ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ডিজিটাল মাদক থেকে মুক্তি

প্রকাশিত: ০৮:৫৫, ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২০

ডিজিটাল মাদক থেকে মুক্তি

উদ্ভাবিত প্রতিটি জিনিসেরই ইতিবাচক ও নেতিবাচক ব্যবহার এবং দিক রয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো মানব সভ্যতার যোগাযোগকে অনেক বেশি সহজতর করলেও এর ক্ষতিকর দিকও কম নয়। আমাদের জাতীয় জীবনে ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো বর্তমান যান্ত্রিক সভ্যতার যুগে মানুষের মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়নে যথেষ্ট ভাল ভূমিকা রাখছে এটি যেমন সত্য তেমনি কিছু ক্ষেত্রে ফেসবুক সামাজিক স¤পর্ক, সমাজ জীবন ও মননশীলতার ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে। বর্তমানে আমাদের জীবনের প্রথম পর্যায়ের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম হিসেবে পরিচিত ফেসবুক। ফেসবুক যাত্রা শুরু করেছিল ২০০৪ সালের ফেব্রয়ারি মাসে। মার্ক যাকারবার্গ নামের এক যুবক ছিলেন এর প্রতিষ্ঠাতা। মার্ক হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজ কক্ষে এটি চালু করেছিলেন। এটি কেবল ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্যই সীমিত ছিল। ইন্টারনেটভিত্তিক এই সামাজিক চ্যানেল এত দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে যে চালু হওয়ার মাত্র দুই সপ্তাহের মধ্যেই হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্ধেকেরও বেশি ছাত্রছাত্রী এর সদস্য হয়। আরও কিছু দিনের মধ্যেই কয়েক মিলিয়ন মানুষ ফেসবুকের গ্রাহক তালিকায় যুক্ত হন। এভাবে এ চ্যানেল পারস্পরিক যোগাযোগের এক শক্তিশালী মাধ্যমে পরিণত হয়। বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ৮০০ মিলিয়ন মানুষ ফেসবুক ব্যবহার করছে। এর ৫০ শতাংশ প্রতিদিন এ সাইটটি ব্যবহার করছে। গড়ে একজন ফেসবুক ব্যবহারকারীর ১৩০ জন বন্ধু রয়েছে। ফেসবেকার্স ডটকমের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে ২২ লাখ ৫২ হাজার ৮০০ ফেসবুক ব্যবহারকারী রয়েছেন, যা মোট জনসংখ্যার ১ দশমিক ৪৩ শতাংশ। ২১৩টি ফেসবুক ব্যবহারকারী দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৫৬। ব্যবহারকারীর সংখ্যার দিক দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ইন্দোনেশিয়ার পরে ভারতের অবস্থান। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেশের যুব সমাজ থেকে শুরু করে সর্বস্তরের মানুষ ধীরে ধীরে আসক্তিতে জড়িয়ে যাচ্ছে। স্কুল কলেজের ছেলেমেয়ে দিনের অধিকাংশ সময় ফেসবুক বা বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে উঠেছে। ফলে বাবা-মা, ভাই-বোন ও বন্ধু বান্ধবদের মাঝে প্রকৃত অর্থে দূরত্বের সৃষ্টি হচ্ছে। ফেসবুকের মতো মাধ্যমগুলোর নেশা দেশের উদীয়মান প্রজন্মকে তার স্বাভাবিক ব্যক্তিত্বের বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করছে। আমরা যারা ফেসবুক ব্যবহার করি তারা মাঝে মাঝেই নিজের অবস্থান সম্পর্কে স্ট্যাটাস দিয়ে থাকি। মন খারাপের মুহূর্ত, ভাললাগার মুহূর্ত সম্পর্কে স্ট্যাটাস দিয়ে থাকি। এতে আমরা কখন কী করছেন সব বিষয়ে আমাদের ফেসবুক ফ্রেন্ডরা জেনে যাচ্ছে। ফলে আমাদের জীবনের কোন গোপনীয়তাই থাকে না। এমনকি আমরা যারা অনেকটাই আবেগপ্রবণ তারা নিজেদের ডেটিংয়ের বিষয়েও জনসম্মুখে প্রকাশ করছি। এসব বিষয়ে আমাদের স¤পর্কে যে কেউ খুব সহজেই অনুমান করতে পারে। ফেসবুক ব্যবহারে একজন মানুষের ব্যক্তিত্বে রহস্য বলে কিছু থাকে না। যেমন : ফেসবুক স্ট্যাটাসে কারও সম্পর্কে খুব সহজেই ধারণা পাওয়া যাবে যে সে কেমন? সে কী পছন্দ করে এবং কী পছন্দ করে না। এতে বোঝা যায় একজন ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব কেমন? সাধারণত যারা বেশ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন তারা কখনই ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিতে পছন্দ করেন না। ফেসবুকে অনেক পরিচিত অপরিচিত নারীরা ফ্রেন্ড হয়ে যান। তারা দিনরাত চ্যাট করে যান। এতে তাদের মাঝে এক ধরনের স¤পর্ক তৈরি হয়ে যায়। তারা একে অপরের সঙ্গে দেখা করেন। ডেটিং করেন। কিন্তু একটু ভেবে দেখলে বুঝা যায় এই স¤পর্কগুলো কতটা স্থায়ী হয়। গবেষণায় দেখা গেছে যারা ফেসবুকে স¤পর্ক তৈরি করে তাদের মাঝে অনেক গভীর স¤পর্ক হয়ে যায় কিন্তু তা আর শেষ পর্যন্ত টিকে যায় না। ফেসবুকের ফলে বলা যায় দেশের তরুণ সমাজ বিপথে গমন করছে। আজকাল ফেসবুকে অপরাধ প্রবণতা বেড়ে গিয়েছে। বিভিন্ন ধরনের রাজনৈতিক জটিলতা নিয়ে ফেসবুকে বেশ আলোচনা সমালোচনা হয়ে থাকে। ফলে দেশের তরুণ সমাজ এর থেকে নোংরা রাজনীতিতে প্রবেশ করে। এর থেকে তাদের জীবনের ঝুঁকিও অনেক বেড়ে যায়। এছাড়া দেখা যায় বন্ধুদের পোস্টে কমেন্ট করে কি করে বন্ধুকে পঁচানো যায় সে বিষয়ে জোর প্রতিযোগিতা চলে। ফলে তাদের মাঝে গীবত করার প্রবণতাটা বেশি হয়। ফেসবুক একটি জনপ্রিয় মাধ্যম একথা বলতেই হয়। কিন্তু মানব জাতির একটাই সমস্যা ভাল বিষয়কে ভালভাবে ব্যবহার করতে আমরা অভ্যস্ত নই। এই জনপ্রিয় মাধ্যমটিকেও আমরা সঠিকভাবে ব্যবহার করছি না। বিভিন্ন বয়সের মানুষরা নিজেদের বা অন্য নামে ফেইক আইডি খুলে বিভিন্ন নারী পুরষের সঙ্গে গোপনে প্রেমালাপ ও অশ্লীল ভিডিও লেনদেন করে যাচ্ছে। দেখা গেছে এরা অনেকেই বিবাহিত। এতে তাদের নৈতিক অবনতি ঘটছে। বিবাহ বন্ধনটি অনেক ঠুনকো হয়ে গেছে। এর ফলে অনেকের বিবাহ বিচ্ছেদের খবরও পাওয়া গেছে। এতে মানব জীবনে ফেসবুক একটা বাজে প্রভাব ফেলছে। প্রতিটি জিনিসেরই সুফল এবং কুফল দিক রয়েছে। বিশ্ব বিখ্যাত বিজ্ঞানী নিউটনের বলেছিলেন, ‘প্রত্যেক ক্রিয়ারই একটি সমান ও বিপরীত ক্রিয়া থাকে।’ সুতরাং উদ্ভাবিত প্রতিটি জিনিসেরই ইতিবাচক ও নেতিবাচক ব্যবহার এবং দিক রয়েছে। একটি হাতিয়ার কেউ ন্যায় পথেও ব্যবহার করতে পারে আবার অন্যায় পথেও ব্যবহার করতে পারে। এই ফেসবুক যেন কেউ অন্যায় পথে ব্যবহার করতে না পারে সে জন্য আমাদের কিছু করণীয় আছে। এর ইতিবচক ব্যবহারই আমাদের সুফল বয়ে আনবে, যেমন: অভিভাবকদের সচেতন হতে হবে। ১৮ বছরের নিচে কেউ যেন এ্যাকাউন্ট খুলতে না পারে। প্রতিটি দেশে সরকারী মনিটরিং সেল গঠন করে ফেসবুকের স্ট্যাটাসকে মনিটরিং করতে হবে যাতে অন্যায় বা অবৈধ স্ট্যাটাস, ছবি, ভিডিও কেউ পোস্ট করতে না পারে। প্রতিটি ব্যবহারকারীকে নৈতিকতা এবং নিয়মনীতি মেনে ফেসবুক ব্যবহার করতে হবে। সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন হল, এ্যাকাউন্ট খোলার সময় অবশ্যই তার আসল পরিচয় নিশ্চিত হয়ে এ্যাকাউন্ট অনুমোদন দেয়া। এ ক্ষেত্রে এ্যাকাউন্ট খোলার সময় ফেসবুক কর্তৃপক্ষ আবেদনকারীর সরকারী কোন পরিচয়পত্রের সঙ্গে আইডি এ্যাড্রেস বা অন্য কোন উপায়ে নিশ্চিত হয়ে এ্যাকাউন্ট অনুমোদন দেয়া। ফেসবুকের মাধ্যমে অনেকদিন আগের কোন বন্ধু কিংবা আত্মীয়কে খুঁজে পাওয়া কিংবা নতুন কারও সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করা আমাদের অনেকের ক্ষেত্রে ঘটেছে, ফেসবুকের মাধ্যমে তথ্যেও আদান-প্রদান, খবর পাওয়া ইত্যাদি কিংবা অনেকে ফেসবুকের মাধ্যমে বাণিজ্য প্রসার করছেন; এসব ইতিবাচক দিক ছাড়াও ফেসবুকের কিছু নেতিবাচক দিক আছে, বিশেষ করে সাম্প্রতিককালে বেশ আলোচিত ব্যাপার হচ্ছে ফেসবুকে গুজব ও ভুয়া খবরের ছড়াছড়ি এবং তা কিভাবে আমাদের রাজনৈতিক ও সামাজিক জীবনে বিপর্যয়ের কারণ হচ্ছে। আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক নির্বাচনে ফেসবুকের ভুয়া খবর বিশেষ প্রভাব রেখেছে। এইসব ভুয়া খবরে জনমত ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয়েছে। যেমন, বার্তাসংস্থা বাজফিড নিউজের মতে নির্বাচনের আগের শেষ তিন মাসে ২০-টি ‘সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়’ ভুয়া খবরের সাইটগুলোর খবর শেয়ার করা, সেগুলোতে মন্তব্য করা, প্রতিক্রিয়া জানানো হয়েছে প্রায় ৮.৭ মিলিয়ন বার, অথচ নিউইয়র্ক টাইমস, ওয়াশিংটন পোস্ট ইত্যাদিসহ নির্ভরযোগ্য সংবাদমাধ্যমগুলোর খবর শেয়ার করা, মন্তব্য করা, প্রতিক্রিয়া জানানো ইত্যাদি হয়েছে ৭.৩ মিলিয়ন বার; অর্থাৎ, ভুয়া খবর জনগণের মতামতকে নতুন আরেকটি জরিপে জানা গেছে যে ৭৫% আমেরিকান অনলাইনের ভুয়া খবর দেখে সেটিতে বিশ্বাস করে। স্বয়ং ডোনাল্ড ট্রাম্প নিজেই নির্বাচন-পরবর্তী বক্তব্যে ফেসবুক ও টুইটারের ব্যবহারকে তার সাফল্যের অংশ হিসেবে তুলে ধরেছে, তার মতে যখন হিলারি ফ্লোরিডায় ৩৩ মিলিয়ন ডলার খরচ করেছিল টেলিভিশনে বিজ্ঞাপন দেয়ার জন্য সেখানে তার কর্মীরা ফেসবুক ও টুইটার ব্যবহার করে বেশি মানুষকে আকৃষ্ট করতে পেরেছিল। এছাড়া আমেরিকার গোয়েন্দা সংস্থার কর্মচারীরা বিশ্বাস করেন যে যদিও রাশিয়া হ্যাকিঙের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনকে সরাসরিভাবে প্রভাবিত করতে পারেনি, তবে তারা ভুয়া খবরের মাধ্যমে জনমত পাল্টিয়ে নির্বাচনকে প্রভাবিত করেছিল। স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েরা দিনের অধিকাংশ সময় ফেসবুকসহ অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ নিয়ে মেতে উঠছে। ফলে সামাজিক বন্ধন যেমন : বাবা, মা, ভাই-বোন,আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধবদের মাঝে প্রকৃত অর্থে দূরত্ব সৃষ্টি হচ্ছে। ফেসবুকের মতো মাধ্যমগুলোর নেশা গোটা বিশ্বের উদীয়মান প্রজন্মকে তার স্বাভাবিক ব্যক্তিত্বের বিকাশকে অঙ্কুুরেই বিনষ্ট করে দিচ্ছে। যে সময় হাতে বই খাতা থাকার কথা সে সময় তারা মোবাইল-ল্যাপটপ নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করছে। অস্বীকারের উপায় নেই। কিন্তু আমাদের একটাই সমস্যা আমরা ভাল বিষয়কে ভালভাবে ব্যবহার করতে অভ্যস্ত নয়। প্রত্যেক বিষয়ের মন্দ দিকটাই আমরা চট করে গ্রহণ করি। ফেসবুকও এর ব্যতিক্রম নয়। এই জনপ্রিয় মাধ্যমটিকে ও আমরা অধিকাংশই সঠিকভাবে ব্যবহার করছি না। বিভিন্ন বয়স ও পেশার মানুষেরা নিজেদের বা অন্যের নামে ছদ্ম নামে ফেইক আইডি খুলে বিভিন্ন নারী পুরুষের সঙ্গে অবৈধ ও অনৈতিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছে। অনেকেই আবার এখানে অশ্লীল ছবি পোস্ট করছে। দেখা গেছে, এদের অনেকেই বিবাহিত। এভাবে অনেক বিবাহ বিচ্ছেদের ঘটনাও ঘটছে। অনেকেই আবার গোপন স¤পর্ক গড়ে তুলে ভিডিও কলিংয়ের মাধ্যমে কথিত প্রেমিক-প্রেমিকাকে নিজের সব দেখাচ্ছে। কতটা বিকৃত রুচিবোধ হলে এমনটা হতে পারে। এভাবে এই যোগাযোগ মাধ্যমগুলো মানুষের মনুষ্যত্ব, চরিত্র, ইমান ও নীতি-নৈতিকতাকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। অধিকাংশ ছাত্র সমাজ ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউব, ম্যাসেঞ্জার ইত্যাদি নিয়ে মেতে আছে। পড়াশোনার সময়টা তারা নষ্ট করছে এসবের পিছনে। এমনকি পরীক্ষার্থীরা পরীক্ষার পূর্ব রাতে ফেসবুকে ডুবে থাকে। যে মূল্যবান সময়টা তাদের বই, খাতা, কলমের সঙ্গে কাটানো জরুরী সেই সময়টা তারা ফেসবুকের পেছনে অপচয় করছে। দীর্ঘক্ষণ স্ক্রিনে তাকিয়ে থাকার ফলে চোখের ক্ষতি হচ্ছে। এছাড়াও মাথাব্যথা, মাথাঘোরা, অবসন্নতা, মনমরা হওয়াসহ আরও অনেক স্বাস্থ্যগত ক্ষতি সাধন করছে এই ফেসবুক ও ইন্টারনেট ব্যবস্থা। এছাড়াও অনেকে অশ্লীল ও নোংরা ছবি ভিডিও ইত্যাদি দেখে খারাপ কাজে লিপ্ত হচ্ছে। ফেসবুকে চ্যাটিংয়ের কারণে স্বামী স্ত্রীকে আর স্ত্রী স্বামীকে সন্দেহ করছে। নিজেদের মধ্যে কলহ দিন দিন বাড়ছে। এক পরিবারে পাঁচজন সদস্য থাকলে পারিবারিক কথা আর হয় না, সেখানে দেখা যায় সবাই ফেসবুক নিয়ে বসে আছে। বছরের ৩০ হাজার বিবাহ বিচ্ছেদ হলে এর মধ্যে শতকরা ৯৫ ভাগ বিবাহ বিচ্ছেদ হচ্ছে এই ফেসবুকের কারণে। লেখক : ডেপুটি রেজিস্ট্রার, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা
×