ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

দুর্নীতির ১৪ উৎস ॥ দেশের স্থলবন্দর নিয়ে দুদকের অনুসন্ধানী প্রতিবেদন

প্রকাশিত: ১১:০০, ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২০

দুর্নীতির ১৪ উৎস ॥ দেশের স্থলবন্দর নিয়ে দুদকের অনুসন্ধানী প্রতিবেদন

স্টাফ রিপোর্টার ॥ বাংলাদেশ স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের আওতাধীন দেশের সকল স্থলবন্দরে সংঘটিত বিভিন্ন প্রকার দুর্নীতি অনুসন্ধান করে তা দূর করতে একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন দাখিল করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। প্রতিবেদনে স্থলবন্দরে দুর্নীতির ১৪টি উৎস চিহ্নিত করেছে ও এসব দুর্নীতি প্রতিরোধে ২৮ দফা সুপারিশ করেছে রাষ্ট্রীয় দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা। বুধবার প্রতিবেদনটি নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরীর কাছে দাখিল করেছেন দুদক কমিশনার ড. মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক। বাংলাদেশের স্থলবন্দরে যেসব দুর্নীতির উৎস দুদক চিহ্নিত করেছে সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো অধিকাংশ স্থলবন্দরের বিদ্যমান নিরাপত্তা ব্যবস্থা অপ্রতুল। অপ্রতুল নিরাপত্তা ব্যবস্থার সুযোগ নিয়ে বন্দর ও কাস্টমসের অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সহযোগিতায় প্রায়শই বিনা শুল্কে আমদানিকৃত মালামাল বের করে নেয়ার অভিযোগ রয়েছে। স্থলবন্দরসমূহের কেনাকাটায় সর্বদা সরকারী ক্রয় আইন ও বিধির যথাযথ প্রয়োগ না হওয়ায় স্থানীয় ব্যক্তিবর্গ নানাভাবে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করে থাকেন এবং ক্ষেত্র বিশেষে জালিয়াতি ও প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে দরপত্র প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করে থাকেন, যার ফলে দুর্নীতি ও আত্মসাতের মতো নানা অপরাধ সংঘটিত হয়। আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে লোকবল নিয়োগ ও বেতনাদি প্রদানের ক্ষেত্রে যথাযথ তদারকি ও স্বচ্ছতা না থাকায় কর্মে উপস্থিত ও অনুপস্থিত সকল শ্রমিকের নামে বিল উত্তোলন করার অভিযোগ রয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে একই স্টেশনে কর্মরত থাকায় বন্দরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে বন্দরকেন্দ্রিক সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীগণের এক ধরনের সখ্য গড়ে ওঠার অভিযোগ পাওয়া যায়, যার ফলে কর্তৃপক্ষের পক্ষে বন্দরকেন্দ্রিক দুর্নীতিমূলক কর্মকা- প্রতিরোধ করা অনেকটা কঠিন হয়ে পড়ে, মালামাল হ্যান্ডলিংয়ের জন্য ঠিকাদার নিয়োগের ক্ষেত্রে সর্বক্ষেত্রে সরকারী ক্রয় আইন ও বিধিমালার যথাযথ প্রয়োগ না হওয়ায় কাজ পাওয়ার অযোগ্য ঠিকাদারগণ দুর্নীতিমূলক কর্মকা-ের আশ্রয় নিয়ে কার্য সম্পাদনের চেষ্টা করে থাকেন। দুদক এ অবস্থা থেকে উত্তরণে ২৮ দফা সুপারিশ করেছে। সেগুলো হচ্ছে, মালামাল হ্যান্ডলিংয়ে গতিশীলতা বৃদ্ধি ও স্বচ্ছতা আনয়নে পর্যায়ক্রমে সকল স্থলবন্দরে অটোমেশন সিস্টেম চালু করা। কাস্টমস ও বন্দর কর্তৃপক্ষের সমন্বয়ে এক বা একাধিক যৌথ ভিজিল্যান্স টিম গঠন করা। সুনির্দিষ্ট কর্ম পরিধির আওতায় এসব টিম নিয়মিত কার্যক্রম মনিটরিং করবে এবং উর্ধতন কর্তৃপক্ষকে রিপোর্ট করবে। কাস্টমস গোয়েন্দাসহ অন্যান্য সংস্থার সহায়তায় গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ করে বিভিন্ন প্রশাসনিক, আইনী এবং প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে দুর্নীতি কমিয়ে আনা। সমন্বয়, মনিটরিং, সুপারভিশন ও নিয়মিত মূল্যায়নের মাধ্যমে বন্দরের সকল কার্যক্রমে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা। স্থলবন্দরসমূহে পণ্য হ্যান্ডলিংয়ের কাজে বন্দরের নিজস্ব ইক্যুইপমেন্ট (ক্রেন, ফর্কলিফ্ট) এর সংস্থান করা। বন্দর মাসুল ও শুল্ক ফাঁকি রোধে বন্দরের ওয়েব্রিজ স্কেলে আমদানিকৃত পণ্যবাহী ট্রাক ও খালি ট্রাকের ওজন নিশ্চিত করা। সার্বিক নিরাপত্তাসহ অপারেশনাল কার্যক্রম (আন্তর্জাতিক প্যাসেঞ্জার টার্মিনালসহ) মনিটরিং ও তদারকির জন্য পৃথক মনিটরিং সেল গঠন। বহুল আলোচিত বন্দরের চোরাই চক্রকে চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ এবং সেইসঙ্গে বন্দরসমূহের যে সকল কর্মকর্তা-কর্মচারী এ চক্রকে সহযোগিতা করে যাচ্ছেন তাদের চিহ্নিত করে দায়-দায়িত্ব নিরূপণপূর্বক বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা। স্থলবন্দরসমূহে কর্মরত কোন কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে অবহেলা কিংবা দুর্নীতির অভিযোগ পাওয়া গেলে তা তাৎক্ষণিকভাবে বিচারিক প্রক্রিয়ার আওতায় আনা জরুরী। এজন্য কাস্টম ইন্টেলিজেন্স সেলের মতো আলাদা একটি সার্ভিল্যান্স ইউনিট প্রতিষ্ঠা করার মাধ্যমে মনিটরিং কার্যক্রম জোরদার করা। স্থলবন্দরসমূহের সংযোগকারী সড়ক পথসমূহকে ( রেল ও সড়ক উভয়ই) ট্রাফিক যানজটমুক্ত রাখা যাতে আমদানি-রফতানিকৃত পচনশীল দ্রব্যাদি বা মালামাল পথে পচনের শিকার না হয়। গুদামজাতকরণের ক্ষেত্রে মালামাল হ্যান্ডলিংয়ে পর্যাপ্ত নজরদারির ব্যবস্থা করা। বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন ও কর্ম সম্পাদনের জন্য স্থলবন্দরসমূহে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নিয়োগের ক্ষেত্রে আরও স্বচ্ছতা ও সাবধানতা অবলম্বন করা। যাতে কোন যোগ্য ঠিকাদার কার্যাদেশ প্রাপ্তি হতে বঞ্চিত না হন, আবার কোন প্রতিষ্ঠান কেবল এলাকা ও স্বজনপ্রীতির ভিত্তিতে বছরের পর বছর কার্যাদেশপ্রাপ্ত হয়ে সিন্ডিকেশনের দোষে দুষ্ট না হয়। বিভিন্ন স্থলবন্দরের উন্নয়নমূলক কাজের টেন্ডার নিয়ন্ত্রণের সিন্ডিকেট ভাঙ্গার স্বার্থে এবং বাংলাদেশ স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের উন্নয়নমূলক সকল কাজের টেন্ডার প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা নিশ্চিতকল্পে ওপেন টেন্ডার প্রক্রিয়া ইজিপির মাধ্যমে সম্পাদন করা। যে সকল স্থলবন্দর হতে শুল্ক কম পরিমাণে আহরিত হচ্ছে সে সকল স্থলবন্দর চিহ্নিত করে এর পেছনে যে কারণ রয়েছে তা নির্ধারণপূর্বক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ। শুল্ক আদায়ে মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদার। আমদানিকৃত পণ্যের পরীক্ষণের সময় কাস্টমস কর্মকর্তাদের সঙ্গে বন্দরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার উপস্থিতি নিশ্চিত করা। বাংলাদেশ স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ আইন, ২০০১ এর ২১ ধারা অনুযায়ী বিধি প্রণয়ন ও ২২ ধারা অনুযায়ী প্রবিধান তৈরির নির্দেশনা/ সুযোগ থাকলেও অদ্যাবধি কোন বিধি বা প্রবিধান প্রণয়ন করা হয়নি। যা উক্ত প্রতিষ্ঠানে দুর্নীতির গ্রে-এরিয়া সৃষ্টি করছে এবং দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীগণ এ সুযোগটি গ্রহণ করছে। এজন্য জরুরী ভিত্তিতে এ সকল বিধি বা প্রবিধান প্রণয়ন করা। পর্যাপ্ত জনবলের ব্যবস্থা না থাকলে দুর্নীতি রোধ ও পর্যবেক্ষণ কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে চলমান রাখা সম্ভব নয় বিধায় বাংলাদেশ স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের অনুকূলে জনবল ও বাজেট দুটিই পর্যাপ্ত ও যৌক্তিক পর্যায়ে রাখা। বন্দরের কর্মকর্তা-কর্মচারী, ঠিকাদার, আনসার, সিকিউরিটি, সিএ্যান্ডএফ এজেন্টসহ যাদের বিরুদ্ধে উৎকোচ গ্রহণের অভিযোগ রয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগসমূহ পৃথকভাবে রেজিস্টারভুক্ত করে বিভাগীয় তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনা করা। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের উৎসাহিত করার জন্য ন্যাশনাল ইন্টেগ্রিটি স্ট্র্যাটেজিতে (এনআইএস) বর্ণিত সংশ্লিষ্ট স্ট্র্যাটেজির বাস্তবায়ন করা যেতে পারে অর্থাৎ বন্দরের যে সকল কর্মকর্তা-কর্মচারী সুনামের সঙ্গে জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করে যাচ্ছেন তাদের অবদান মূল্যায়নপূর্বক স্বীকৃতি প্রদান করা। যাতে তারা ভবিষ্যতেও এ ধরনের জনসেবা প্রদানে উৎসাহিত হন। একইসঙ্গে নবীন কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও এ আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে সর্বোত্তমভাবে জনসেবা প্রদানে সচেষ্ট হন। স্থলবন্দরসমূহে সিএ্যান্ডএফ এজেন্টসমূহের কার্যক্রম নজরদারি জোরদার করা প্রয়োজন। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ওপর তাদের প্রভাব হ্রাস করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা। জরুরী ভিত্তিতে বিএসবিকে-এর আওতাভুক্ত স্থলবন্দরসমূহের অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধি করা। স্থলবন্দরসমূহে পর্যাপ্ত গুদামজাতকরণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা। গুরুত্বপূর্ণ স্থলবন্দরসমূহের কাছাকাছি রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো কিংবা বিএসটিআই-এর মতো বৈদেশিক বাণিজ্য সংক্রান্ত প্রতিষ্ঠানসমূহের আঞ্চলিক কার্যালয়সমূহ স্থাপন করা, যেন রফতানিকারকগণ ক্লিয়ারেন্স সার্টিফিকেটসহ অন্য সরকারী সেবা সুলভ ও সহজ করা। বেনাপোল স্থলবন্দরের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার্থে একজন ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে নিয়মিত মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা। স্থলবন্দরসমূহে কর্মরত কর্মকর্তা/ কর্মচারীর জন্য প্রয়োজনীয় আবাসন, যানবাহন ও চিকিৎসাসেবার ব্যবস্থা রাখা। বেনাপোলসহ সকল স্থলবন্দরে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুত সরবরাহের ব্যবস্থা রাখা এবং বন্দরে নিজস্ব জেনারেটরের ব্যবস্থা রাখা এবং স্থলবন্দরসমূহে আধুনিক মানের ফায়ার হাইড্রেন্ট সিস্টেম স্থাপন এবং ফায়ার শাখায় দক্ষ জনবল বৃদ্ধি করার সুপারিশ করে দুদক। প্রতিবেদন দাখিলের পর সাংবাদিকদের কমিশনার ড. মোজাম্মেল হক খান বলেন, দুর্নীতিবাজ ধরার চেয়ে দুর্নীতি প্রতিরোধ করাই আমাদের মূল লক্ষ্য। আমরা ইতোমধ্যে ১৬টি মন্ত্রণালয়ের দুর্নীতি সংক্রান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেছি। প্রতিটি মন্ত্রণালয় এই প্রতিবেদনগুলো সাদরে গ্রহণ করেছে। এটি শুধু অনুসন্ধানী প্রতিবেদন নয়, এটি একটি দলিল। তিনি বলেন, নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীও আমাদের প্রতিবেদনটি সাদরে গ্রহণ করেছেন। আমাদের বিশ্বাস এই প্রতিবেদনটি আমলে নিয়ে তারা যদি আমাদের সুপারিশগুলোর সঙ্গে তাল মিলিয়ে কাজ করেন, তাহলে বাংলাদেশ থেকে দুর্নীতি দমন করা সম্ভব। এ প্রসঙ্গে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, আমরা দুদকের এই প্রতিবেদনটি সাদরে গ্রহণ করেছি। প্রধানমন্ত্রীর জিরো টলারেন্স নীতি নিয়ে কাজ করছি। দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ গড়া আমাদের একটি লক্ষ্য। তবে এটি একটি চ্যালেঞ্জও বটে। প্রতিমন্ত্রী বলেন, দুদকের প্রতিবেদনের সঙ্গে দ্বিমত করব না। কিছু কিছু ত্রুটি আছে তা স্বীকার করছি। স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ এককভাবে কাজ করে না। সেখানে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ, এনবিআর কর্তৃপক্ষ, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিজিবি কর্তৃপক্ষ, বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃপক্ষ এবং সরকারের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যদের সমন্বয়ে বন্দর কর্তৃপক্ষ কাজ করে। দুর্নীতি বন্ধে আমরা তৎপর। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী, প্রতিটি বন্দরকে অটোমেশনের আওতায় আনা হবে। ইতোমধ্যে বেনাপোল বন্দরকে এর আওতায় আনা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে বাকি বন্দরগুলো এর আওতায় আসবে। তিনি আরও বলেন, দুদকের অনুসন্ধানী এই প্রতিবেদনটি আমাদের কাছেও একটি দলিল।
×