ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

কোহলির এ কী হাল!

প্রকাশিত: ০৯:৩৭, ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২০

কোহলির এ কী হাল!

স্যার ডন ব্র্যাডম্যান থেকে ক্রিকেটঈশ্বর শচীন টেন্ডুলকর- প্রত্যেকের সঙ্গে তুলনা টানা হয় ভারত অধিনায়কের। মন খুলে বিরাট কোহলির প্রশংসা করেন ভিভ রিচার্ডস, ব্রায়ান লারার মতো গ্রেট। সেই কোহলিকেই বর্তমানে নির্বিষ-সঙ্কুচিত দেখাচ্ছে। ওয়েলিংটন টেস্টেও বদলায়নি ছবিটা। প্রথম ইনিংসে ২ রানের পর দ্বিতীয় ইনিংসে সাজঘরে ফিরেছন ১৯ রান করে। চলতি নিউজিল্যান্ড সফরে তিন ফরমেট মিলিয়ে এখনও পর্যন্ত ৯ ইনিংসে ভারত অধিনায়কের ঝুলিতে এসেছে মাত্র একটি হাফ সেঞ্চুরি। শেষ ২০ আন্তর্জাতিক ইনিংসে সেঞ্চুরির দেখা নেই! প্রশ্নটা তাই স্বাভাবিকভাবে উঠছে, ২০১৪ সালের পর এটাই কি কোহলির সবচেয়ে খারাপ সময়? ভারতীয় সুপারস্টার অবশ্য উদ্বীগ্ন নন, ‘আমি ভাল অবস্থায় আছি। ভাল শুরু করছি। কখনও কখনও এমন হয় যে ব্যাটিং ফর্মের বহির্প্রকাশ হয়ে দাঁড়াতে পারে না। মাঝে মাঝে পরিকল্পনা অনুযায়ী সবকিছু হয়ে ওঠে না। এটা বুঝতে হবে যে, একজন এতদিন ধরে খেলছে, তার কাছে ২-৩ ইনিংস চাওয়া মতো নাও হতে পারে। ফর্মের চেয়ে নিজে ভাল কন্ডিশনে থাকাটা জরুরী।’ বলেন তিনি। কোহলির পাশে দাঁড়িয়ে অনেকেই বলতে পারেন, হাফ সেঞ্চুরি বা সেঞ্চুরির সংখ্যা দিয়ে কোহলির প্রতীভা বিচার করা যায় না। কিন্তু আলোচনা যখন বিরাটের মতো ব্যাটসম্যাকে নিয়ে, তখন পরিসংখ্যান চলেই আসে। দীর্ঘ ১১ বছরের ক্যারিয়ারে এই নিয়ে দু’বার ১৯টি বা তার বেশি ইনিংসে সেঞ্চুরিবিহীন ভারত অধিনায়ক। ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এমন অফ ফর্মে ছিলেন তিনি। ২৪ ইনিংসে একটিও সেঞ্চুরি পাননি। তারপর ২০১৪’র ফেব্রুয়ারি থেকে অক্টোবরেও হোঁচট খায় কোহলির ব্যাট। ২৫ ইনিংসে শূন্য ছিল তার সেঞ্চুরির ঝুলি। সেবার ইংল্যান্ড সফরে পাঁচ টেস্টে কোহলির সংগ্রহ ছিল মাত্র ১৩৪ রান। এত গেল সেঞ্চুরির হিসেব। কোহলির হাফ সেঞ্চুরির খরাও যেন কাটতে চাইছে না। গত ২০ আন্তর্জাতিক ইনিংসে ৬ মাত্র হাফ সেঞ্চুরি করেছেন। ২০১১ ও ২০১৪-তে একইরকম পারফর্ম করেছিলেন কোহলি। কিন্তু রান না পাওয়ার চেয়ে ভারতীয় থিঙ্কট্যাঙ্করা বেশি চিন্তিত তার আউট হওয়ার ধরন নিয়ে। ২০১৪ সালে যেভাবে অফ স্টাম্পের সামান্য বাইরের বল ব্যাটের এজে লেগে স্লিপে ক্যাচ উঠত, ওয়েলিংটনের প্রথম ইনিংসেও টেলরের হাতে ক্যাচ তুলে প্যাভিলিয়নে ফেরেন তিনি। তাই ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে কবে কোহলি ফর্মে ফেরেন, এখন তারই অপেক্ষায় ভক্তকুল। তার জ্বলে ওঠার ওপর যে ভারতের সাফল্য অনেকাংশে নির্ভরশীল। এর আগে ৯ টেস্টের ৮টিতে জয়। র‌্যাঙ্কিংয়ের নাম্বার ওয়ান ভারত কার্যত উড়ছিল। সেই তারা চারদিনেই ওয়েলিংটন টেস্টে ১০ উইকেটে হারবে, এতটা হয়ত স্বাগতিক নিউজিল্যান্ডও ভাবেনি। ২০১৮ সালে অস্ট্রেলিয়া সফরের পার্থ টেস্টে হারের পর থেকেই টেস্টে অপরাজিত ছিল ভারত। ওয়েলিংটন এই টেস্টের আগে খেলা সর্বশেষ নয় টেস্টের আটটিতেই জয় পায় সুপার কোহলির দল। এর সর্বশেষ তিনটি আবার ইনিংস ব্যবধানে। কিন্তু সেই সব সুখস্মৃতি নিউজিল্যান্ডে এসে এক ফুৎকারেই উড়ে গেল। টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপে প্রথম হারের স্বাদ পাওয়া ভারত সর্বশেষ ২০১৩ সালের ডারবান টেস্টে দক্ষিণ আফ্রিকার কাছে এত বড় ব্যবধানে (১০ উইকেটে) হেরেছিল। ওই টেস্টের পর অবশ্য তিনটি টেস্টে ইনিংস ব্যবধানে হেরেছিল দলটি। টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপে প্রথম এমন তিক্ত অভিজ্ঞতার মুখোমুখি বিরাট কোহলিরও সময়টা ভাল যাচ্ছে না। মোড়লদের এমন জঘন্য পারফর্মেন্স নিয়ে চলছে সমালোচনা। তবে কোহলি বলেছেন, এক হারেই সবকিছু শেষ হয়ে যায়নি। নিউজিল্যান্ডে তার দল ঠিকই ঘুরে দাঁড়াবে, ‘আমাদের প্রথম কাজ হলো, বাইরের সব আওয়াজ থেকে নিজেদের সরিয়ে রাখা। সমালোচকেরা হয়ত বলবে এই হার মারাত্মক প্রভাব ফেলবে, আমরা হয়ত মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়ব। তাদের উদ্দেশে বলতে চাই, এক ম্যাচেই সবশেষ হয়ে যায়নি। আমরা বিশ্বের শীর্ষ দল, যে কোন পরিস্থিতিতে ঘুরে দাঁড়ানোর সামার্থ্য রাখি।’ শনিবার ক্রাইস্টচার্চে শুরু হবে কোহলিদের সিরিজ বাঁচানোর দ্বিতীয় ও শেষ টেস্ট। ভারত নিজেদের কৌশল থেকে কোনভাবেই বেরিয়ে আসবে না বলেও জানিয়েছেন কোহলি, ‘মানসিকভাবে কিছুটা খারাপ অবস্থা থেকে ঘুরে দাঁড়ানো সম্ভব। তবে আমরা এমন দল নই যে বাইরের সমালোচনায় বিচলিত হয়ে পড়ব। হ্যাঁ, ওয়েলিংটন টেস্ট থেকে অবশ্যই অনেক কিছু শেখার আছে।’ ক্রাইস্টচার্চেই ভারত স্বমহিমায় ফিরবে বলে জানিয়েছেন অধিনায়ক, ‘কোন সন্দেহ নেই আমরা পরের টেস্টেই জয়ের জন্য মাঠে নামব। সমান আগ্রাসী ক্রিকেট খেলব। স্ট্র্যাটেজি থেকে সরে আসার কোন প্রশ্নই নেই। ব্যাটিং, বোলিং কিংবা ফিল্ডিং ইউনিট হিসেবে যা যা করণীয়, সেই অনুযায়ী নিজেদের সেরাটা উজার করে দেব।’ ওয়েলিংটনে মাত্র ২ ও ১৯ রানে আউট হন কোহলি, ‘আমরা জানি জিততে হলে ভাল খেলতে হবে। সেটা ঘরের মাঠে কিংবা বিদেশে। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অনায়াস বলে কিছু নেই। সব দলই জয়ের জন্য মাঠে নামে। এটা মেনে নিতে হবে। আর সেটার ওপরই আপনার চারিত্রিক দৃঢ়তা নির্ভর করে। পরাজয় মেনে নেয়ার মধ্যে কোন লজ্জা নেই। এর অর্থ হলো আমরা নিজেদের সেরাটা দিতে পারিনি। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে আমরা রাতারাতি জঘন্য হয়ে গেলাম।’ ব্যক্তিগত ব্যর্থতার মাঝেও অবশ্য ভারতীয় ক্রিকেটের ওয়ান্ডার বয় একটি ব্যক্তিগত মাইলক পেরিয়ে গেছেন। টেস্টে দেশের হয়ে সর্বোচ্চ রান সংগ্রহের তালিকায় গ্রেট সৌরভ গাঙ্গুলীকে পেছনে ফেলেছেন কোহলি। ১১৩ টেস্টে সৌরভের সংগ্রহ ৭২১২ রান। ৮৫ টেস্ট খেলার পরে কোহলির ঝুলিতে ৭২২১ রান। প্রথম তিনজন যথাক্রমে শচীন টেন্ডুলকর (১৫৯২১), রাহুল দ্রাবিড় (১৩২৬৫) এবং সুনীল গাভাস্কার (১০১২২)। আর ভারতের হয়ে টেস্ট, ওয়ানডে ও টি২০ তিন ফরমেট মিলিয়ে রান সংগ্রহে তৃতীয় স্থানে বর্তমান অধিনায়ক। ৪১৫ ম্যাচে কোহলির রান ২১৮৭৭। শীর্ষে থাকা শচীন ৬৬৪ ম্যাচে করেছেন ৩৪৩৫৭। ৫০৪ আন্তর্জাতিক ম্যাচে ২৪০৬৪ রান নিয়ে রাহুল আছেন তার পেছনে। আকাশে উড়তে থাকা ভারতকে অবশ্য টেস্ট শুরুর আগেই মাটিতে নামিয়ে এনেছিল নিউজিল্যান্ড। তিন ওয়ানডের সিরিজে কোহলিদের ৩-০ ব্যবধানে হোয়াইটওয়াশ করে কিউইরা। ১৯৮৮-৮৯ মৌসুমের পর দীর্ঘ ৩১ বছরে এই প্রথম তিন বা তার বেশি ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজে হোয়াইটওয়াশ হয় ভারত! অথচ নিউজিল্যান্ডে এবার ভারতের শুরুটা ছিল স্বপ্নের মতো। টি২০ ইতিহাসে পাঁচ ম্যাচের কোন সিরিজে প্রতিপক্ষকে ৫-০’তে হোয়াইটওয়াশ করে ইতিহাস গড়ে কোহলি বাহিনী। যদিও দুটির ফয়সালা হয়েছিল সুপার ওভারে। মুদ্রার উল্টো পিঠ দেখতে মোড়লদের সময় লাগেনি। ওয়ানডেতে সেই ধারা ধরে রাখতে পারেনি তারা। গত বছর বিশ্বকাপের সেমিফফাইনালে যে নিউজিল্যান্ডের কাছে হেরে স্বপ্নভঙ্গ হয়েছিল, পঞ্চাশ ওভারের দ্বৈরথে সেই তাদের কাছে হোয়াইটওয়াশ। ৩১ বছর পর কোন ওয়ানডে সিরিজে সব ম্যাচ হারল ভারত। ১৯৮৮-৮৯ মৌসুমে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে ৫-০ ব্যবধানে হেরেছিল তারা। ২০০৬-০৭ মৌসুমে দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে অবশ্য ৪-০ ব্যবধানে সিরিজ হেরেছিল তারা, সেবার একটি ম্যাচ ভেসে যায় বৃষ্টিতে। সেই ম্যাচে অবশ্য টসও সম্ভব হয়নি। এছাড়া ২০১৪ সালে এই নিউজিল্যান্ডে ৫ ম্যাচের সিরিজ হেরেছিল ৪-০ ব্যবধানে, অন্যটি হয়েছিল টাই। ওয়ানডেতে ৩-০ ব্যবধানে হোয়াইটওয়াশ হওয়ার পর ওয়েলিংটনে প্রথম টেস্টে এভাবে বিধ্বস্ত কোহলিদের নিয়ে ভক্তদের শঙ্কা তৈরি হওয়া স্বাভাবিক।
×