ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

রিফাত কান্তি সেন

বাউল সম্রাট শাহ্ আবদুল করিম

প্রকাশিত: ১২:১৭, ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২০

বাউল সম্রাট শাহ্ আবদুল করিম

জীবন কখন কখনও রং বদলায়। কখনও জীবনের গল্পটার মাঝে ভিন্নতা খুঁজে পাওয়া যায়। এই যেমন নিতান্তই এক সাধারণ পরিবারে জন্ম নেয়া শাহ আব্দুল করিমের কথাই চিন্তা করা যাক। আজ তিনি বাউল স¤্রাট। ছিলেন রাখাল বালক আর এখন তিনিই কিনা বাউল স¤্রাট! এক নামেই চেনে গোটা জাতি। সিলেট সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার উজানধল গ্রামে ১৯১৬ সালের ১৫ ফ্রেব্রুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন তিনি। দিনমজুর পিতা ইব্রাহিম আলীর ছয় সন্তানের মাঝে একমাত্র পুত্র সন্তান তিনি। তাঁর মায়ের নাম নাইওরজান বিবি। দিনমুজুর পিতার সন্তান বলে জীবনের আসল বাস্তবতাটা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছেন তিনি। ভাটি অঞ্চলে বেড়ে উঠেছেন। মা, মাটির প্রতি অগাত টান ছিল তাঁর। বিখ্যাত এই সঙ্গীতের কিংবদন্তির জীবনের গল্পটা খুব একটা সুখকর ছিল না। নিত্য দুঃখ-কষ্ট আর যন্ত্রণাকে সাথী করেই জীবন সংগ্রামে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছিলেন। বাল্যকাল থেকেই দরিদ্রতাকে সঙ্গে নিয়ে বেড়ে উঠতে হয়েছিল। অর্থকষ্টে পরিবারের দিন কাটত তাঁদের। নিদারুণ ক্ষুদার যন্ত্রণা নিয়েই জীবনে বেশিটা সময় পার করতে হয়েছে তাকে এবং তাঁর পরিবারকে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ না হলেও নিজ প্রচেস্টায় এগিয়ে গিয়েছেন দুর্বার গতিতে। চলার পথের শত প্রতিবন্ধকতাকে দূর করতে যিনি ছিলেন বদ্ধপরিকর। দেশের কোটি মানুষের হৃদয় জয় করেছেন। ছোটবেলা থেকেই চোখেমুখে ছিল অসংখ্য স্বপ্ন। স্বপ্নরা তাকে ঘিরে ধরলে ও দরিদ্রতা তাকে চেপে ধরে। ছোটবেলায় তাঁর বয়সী অনেকেই যখন বইয়ের মাঝে স্বপ্ন খোঁজেন ঠিক তখন তিনি গরু রাখার কাজ করতেন। পরবর্তীতে গরু রাখার চাকরিতে ও যোগ দিতে হয়েছিল। লেখাপড়া বাদ দিয়ে রাখাল বালকের কাজে নেমে পড়েন তিনি। তখন তাঁর গ্রামে স্কুল-কলেজের ও তেমন ব্যবস্থা ছিল না। আর থাকলেই বা কী হতো! যেখানে নূন আনতে পান্থা ফুরায় পরিবারের সেখানে তো লেখাপড়া মানে আকাশ কুশুম কল্পনা ছাড়া আর কিছু নয়। যদিও একবার তিনি লেখাপড়া শেখার উদ্দেশ্যে পনেরো বছর বয়সে একটি নৈশ বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলেন। তবে সেটাও বেশি দিন টিকেনি। ভর্তির আট দিনের মাথায় বিদ্যালয়টি বন্ধ হয়ে যায়। এরপর অক্ষরজ্ঞানহীন ভাবে বেড়ে উঠেছেন তিনি, তবে যতটুকু শিক্ষা অর্জন করলে নিজের প্রতিভাকে বিকশিত করা যায় সে শিক্ষাটা তিনি আয়ত্ত করতে পেরেছিলেন। দেশে বিদেশে তাঁর এখন অসংখ্য ভক্তনুরাগী। ভক্তদের উপহার দিয়েছেন দেড় হাজারের ও বেশি গান। গানে ফুটিয়ে তুলেছেন সমাজের বাস্তবতার চিত্রগুলো। সাম্প্রদায়িকতা, কুসংস্কার, সামাজিক বৈষম্য তাঁর গানের মাধ্যমে প্রতিবাদের ঝড় তুলেছেন। ’৫৪ এর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন থেকে শুরু করে ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ, নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনসহ বাঙালীর আন্দোলন সংগ্রামে তাঁর রচিত গানগুলো অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে দারুণভাবে। বিখ্যাত গান- গাড়ি চলে না চলে না চলে না রে, বন্দে মায়া লাগাইছে পিরিতি শিখাইছে, আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম, আসি বলে গেল বন্ধু আইলো না, আমি কূল হারা কলঙ্কিনী, কেন পিরিতি বাড়াইলারে বন্ধু ছেড়ে যাইবা যদি। বাউল আব্দুল করিমের সাতটি গানের বই প্রকাশিত হয়েছে। ২০০১ সালে তিনি একুশে পদক লাভ করেন। এই রাখাল বালকের ১০টি গান ইংরেজীতে অনুবাধিত হয়। বাংলা একাডেমি তাঁর এই গানগুলো ইংরেজীতে প্রকাশ করার ব্যবস্থা করে দেন। শাহ আব্দুল করিম এক অসাধারণ প্রতিভার নাম। কর্মকে যিনি কখনই ছোট ভাবেননি। হীনম্মন্যতা তাকে কখনই ঘিরে ধরেনি। ছিলেন নিরাহঙ্কারী। দারিদ্র্যতার কষাঘাতে জীবন পার করা বালকটি জানেন দরিদ্রতার অভিশাপ কত বড়। সেই চিন্তা মাথায় রেখেই সাধারণ মানুষের জন্য তিনি গান লিখে গেছেন। জীবনে ঘটে যাওয়া সত্য অবলম্বনে তাঁর গানগুলো যে কারও হৃদয়ে গেঁথে যাওয়ার মতোই। জীবনের প্রতিপদে যার বাঁধার দেয়ার দেয়াল টপকাতে হয়েছে সেই কিনা এখন কোটি মানুষের অনুপ্রেরণার নাম। ২০০৯ সালের ১২ সেপ্টেম্বর গুণী এই সঙ্গীতশিল্পী তাঁর ভক্তদের রেখে পরপারে পাড়ি জমান। মৃত্যুর পরও কোটি মানুষের হৃদয়ের মণিকোঠায় তিনি স্থান করে আছেন।
×