ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

একুশের চেতনা বৃথা যেতে দেব না

প্রকাশিত: ০৯:২০, ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২০

একুশের চেতনা বৃথা যেতে দেব না

শিরোনামটি একটি জনপ্রিয় বাক্য। মর্মাহত একটি বাক্য। একটি অধিকারের বাক্য। বাংলা একটি ভাষার নাম। একটি চেতনার নাম। আর এই ভাষাকে কেন্দ্র করে বাংলায় ১৩৫৮, ইংরেজীতে ১৯৫২ সালে যে আন্দোলন হয়েছিল তাই ইতিহাসে ভাষা আন্দোলন নামে পরিচিত। বাংলা সারা বিশ্বের অহঙ্কার। কেননা পৃথিবীর ইতিহাসে বাঙালীরাই প্রথম ভাষার জন্য জীবন দিয়েছিল। তাই ৮ ফাল্গুন বা ২১ ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। তবে ভাষাকে নিয়ে ভাবার ইতিহাসটা আরও আগের। ১৯৪০ সালে পাকিস্তানের লাহোরে মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকা নিয়ে পৃথক রাষ্ট্র গঠনসহ বিভিন্ন দাবি আদায়ে একটি প্রস্তাব করা হয়, যা ইতিহাসে ‘লাহোর প্রস্তাব’ নামে খ্যাত। ১৯৪৭ সালে শুধু ধর্মকে প্রাধান্য দিয়ে ভারতীয় উপমহাদেশ স্বাধীন হয়। সৃষ্টি হয় ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি রাষ্ট্র। পাকিস্তানের আবার দুটি ভাগ ছিলÑ পূর্বে পূর্ব পাকিস্তান (বর্তমান বাংলাদেশ) আর পশ্চিমে পশ্চিম পাকিস্তান। পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টির পর থেকেই দুই পাকিস্তানের মধ্যে শুরু হয় দূরত্ব। পশ্চিম পাকিস্তানেই সকল উন্নতি সাধিত হয়। আর পূর্ব পাকিস্তান হতে থাকে অবহেলিত। পূর্ব পাকিস্তানে সকল দাবি-দাওয়া ভূলুণ্ঠিত করতে প্রথমেই তারা আঘাত হাতে ভাষার ওপর। ১৯৪৮ সালের ২৪ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে বিশেষ সমাবর্তন অনুষ্ঠানে পাকিস্তানের প্রথম গবর্নর জেনারেল কায়েদে আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ উর্দু এবং উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা বলে ঘোষণা করেন। সেই সময় উপস্থিত ছাত্ররা না, না, বলে প্রতিবাদ করে। এভাবেই চলতে থাকে মাতৃভাষার যুদ্ধ। ভাষা আন্দোলনের চূড়ান্ত রূপ নেয় ১৯৫২ সালে। ১৯৫২ সালের জানুয়ারি মাসে খাজা নাজিমুদ্দীন ঢাকায় আসেন। ২৭ জানুয়ারি পল্টন ময়দানে এক জনসভায় বলেন, পূর্ব পাকিস্তানের ভাষা কি হবে সেটা পূর্ব বাংলার জনগণই নির্ধারণ করবে। কিন্তু উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। এর প্রতিবাদে ৩০ জানুয়ারি ঢাকায় সাধারণ ধর্মঘট পালিত হয়। ৩১ জানুয়ারি গঠিত হয় ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা পরিষদ।’ ২১ ফেব্রুয়ারি প্রদেশব্যাপী ‘রাষ্ট্রভাষা দিবস’ পালনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। সেই দিবসের কর্মসূচীকে সফল করতে ৪ ফেব্রুয়ারি হরতাল এবং ১১ ও ১৩ ফেব্রুয়ারি পতাকা দিবস পালিত হয়। ’৫২ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা’ ও ‘বন্দী মুক্তি’ দাবিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও আওয়ামী লীগ নেতা মহিউদ্দিন আহম্মদ আমরণ অনশন ধর্মঘট শুরু করেন। তাঁরা আন্দোলন চালিয়ে যেতে বলেন। সকল ন্যায্য অধিকারের দাবিতে বাঙালীরা যখন ঐক্যবদ্ধ, তখন ২০ ফেব্রুয়ারি নুরুল আমিনের ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ সরকার ২০ ফেব্রুয়ারি থেকে ঢাকা শহরে ১ মাসের জন্য ১৪৪ ধারা জারি করে। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি বাংলায় ৮ ফাল্গুন মাতৃভাষা বাংলার দাবিতে ছাত্রনেতা গাজীউল হকের সভাপতিত্বে ছাত্র-জনতা মিছিল বের করে। সেদিন হাতে ছিল প্ল্যাকার্ড। মুখে ছিল স্লোগানÑ ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই।’ পুলিশ বেষ্টনী ভেদ করে অসংখ্য দলে বিভক্ত হয়ে ছাত্র-ছাত্রীরা শান্তিপূর্ণভাবে এগিয়ে যেতে থাকে পরিষদ ভবনের দিকে। শান্তিপূর্ণ মিছিলটি মেডিক্যাল কলেজের সামনে এলে পুলিশ সেদিনের সেই মিছিলে গুলিবর্ষণ করে। রাজপথে শহীদ হন জব্বার, শফিউর, রফিক, সালাম, বরকতসহ নাম না জানা আরও অনেকে। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, সেদিনের সেই ভাবনা, সেদিনের সেই চেতনা পরবর্তী সকল আন্দোলনে জুগিয়েছে প্রেরণা। ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট, ১৯৬৬-এর ছয় দফা, ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচন, সর্বোপরি ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ ও বিজয় সবই ভাষা আন্দোলনের ফসল। সেদিন যে বাঙালী জাতীয়তাবোধের সৃষ্টি হয়েছিল তা বাঙালীর সকল আন্দোলনে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল। আন্দোলন ছাড়া যে বিজয় হয় না তা ভাষা আন্দোলন থেকে শিখতে পেরেছিল। পাকিস্তানীরা যে পূর্ব বাংলার উন্নতি বা সমৃদ্ধি চায় না তা বোঝা গিয়েছিল ভাষা আন্দোলন থেকে। তাই বলা হয় ভাষা আন্দোলনের মাঝে স্বাধীনতার বীজ লুক্কায়িত ছিল। বাঙালীর অদম্য মনোবল দেখে, বাঙালীর ভাষার জন্য আন্দোলন দেখে ১৯৫৬ সালে পাকিস্তান সরকার বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়। ১৯৯৯ সালে ইউনেস্কো একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। আজ আমরা যে শহীদ মিনারে একত্রিত হয়, ফুল দেই সেটি উদ্বোধন হয়েছিল ২৪ ফেব্রুয়ারি মেডিক্যাল কলেজ হোস্টেল প্রাঙ্গণে। ভাবতে কষ্ট হয়, আজ আমরা যে মা, মা বলে প্রাণ জুড়াই, শিশুর মুখে হাসি ফোটে, সে ভাষাকে পেতে কতই না ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে রফিক-জব্বারদের। তাঁরা জীবন না দিলে আজ কোন্ ভাষায় মাকে ডাকতে হতো? আসলে কি মা বাবা বলে ডাকা কি এত মিষ্টি হতো? আসলে কি মা উর্দুতে বলে শান্তি পেতাম? মনে হয় না। ১৯৫২ সালের এই দিনে ভাষার জন্য রাজপথ রঞ্জিত করেছিলেন তাঁরা। তবে একটি দুঃখের বিষয় যে, বাংলা ভাষার জন্য জীবন দিলেন রফিক-শফিকসহ অনেকে, আমরা কিন্তু সেই বাংলা ভাষাকে কমই মনে রাখছি। আজ ১০০ জনকে বাংলা তারিখ বলতে বললে ৯৫ জনই পারবে না বলে মনে হয়। আজ একুশে ফেব্রুয়ারি বলছি, সেটা কোন্ ভাষা? ধরে নিলাম আন্তর্জাতিকতায় একুশে ফেব্রুয়ারি বলা হচ্ছে, তবে জাতীয় দিবসগুলো তো আমাদের নিজস্ব। কেন সেগুলোকে ইংরেজীতে প্রচলন করা হলো? আমরা কি বাংলাতে জনপ্রিয় করতে পারতাম না? বাংলাতে করলে কি মুখস্থ হতো না? ভেবে দেখা দরকার। ভেবে দেখা দরকার এই বাংলাকে কারা বিকৃত করছে? বাংলাকে বিকৃত করলে কষ্ট হবে ভাষা শহীদদের। বাংলা ভাষা সকলের অহঙ্কার, সকলের অলঙ্কার। ভাষার মাসে তাই ভাষা শহীদদের বিন¤্র শ্রদ্ধা জানাতে হবে সবাইকে। প্রতিটি কাজের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি থাকে, থাকে পটভূমি। সেই প্রেরণায় ভাষা আন্দোলনেরও পটভূমি ও প্রত্যাশা ছিল। তাই বাংলা ভাষার শুদ্ধ চর্চা হতে হবে। চাই বাংলার ব্যাপক ব্যবহার। আজকে দেশে ইংরেজী মাধ্যম স্কুল বেড়ে যাচ্ছে। তারা কি বাংলার ইতিহাস, তারা কি ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস জানবে? এ প্রশ্ন রাখতে চাই। ভাষা আন্দোলন থেকে অধিকার আদায়ের শিক্ষা নেই। ভালবাসার শিক্ষা নেই। দেশপ্রেমের শিক্ষা নেই। একত্রে পথ চলার শিক্ষা নেই। বাংলাকে ভালবাসি। বাংলা ভাষাকে সমৃদ্ধ ও সম্মান করি। লেখক : সাংবাদিক
×