ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ব্যক্তি ও সৃষ্টির দ্বন্দ্ব

প্রকাশিত: ০৯:২৩, ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২০

ব্যক্তি ও সৃষ্টির দ্বন্দ্ব

ব্যক্তির নিজস্বতার মধ্য দিয়ে শুরু হয় অস্তিত্ব চিন্তার। অস্তিত্ব চিন্তা তার চিন্তা-সত্তায় বিরাজমান। সত্তা চেতন এবং অচেতন। মানুষ চেতন সত্তার প্রাণী, আর অন্যান্য অচেতন এবং ভাষাহীন বা জড়। মানুষের অস্তিত্বে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যতা অস্তিত্ব বিশ্বাসকে নিয়ন্ত্রণ করে। মানুষ যখন কোন কিছু সম্পর্কে জানতে চায় বা পারে তখন তার পূর্ণতা আসে দুটো প্রশ্নের জবাব থেকে ওটা কী এবং ওটা কী নয়। মানুষের এই চিন্তার শুরু সামগ্রিক সমাজের অখন্ডতার একক থেকে বিযুক্ত হয়ে একজন হিসেবে। স্বতন্ত্রভাবে নিজ-প্রত্যয়ের কেন্দ্রবিন্দুতে পৌঁছানো তার চেষ্টা, এটাই তার স্বাতন্ত্র্য। কিন্তু এই প্রশ্নগুলো মূলত অস্তিত্ব কেন্দ্রিক; কে আমি, কেন আমি এবং তা সামাজিক দিক থেকেও নিজ অবস্থান দিকচিহ্নের অনুসন্ধান। কতগুলো বাস্তব চিন্তা থেকে যেমন নিজ অস্তিত্ব প্রশ্নমুখী হয়, তেমনি কতগুলো সামাজিক অসাহয়ত্ব থেকেও কল্পিত ভাবনায় অস্তিত্ব শনাক্তকরণের চেষ্টা মানুষের মনোবৃত্তিতে আবর্তন তোলে। সাধারণ ও কঠিন এসব জিজ্ঞাসাগুলোর সমাধানে যে উত্তর মীমাংসিত বা অমীমাংসিত; তার সবটাই সামাজিক সঙ্গতি ও অসঙ্গতির মধ্যে। সামাজিক সত্তাই তাকে বিষয়গুলো উসকে দেয়। কারণ সামাজিক সঙ্কট এবং বস্তুবিশ্ব ও ব্রহ্মান্ডের বিশালত্ব এবং বহুক্ষেত্রে এখনও বোধাতীত রহস্যময়তা মানুষকে নিজ অস্তিত্ব সম্পর্কে প্রশ্নযুক্ত করে। মানুষ অস্তিত্ব চিন্তাকে প্রাধান্য দেয় এবং যতিহীন জীবন প্রবাহে সমাধান খোঁজে স্ব-স্বভাবে। সব কিছু থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে নিজকে জানা যায় না। প্রকৃতির সব কিছুই আপাত দৃষ্টে বিচ্ছিন্ন মনে হলেও এবং নানা গুণ সম্পন্নতা দৃশ্যমান/অদৃশ্যমান থাকলেও এর সামগ্রিকতায় চেনা ও অচেনা সুর রয়েছে। তার ব্যবহার, নিয়ন্ত্রণ এবং ব্যবহার উপযোগী পরিবর্তন রূপান্তর ও উন্নয়ন ইত্যাদি প্রাকৃতিক ও মানুষ কর্তৃক সংঘটিত হয়ে ব্যবহার উপযোগী হয়। রকমের হেরফেরে মানুষই ভিন্নতা আনে। এ জন্য মার্কস একে হিউম্যানাইজড ন্যাচার বলে উল্লেখ করেছেন। প্রত্যেক মানুষই জন্মসূত্রে এবং পদার্থগত গুণমানতার কারণে স্বতন্ত্র, যদিও সমাজের বৈশিষ্ট্যগুলোও তার সারসত্তায় স্থিত হয় এবং একজন মানুষ সামাজিক ও রাজনৈতিক কারণের মধ্য দিয়ে যৌগসত্তাধারীতে রূপান্তরিত হয়ে যৌগ পতিত সত্তাধারীতেও রূপান্তরিত হতে পারে। বাস্তবে প্রত্যেক মানুষের স্বতন্ত্র চিন্তা কাঠামো জন্মসূত্রেই বিদ্যমান। মানুষের ভাষা আছে, ভাষার মাধ্যমেই মানুষ তার চিন্তাকাঠামোকে প্রকাশ করে। মানুষের কল্পনাও সামগ্রিকতার উৎসমুখ থেকে উৎসারিত এবং যদিও কোন কোন ভাবনা/চিন্তা চলমানতা থেকে বিচ্ছিন্ন প্রত্যক্ষণ যোগ্য নয়, তথাপিও তার মূল ভিত্তি সামাজ, সামাজিক অবস্থা থেকে সৃষ্ট চাহিদা। সঙ্গত কারণে একজন মানুষের অস্তিত্বের বিষয়টি স্পষ্ট/অস্পষ্ট বা বিভ্রান্তিকর হয়ে ওঠে সামাজিক সংকীর্ণতা, বিকাশের সঙ্কট ও ব্যবহারিক সীমাবদ্ধতার কারণে। প্রতিটি মানুষই একজন ব্যক্তি; যে ব্যক্ত হয় সারাজীবন তার অস্তিত্বের সংগ্রামের মধ্যে এবং এমন কী সুন্দর হৃদয়াবেগ প্রকাশের মাধ্যমে, জন্মসূত্র ধারায় প্রতিটি মানুষই বৈশিষ্ট্যগতভাবে স্বতন্ত্র। জন্মের পরেই একজন মানুষ সমাজিকীকরণের মধ্যে প্রবেশ করে না- নানা ধাপ তাকে অতিক্রম করতে হয়; ‘কজিটো বা আমি চিন্তা করি’ বলেছিলেন দেকার্তে। ‘আমি চিন্তা করি তাই আমি হই’ অর্থাৎ আমি বা আমার ব্যক্তিসত্তা একটি নির্দিষ্ট কেন্দ্রীভূত অস্তিত্ব। একটি মানব শিশু নিজেকে চিনতে পারে আয়নায়, একেই লাঁকা বলেছেন মুকুরপর্ব। আর এর মধ্যদিয়ে গড়ে উঠছে আমি সত্তা। প্রাণিজগতে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে তার শাবক হাঁটতে চলতে শুরু করে, মানব শিশুকে এই পর্যায় পর্যন্ত অনেকটা সময় নির্ভরতায় থাকতে হয় এবং প্রশিক্ষণ কালেই তার উপর আরোপিত হয় সামাজিক নিয়মাচারগুলো। ফলে তার সত্তার অন্তরায়ন ঘটে সমাজসত্তায়- বাকিটুকু নিজত্ব। আর এটাই এক মানুষ থেকে আরেক মানুষের ফারাক। একই ভিতে অস্তিত্বমান বস্তু ভিন্নভিন্ন গুণ প্রকাশ করে আবার মানুষও তার প্রয়োজনে বস্তুর ভেতর ও বাহিরের গুণাগুণকে নিয়ন্ত্রণ করে নিজের ব্যবহারযোগ্য করে। ব্যক্তি মানুষ বসবাস করে সমাজে, কিন্তু সচেতনার ক্ষেত্রে সকলে সম নয়, কারণ সমাজ নিয়ন্ত্রিত হয় রাজনীতি দ্বারা। রাজনীতি ব্যক্তিবিশেষের ক্ষমতা করায়ত্বের উপায় বলে গণ্য হলে এর বিকাশ, মেধা ও মননের বিকাশ, অর্থাৎ চেতনা ও অগ্রগামীতার বিকাশ রুদ্ধ হয়। মানুষ কেবল একটা প্রাণী হিসেবে বেঁচে থাকে, আর তার উন্নয়নের নামে তাকেই প্রতারণা করে আধিপত্যবাদী শ্রেণী। তারা নিজদের ভোগে ও বিকাশে সকল ক্রিয়া সম্পাদন করে জনগণের শ্রম-ঘামের উপর দাঁড়িয়ে এবং পাচার করে, লোটে তাকে আরো নিঃস্ব করে। সঙ্গত কারণে চেতনার প্রগতিমুখী অগ্রমুখ আবদ্ধ হয়ে পড়ে এবং সুন্দর/অসুন্দর নির্ণয়ক বোধটুকুও হারিয়ে যায়। এ রকম পরিস্থিতিতে সুস্থ বিনোদন বলতে যে সকল মাধ্যমগুলো প্রথাবদ্ধতাকে সমৃদ্ধ করে নতুন যুগ নির্মাণের মধ্যদিয়ে জাতীয় সংস্কৃতিকে রাহুমুক্ত করবে তা এক ভূঁয়া রূপ হয়ে সৃষ্টি করে পরজীবী বুদ্ধিজীবী, শিল্পী, কবি ও সাহিত্যিক। যারা নানা ভাবে সংস্কৃতিকে উপনিবেশিক ভাবাদর্শে বড় জোর সামন্তীয় বোধে প্রকাশ করে প্রকৃত বিদ্রোহকে, সুন্দরকে আড়াল করে। আর তা ভোগী শ্রেণীর সেবায় লাগে। এতে তারা ক্ষমতা কেন্দ্রের পিঠপোছা পায়, নানা আকারে, আর তা পাবার জন্য কাড়াকাড়ি করে। আর এভাবেই সৃষ্ট হয় অস্তিত্বের লড়াই। এই লড়াই চলে জীবনকাল ব্যাপী এবং টিকে থাকার উপায়গুলো প্রজ্ঞায় যুক্ত হয়ে টিকিয়ে দেয় ব্যক্তিকে এটাই ‘স্ট্রাগল ফর এ্যাকজিস্টেন্স’। অস্তিত্ববাদী চেতনার প্রথম দার্শনিক রূপ দিয়েছিলেন কিয়ের্কেগার্দ। তিনি কবিও ছিলেন। কবিতার সঙ্গে অস্তিত্ববাদের যোগ-সাজসের একটা ভিত্তি এখান থেকেই পাওয়া যায়। ‘বাস্তবে আদর্শ জগতই কবিতার বিলাসভূমি’ আর তাতেই সাধারণ লোকেরা নিজ হৃদয়ের আভাস পায়। পাশ্চাত্য দর্শনে যখন হেগেলের জয়জয়কার; কিয়ের্কেগার্দ তার বিপক্ষে দাঁড়ালেন এবং পর্যাক্রমে তা’ পরবর্তী দার্শনিকদের হাতে একটা গভীর ভিত্তি পেল এবং পরবর্তী সময়ে সার্তের হাতে যৌক্তিক ভিত্তি পেয়ে চেতনাজগতকে নতুনভাবে আলোড়িত করছে। তবে এও সত্য যে এই চিন্তা অতীত থেকেই দর্শন জগতে বিরাজমান ছিল, সোক্রেটিসের সমগ্রজীবনেই ছিল অস্তিত্বের সংগ্রাম। তিনি জনে জনে প্রশ্ন-উত্তরের মধ্যদিয়ে অস্তিত্বকে উপলব্ধি করতে চেয়েছিলেন। জীবন ও মৃত্যুর সন্দিক্ষণেও প্রিয়জনদের সঙ্গে যে কথপোকথন তাও অস্তিত্বের অনুসন্ধান মাত্র। ব্যক্তির অস্তিত্ব নির্ধারিত হয় ব্যক্তির সামাজিক অবস্থানের অস্তিত্ব দ্বারা। চেতনা সামাজিক, সমাজই মানুষের চেতনাকে নিয়ন্ত্রণ করে। ব্যক্তিমানুষের স্বাতন্ত্র্যতা, ইচ্ছার স্বাধীনতা ও দায়বদ্ধতা, হতাশা, মনস্তাপ ও উৎকণ্ঠা ইত্যাদি এক মানুষ থেকে আরেক মানুষকে ভিন্নতা দেয় এবং চিন্তাকে প্রভান্বিত করে আবার দূরত্বও তৈরি করে ঐক্য থেকে বিচ্ছিন্ন করে। অস্তিত্ব সঙ্কটের তীব্রতা শিল্পের সকল ক্ষেত্রেই বিরাজমান তবে কাব্যে এর উপস্থিতি ব্যাপক। মনস্তত্ত্ববিদ ইয়ঙ মানব মনকে দুই ভাগে বিভক্ত করেছিলেন। ইয়ঙ শিল্পী এবং ব্যক্তিমানুষকে কেবল পৃথকরূপে নয় পরস্পরকে দ্বন্দ্বমুখর বলেছেন। তিনি শিল্পী-স্বভাব কে ব্যক্তি স্বভাব থেকে পৃথক বলে মনে করেছেন। শিল্পী স্বভাব প্রকাশ পেতে গেলে ব্যক্তি স্বভাবের নির্বাসন দরকার এমন মতও তার ছিল। তেমনি কীটস শিল্পীর ব্যক্তিত্বের মধ্যে অহং বিমুক্ত এক নতুন ব্যক্তিত্বের অস্তিত্ব বর্তমান মনে করতেন। এমনি ভাবে শিল্প-সাহিত্য সৃষ্টির ক্ষেত্রে স্রষ্টার মধ্যে কেউ খুঁজে পেয়েছেন দৈব প্রেরণা, কেউ বিশ্বাস করেছেন ব্যক্তির স্বতন্ত্র্যতায়, কেউ এই মানুষকে কালেক্টিভ মানুষ বলেছেন। কোন মানুষই তার সৃষ্টির মুহূর্তে সমাজ,অর্থনীতি ও পরিবেশকে মন থেকে মুছে ফেলতে পারে না। শিল্পী ও ব্যক্তি মানুষের মধ্যের ঐক্য ও দ্বন্দ্ব দুই বিরাজমান। একজন মানুষের মধ্যে বিশ^াস এবং অবিশ্বাসের উপস্থিতি থাকে এবং উপযুক্ত কারণ ছাড়া এই দ্বৈরথ কাটে না। শিল্পী সমাজে সমাজবদ্ধ মানুষ হিসেবে বিবেচনা পেলেও তার জীবন-যাপন ভাবনায় বহুক্ষেত্রে সামাজিক মানুষের প্রথাবদ্ধতার ঐক্য-চিন্তা ও চেতনার ভিন্নতা তা কিঞ্চিত/বিশাল পর্যায়ের হলেও বৈশিষ্ট্যগত ভাবে লক্ষণীয়। যা কোন কোন ক্ষেত্রে তীব্র হয়ে ওঠে। শিল্পের প্রকাশ ভাষায়, ভাষার দুর্গমতাও অনেক ক্ষেত্রে কারণ হয়ে থাকে। অবিনির্মাণ তত্ত্বে দেরিদা উল্লেখ করেন ‘একটি শব্দের নির্দিষ্ট কোন অর্থ নেই-একটি শব্দের অর্থ তার কাছাকাছি যে সমার্থক শব্দগুলো আছে, তার সঙ্গে পার্থক্য করে নির্ণয় করতে হয়। বাড়ি এই শব্দটি ঘর, গৃহ, বাটিকা, প্রাসাদ, অট্টালিকা, পরিবার ইত্যাদি শব্দের থেকে আলাদা। যেমন চৌধুরীদের বাড়ি বললে চৌধুরী পরিবারকেও বুঝাতে পারে’। আবার হাত বললে মানুষের হাত কে বুঝায়, কিন্তুএ কাজে তার হাত আছে তা হলে বোঝা যায় প্ররোচনা। যেহেতু প্রতিটি শব্দ একটি ইমেজ বা ছবি ( আসল বা এবস্ট্রাক্ট) কে প্রতিনিধিত্ব করে সেহেতু বাড়ির সঙ্গে ঘর, অট্টালিকা ইত্যাদি শব্দগুলোর পার্থক্য নিরূপণ করতে সমার্থক শব্দগুলোর ইমেজ, সামাজিক, ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটকেও ভাবতে হবে । সমাজে এই ভাষার ছকটি পূর্ব নির্দিষ্ট, একটি বিষয়ের ক্ষেত্রে ভাষার শব্দগুলো একটি নির্দিষ্ট অর্থকে নির্মাণ করে, কিন্তু সেই একই শব্দ সাহিত্যে-কাব্যে-শিল্পে ভিন্ন ভিন্ন অর্থের দ্যোতক হয়ে ওঠে। আর টেক্সটগুলোর অর্থবোধকতা অর্থাৎ শিল্পের রূপ সাহিত্যে, গান, ছবি, নাচ, নাটক ভোক্তার কাছে বিরোধপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। এ প্রসঙ্গে মার্কস-এর বক্তব্য এ রকম যে শিল্পরস আস্বাদন করতে হলে ভোক্তার শিল্প-রস আস্বাদনে প্রস্তুতকৃত মনের প্রয়োজন। কবি শিল্পী সমাজের অন্যান্য অংশের চেয়ে অধিক মাত্রায় সংবেদন শীল। তার প্রকাশ অনেক সময় গতানুগতিক হলেও তার চেতনায় উপস্থিত থাকে এক ধরনের শৃঙ্খলা যার রূপটি গতানুগতিকতার মধ্যের বিরোধাত্মকতা এবং কল্পনার সামগ্রিকতায় উপস্থিতির স্থিতিতে বিরোধকে মাত্রা দেয়। তবে প্রাপ্তির লোভ অনেক সময়ই শিল্পীকে আপোসমুখী করে এবং নীতি ও নৈতিকতায় আপোস রফা করে সৃষ্টিকে আধিপত্যবাদী শক্তির উপাসক করে। এভাবেই কবি শিল্পী সাহিত্যিকরা অধিকাংশ অচেতন পাঠকের সঙ্গ পেলেও কোন ক্ষেত্রে ব্যাপক পাঠকের অনীহার কারণ হয়ে উঠতে পারে। তবে শিল্পী তার নিরলস কর্মদ্বারা সমাজ-প্রগতির ভাষাটাকে ব্যবহারের মধ্যে এনে তার নিজস্ব কণ্ঠস্বর তৈরি করতে পারলে এই বিরোধ অনেকাংশে অপসারিত হয় এবং ভোক্তা ও স্রষ্টার নৈকট্য বাড়ে। এজন্য তুর্গেনেভ বলেছিলেন ‘সাহিত্য কর্মের জন্য একজন প্রতিভাবান শিল্পীর নিজস্ব কণ্ঠস্বর আবশ্যক’। ‘ভাষাতাত্ত্বিকেরা ঐতিহাসিকভাবে সময়ের বিবর্তনের সঙ্গে কীভাবে শব্দের অর্থ ও ধ্বনিরূপ পালটে যায়, তার তুলনা করেছেন। কী কারণে এই পরিবর্তন সাধিত হয়, সেটাও বোঝার চেষ্টা করেছেন। তারা লক্ষ্য করেছেন ভাষা হচ্ছে অনুকৃতি, নিজস্ব নিয়মের দ্বারা গঠিত পদ্ধতি নয়। শব্দ, তাদের মতে প্রতীক, যা বস্তু বা ধারণাকে প্রতিফলিত করে। ভাষাতত্ত্বে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন ফরাসী ভাষাবিজ্ঞানী ফার্দিনান্দ দ্য সোসুর। ভাষার সমকালীন রূপের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি এটা মেনে নিতে পারেননি যে ভাষা হচ্ছে অনুকৃতি কিংবা স্বচ্ছ কিছু। পক্ষান্তরে তিনি বলেছেন ভাষা হচ্ছে এক ধরনের পদ্ধতি এবং চিহ্ন বিশেষ। ভাষার লিখিত বা ধ্বনিরূপকে তিনি দ্যোতক বা চিহ্ন (signifier) এবং অর্থকে দ্যোতনা বা চিহ্নায়ক (signified) বলে উল্লেখ করেছেন। দ্যোতক, সোসুরের মতে, বস্তুকে নির্দেশ করে না, নির্দেশ করে মনের কোন ধারণাকে। ভাষাই আমাদের অভিজ্ঞতাকে আকার দেয়, কাঠামোবদ্ধ করে। ভাষা একই সঙ্গে আপেক্ষিক (arbitrary) আর পার্থক্যের উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা বস্তুজগত কিংবা ভাবজগতকে আমাদের বোধের সীমায় নিয়ে আসে। ভাষাগত এই পৃথকতার বোধই পরবর্তী কালে অবিনির্মাণ তত্ত্বের সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এটি নির্দেশ করেছে সেই বৈপরীত্যকে, কাঠামোবাদীরা যাকে উল্লেখ করেছেন বিপরীত যুগ্মতা (binary opposition) বলে। এই বিপরীত যুগ্মতা হাজির করে পরস্পরবিরোধী নানা শব্দগুচ্ছ, যেমন নারী/পুরুষ, ডান/বাম, দিন/রাত্রি ইত্যাদি। পরম্পরিত এই শব্দগুলোর একটি আবার অন্যটির অর্থ স্পষ্ট এবং গভীর করে তোলে। কালোকে আমরা ভাল বুঝতে পারি যেহেতু শাদার বোধ আমাদের কাছে স্পষ্ট, সেইভাবে নৈঃশব্দ্যের কথা স্পষ্ট হয়ে ওঠে শব্দেরই অনুষঙ্গে। সোস্যুরর এই বিপরীত যুগ্মতার প্রভাব শুধু ভাষাতত্ত্বের নয়, অন্যান্য বিষয়েও সঞ্চারিত হয়েছিল। সোস্যুরের ভাবনার মধ্য দিয়ে এভাবেই আরেকটি ভাবনারীতির উদ্ভব ঘটে যাকে চিহ্নবিজ্ঞানে (Semiology) হিসেবে উল্লেখ করা হয়। চিহ্নবিজ্ঞানের লক্ষ্য হচ্ছে সংস্কৃতিতে পর্যবেক্ষণ করা যায় এমন চিহ্নপদ্ধতির মাধ্যমে কোন কিছুর অর্থোদ্ধার।’ প্রত্যেক শিল্পীর মধ্যে যে বিরোধ তা চৈতন্য জগতের বিরোধ, তা যখন বিদ্রোহে রূপ নেয় তখনই শুরু হয় সৃষ্টির সংঘাত, সংগত কারণে বিরোধের মধ্য থেকে উৎপন্ন শিল্পপ্রকাশ অনেক সময়ই দূরত্বে থেকে যায় চলমান পাঠক চেতনা থেকে, এর যৌক্তিক কারণ রাজনীতি। যে অর্থনৈতিক কাঠামোদ্বারা একটি জাতি শাসিত হয় তার সম্পর্ক সবসময় জনগণের সংগে বিরোধপূর্ণ, কারণ ‘দেশ চায় স্বাধীনতা, জাতি চায় মুক্তি, জনগণ চায় বিপ্লব’। এ কারণে বিদ্রোহ থেকে বা বিদ্রোহের মধ্যদিয়ে যে নির্মাণ তা অনেক সময় চলমানতায় অনাদৃত বা উপেক্ষিত থেকে যায়।
×