ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

একুশের প্রথম প্রহর

প্রকাশিত: ০৯:২৪, ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২০

 একুশের প্রথম প্রহর

‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’র প্রথম প্রহর বছর ঘুরে প্রতিবার আমাদের কাছে আসে লক্ষ ফুলের ভালবাসা আর শ্রদ্ধা নিবেদনে একাকার অমলিন ভাবগাম্ভীর্যে। একুশের প্রথম প্রহরকে বর্ণাঢ্য বরণের পূর্ব প্রস্তুতি চূড়ান্ত হয় বিশের শীতে-কাঁপা শেষ প্রহর শেষের অনেক আগেই। বিশের শেষ ভাগেই শুরু হয়ে যায় একুশ বরণের বিশেষ পদযাত্রা। কারণ রাত ১২টা ১ মিনিটেই শ্রদ্ধাজ্ঞাপন শুরু হবে দুখিনী জননী শহীদ মিনারের কোলে। ‘মায়ের ভাষায় কথা বলাতে/ স্বাধীনতার পথ চলাতে/ হাসিমুখে যারা দিয়ে গেল প্রাণ’, সেইসব মহান আত্মাকে সম্মিলিতভাবে জানাতে হবে ‘সালাম সালাম হাজার সালাম।’ যে কোন মিছিল মানেই স্লোগানে স্লোগানে প্রতিবাদে-প্রতিরোধে ফেটে পড়া এক শব্দবাজ সক্রিয়তা। কিন্তু একুশমুখী শহীদ মিনারগামী মিছিলটি একেবারেই নীরব- এটির নামই মৌন মিছিল। মৌনতার শক্তি কেমন? জনপ্রিয় উত্তর- ‘অনেক কথা যায় যে বলা/ কোন কথা না বলি।’ তাই বুঝি একুশে মৌন মিছিলের সারথীদের মুখে কোন কথা ফোটে না। হাতে হাতে ফোটে শুধু ফুল আর বর্ণপ্রেমী নানা বরণ ব্যানার-ফেস্টুন-প্ল্যাকার্ড। ফুলেদের নানান নাম- গোলাপ, গাঁদা, কৃষ্ণচূড়া, রজনীগন্ধা- আরও কত কি! ফুলেদের আকার- প্রকারও হরেক রকম- একক, তোড়া, ডাঁটা, মালা, চাকতি ইত্যাদি। এমন মিলনমেলায় জড়ো হয় শিশু-কিশোর-যুবা প্রৌঢ়-বৃদ্ধ সবাই। পূর্বপ্রজন্মের কাছ থেকে নতুনেরা শিখে নেয় বাঙালীর ভাষা আন্দোলনের রক্তলাল ইতিহাস- শহীদ মিনারের অশ্রুসজল জন্মগাঁথা। ১৯৫২ সালের ২৬ জানুয়ারি পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দীন ঢাকার পল্টন ময়দানে এক জনসভায় ঘোষণা দিলেন, ‘একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা।’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসমাজ এই অন্যায় ও অযৌক্তিক দাবির বিরুদ্ধে বিক্ষোভে ফেটে পড়ল। কারণ তখন সারা পাকিস্তানে উর্দুভাষীদের সংখ্যা ছিল মাত্র ৭ শতাংশের কিছু বেশি। পক্ষান্তরে বাংলাভাষী ছিল ৫৬ শতাংশ। বাকিরা ছিল সিন্ধি, পস্তু ও অন্যান্য ভাষাভাষী। ফলে ছাত্রদের সাথে রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক-পেশাজীবী ও অন্যান্য ব্যক্তিত্বের সমন্বয়ে গঠিত ও সংগঠিত হয় ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ।’ সংগঠনের পক্ষ থেকে একুশে ফেব্রুয়ারিকে ‘ভাষা দিবস’ ঘোষণা করে সমগ্র পূর্ববাংলায় সর্বাত্মক ধর্মঘট, শোভাযাত্রা ও জনসভার আহ্বান জানানো হয়। ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ আন্দোলনের আগুন দাবানল হয়ে ছড়িয়ে গেলো সবখানে। শাসক দল ২০ ফেব্রুয়ারি বিকেল থেকেই ১৪৪ ধারা জারি করে। কিন্তু কালাকানুন ভঙ্গ করে পরদিন সকালেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার সভাস্থলে জড়ো হলো ২০-২৫ হাজার ছাত্র। যোগ দিল সাধারণ জনতা। স্লোগানে স্লোগানে কেঁপে উঠল চারদিক। টিয়ার গ্যাস, লাঠিচার্জ শেষে বিকেল তিনটার পর বেপরোয়া গুলি ছুড়ল পুলিশ। লুটিয়ে পড়ল রফিক, সালাম, বরকত, জব্বারের মতো আরও বহু দেশপ্রেমিক ছাত্র-জনতা। তাঁদের সম্মানে ও স্মরণে পরদিনই ঘটনাস্থলে নির্মিত হলো শহীদ মিনার। নিজের ভাষার জন্য এতগুলো তাজা প্রাণ এভাবে আত্মাহুতি দিয়েছে, পৃথিবীতে ‘এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি।’ তাই একুশে ফেব্রুয়ারি আজ শুধু বাঙালির ‘শহীদ দিবস’ই নয়Ñ গোটা দুনিয়ার জন্য ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস।’ বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের পথ বেয়ে ছেষট্টির ছয় দফা। তারপর ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের হাত ধরে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীন বাংলাদেশ। এ জন্যই বাঙালীর লড়াইয়ের ইতিহাসে ভাষা আন্দোলন এক অনিবার্য মাইল ফলক। তাই একুশে ফেব্রুয়ারি আমাদের জাতীয় জীবনে এত গুরুত্বপূর্ণ দিন। একুশের প্রথম প্রহরে বাংলাদেশের সব শহরের সমস্ত সড়ক মৌন মিছিলের স্রোতস্বিনী নদী। ফুল আর মানুষের ঢেউয়ে ঢেউয়ে সব নদীর নিশানা মোহনার দিকে- মোহনার নাম শহীদ মিনার। পরম শ্রদ্ধার ও গভীর ভালবাসার প্রিয় পুষ্পার্পণ শেষে একটুকরো ঘুমের আশায় মানুষেরা বাড়ি ফিরে যায়- কারণ আরেক প্রহর পরেই প্রভাত ফেরি। শহীদ বেদীতে গা জড়াজড়ি করে ফুলেরাও একে একে ঘুমিয়ে যায়। শুধু একা জেগে থাকে শহীদ মিনার- আমাদের জনমদুখিনী মা। কেননা মা জানে, আগামী ভোরের আগেই শেষরাতের যে কোন সময়ে তার সূর্য সন্তানদের অমর আত্মারা আসবে নীরব ভ্রমণে। তাই মায়ের এই নিশিজাগা ব্যাকুল প্রতীক্ষা-কখন ‘ ওরা আসবে চুপিচুপি/ যারা এই দেশটাকে ভালবেসে দিয়ে গেছে প্রাণ’।
×