরণ ক্ষেত্র ভাটি অঞ্চলের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস লিখেছেন এই অঞ্চলের ইতিহাস ও স্থাপত্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. হাবিবা খাতুন। বইটির প্রচ্ছদ এঁকেছেন শামীম আহমেদ। কৃষ্ণচূড়া প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত ১০২ পৃষ্ঠার বইটির মূল্য দুই শ’ টাকা। মেলামঞ্চের আলোচনা বইমেলার মূলমঞ্চে গতকাল অনুষ্ঠিত হয় শামসুজ্জামান খান সম্পাদিত বঙ্গবন্ধু নানা বর্ণে নানা রেখায় শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন আহমাদ মাযহার। আলোচনায় অংশ নেন সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল, এনামুল করিম নির্ঝর এবং আমীরুল ইসলাম। বক্তব্য প্রদান করেন গ্রন্থের সম্পাদক শামসুজ্জামান খান। সভাপতিত্ব করেন মাহফুজা খানম। কবিকণ্ঠে কবিতা পাঠ করেন কবি রবীন্দ্র গোপ, বদরুল হায়দার, তপন বাগচী এবং খালেদ উদ্-দীন। আবৃত্তি পরিবেশন করেন আবৃত্তিশিল্পী সামিউল ইসলাম পোলক এবং সঙ্গীতা চৌধুরী। পুঁথিপাঠ করেন জালাল খান ইউসুফী। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে ছিল মিলন কান্তি দে’র রচনা ও নির্দেশনায় এবং দেশ অপেরা’র পরিচালনায় যাত্রাপালা ‘রক্তে রাঙানো বর্ণমালা’। এদিন লেখক বলছি মঞ্চে নিজেদের নতুন বই নিয়ে আলোচনা করেন রফিকুর রশীদ, সালমা বাণী, মতিন্দ্র মানখিন এবং নওশাদ জামিল। আজকের মেলা আজ শুক্রবার গ্রন্থমেলার ২৭তম দিন। মেলার দ্বার খুলবে সকাল ১১টায়। চলবে রাত ৯টা পর্যন্ত। মেলায় ১১টা থেকে বেলা ১টা পর্যন্ত থাকবে শিশুপ্রহর। বিকেলে মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হবে আবুল কাসেম রচিত বঙ্গবন্ধুর অর্থনৈতিক উন্নয়নদর্শন : জাতীয়করণনীতি এবং প্রথম পঞ্চমবার্ষিক পরিকল্পনা শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ পাঠ করবেন অসীম সাহা। আলোচনায় অংশ নেবেন এম এম আকাশ এবং নাসিমা আনিস। সভাপতিত্ব করবেন আতিউর রহমান।
×