ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মিলু শামস

জঙ্গীবাদ এবং

প্রকাশিত: ০৯:১৫, ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২০

জঙ্গীবাদ এবং

নোবেল বিজয়ী মিসরীয় লেখক নাগিব মাহফুজ জঙ্গী হামলার শিকার হয়েছিলেন গত শতকের নব্বই দশকে। মৌলবাদী খড়গ্ তার প্রাণ কেড়ে নিতে না পারলেও ডান হাতে আঘাতের কারণে তিনি হারিয়েছিলেন লেখার ক্ষমতা। তার পরবর্তী লেখালেখির কাজ চলেছে অনুলিখনের মাধ্যমে। যে তাকে ছুরিকাঘাত করেছিল ধরা পড়ার পর তাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, নাগিব মাহফুজের লেখা পড়েই সে ক্রুদ্ধ ও উত্তেজিত হয়ে আঘাত করেছিল কিনা। সে জানিয়েছিল, মাহফুজের কোন লেখাই সে পড়েনি। সে বিষয়ে কোন ধারণাই তার নেই, তার উত্তেজনার কারণ ধর্মীয় নেতাদের অনর্গল বক্তৃতা। ক্রমাগত ওসব শুনেই সে হিংস্র হয়ে উঠেছে, উত্তেজিত ও আঘাত করেছে। এদের ব্রেনওয়াশ হয়েছে জঙ্গীবাদী ‘যন্তর মন্তরে’। এই ব্রেনওয়াশের কাজ নানা রূপে নানা নামে পৃথিবীজুড়ে চলছে। বাংলাদেশেও এর একটি ধারা বহমান রয়েছে। এদেশে মৌলবাদী রাজনৈতিক দল মূল পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছে স্বৈরাচারী সামরিক সরকারের সময়। তবে গণতান্ত্রিক সরকারের সময়ও তারা তা পেয়েছে এবং পাচ্ছে। যারা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করে এবং মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর নৃশংস অত্যাচার করেও স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম ঠেকাতে পারেনি অন্য সব রাজনৈতিক দলের পাশাপাশি তারাও এ দেশে রাজনীতি করার সমানাধিকার পেয়েছে এবং ধীরে ধীরে রাজনীতিতে এর প্রভাব স্পষ্ট হয়েছে। প্রথমে সংবিধান থেকে উধাও হলো ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ শব্দটি। পরের সামরিক সরকার সংবিধানকে আরেকটু ধর্মীয়করণ করে তাদের বিচরণকে আরও স্বচ্ছন্দ্য করে দিল। পাকিস্তান, সৌদি আরব ও অন্যান্য সহযোগী দেশ থেকে তাদের জন্য অর্থ সাহায্য আসার সোনালি দিগন্ত খুলে গিয়েছিল মূলত সামরিক শাসকদের সময় থেকেই। শুধু সাংগঠনিকভাবে নয়, প্রাতিষ্ঠানিকভাবেও এরা শক্তিশালী হয়েছে। ব্যাংক, বীমা, হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ইত্যাদির মাধ্যমে একদিকে সমাজের মূল¯্রােতে মিশে গেছে; অন্যদিকে সন্ত্রাসী কার্যক্রম দিয়ে মাঝে মাঝে ঝলসে উঠে আতঙ্ক ছড়িয়েছে। সুবিধাভোগী বুদ্ধিজীবী বা সুশীলরাও নিজেদের সুবিধা বুঝে নিতে ব্যস্ত থেকেছেন। একদিকে প্রকাশ্য রাজনীতি করার আইনী অধিকার, অন্যদিকে সামাজিকভাবে মিশে যাওয়ার সাংস্কৃতিক অভিঘাতের মধ্যে বেড়ে উঠেছে গোটা একটি প্রজন্ম; পরিণত হয়েছে। এদের অনেকে ইসলামী ভাবধারা বা জিহাদের প্রতি সহানুভূতিশীল শুধু ধর্মীয় দুর্বলতার কারণে। একই কারণে হিজাবের আধিপত্য বেড়েছে। আন্তর্জাতিকভাবে ইসলামী জঙ্গীবাদের উত্থান এর পেছনে বড় ভূমিকা রেখেছে। আশির দশকে তৃতীয় বিশ্বে সামরিকতন্ত্রের যে উত্থান হয়েছিল তা ছিল দুর্বল দেশগুলোকে গিনিপিগ বানিয়ে সা¤্রাজ্যবাদী উদ্দেশ্য পূরণের অন্য এক কৌশল। একই উদ্দেশ্যে আন্তর্জাতিকভাবে ধর্মীয় মৌলবাদী জঙ্গীগোষ্ঠীকে পরিপোষণ করা হয়েছে। ইসলামের শান্তি, সাম্য ও প্রগতিশীলতার ধারাকে কোণঠাসা করে রাখা হয়েছে। এ উপমহাদেশে একে গতিশীল করেছিলেন উত্তর ভারতের রায়বেরেলির সৈয়দ আহমদ নামে এক মৌলবাদী নেতা। উনিশ শতকের শুরুর দিকে তার আবির্ভাব। তিনি ইসলামী রাজত্ব পুনর্প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু যে পথে এগোচ্ছিলেন ব্রিটিশ ভারতের সে সময়ের বাস্তবতায় তা যে অসম্ভব তা অল্প দিনেই বুঝেছিলেন। তার আন্দোলন শেষ পর্যন্ত সাম্প্রদায়িকতার মধ্যেই পথ খুঁজেছে। ধর্মীয় আন্দোলন সম্পর্কে আধুনিক উপলব্ধি নিয়ে উত্তর ভারত থেকেই এসেছিলেন আরেকজনÑ সৈয়দ আহমদ খান। আর পশ্চিম বাংলা থেকে সৈয়দ আমির আলী। ইংরেজী শিক্ষিত এ দুই নেতা সংস্কারমুক্ত মন নিয়ে উদার যুক্তিবাদী চিন্তা দিয়ে ইসলামের ব্যাখ্যা করেছেন। আমির আলী মুক্ত মন নিয়ে কোরান পাঠ করার কথা বলেছেন, তার মূল বক্তব্য ছিল জ্ঞানের চর্চা ছাড়া কোন সংস্কার সম্ভব নয়। মানুষের মনকে শৃঙ্খল মুক্ত করতে হলে সেখানে জ্ঞানের আলো প্রবেশ করাতে হবে। সৈয়দ আমির আলী মাদ্রাসা শিক্ষার বিরোধী ছিলেন। মনে করতেন এ ব্যবস্থা একেবারেই পশ্চাৎমুখী এবং মনকে আলোকিত করতে অক্ষম। তিনি মাদ্রাসা তুলে দিয়ে ইংরেজী ও কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার পক্ষপাতি ছিলেন। সৈয়দ আহমদ খান, সৈয়দ আমির আলীর পথ ধরে এসেছিলেন আরও কয়েকজন উদার ও মুক্তবুদ্ধির ইসলামী চিন্তাবিদ। কিন্তু ইসলামের উদার ধারার বদলে সারা পৃথিবীতে এখন রাজত্ব করছে উগ্রধর্মীয় জঙ্গীবাদ যা ইসলামের সমন্বয়ধর্মী ও মানবতাবাদী সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে প্রায় ভুলিয়ে দিয়েছে। সাতচল্লিশে ভারত ভাগের পর সে সময়ে বিশ্বের দুই পরাশক্তির প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এ অঞ্চলের রাজনীতিতেও মেরুকরণ হয়েছে। সোভিয়েত ইউনিয়ন যাতে প্রভাব বিস্তার করতে না পারে যুক্তরাষ্ট্র সে জন্য পূর্ব পরিকল্পিতভাবেই পাকিস্তানের ইসলামী সামরিক সরকারকে সমর্থন দিয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করে স্বাধীনতাবিরোধীদের সমর্থন দিয়েছে। কিন্তু সব বিরোধিতা উপেক্ষা করে ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শ নিয়ে এদেশ স্বাধীন হয়। গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং জাতীয়তাবাদকে ভিত্তি করে সংবিধান রচিত হয়। কিন্তু কয়েক বছরের মধ্যেই এদেশ প্রতিষ্ঠার যারা বিরোধিতা করেছিল নানা কূটকৌশলে তারাই শাসন ক্ষমতার অংশীদার হয়। ধর্মতন্ত্রী মৌলবাদ শেকড় গাড়তে থাকে। রগকাটা, কুপিয়ে মারার সংস্কৃতি বিস্তার লাভ করে। কখনোই কি নির্মূল হয়েছিল এরা? রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতায়ই টিকে থাকে। রাষ্ট্রের প্রয়োজনেই মাথাচাড়া দেয়। ইসলামের ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, আব্বাসীয় আমলে মুসলমানরা জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় অসাধারণ উৎকর্ষ অর্জন করে দর্শন বিজ্ঞান ইতিহাস চিকিৎসা শাস্ত্র অঙ্ক জ্যোতির্বিজ্ঞান সমাজতত্ত্ব ইত্যাদি সব বিষয়ে মৌলিক অবদান রেখেছিলেন। তাদের অর্জিত জ্ঞানে প্রভাবিত হয়ে গ্রীকদের জ্ঞানচর্চা নতুনভাবে শুরু হয়। জ্ঞান-বিজ্ঞানে আরবদের এ উৎকর্ষ মাদ্রাসা শিক্ষার মাধ্যমে হয়নি। কারণ মাদ্রাসায় ধর্মীয় শিক্ষার বাইরে অন্য কোন জ্ঞানচর্চার সুযোগ ছিল না। ইসলামের ইতিহাসে প্রথম যে মাদ্রাসার উল্লেখ পাওয়া যায় তার নাম মাদ্রাসা সাফ্ফা। এটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন হয়রত মুহাম্মদ (স)। এখানে স্বাভাবিকভাবেই কোরান পড়ানো হতো মুখে মুখে। কারণ সে সময় পর্যন্ত কোরান শরীফ লিখিত রূপ পায়নি। হযরত মুহাম্মদ (স) এর মৃত্যুর দু’দশক পর কোরানের আয়াতগুলো সঙ্কলিত হলেও তাঁর সময়ে মুখে মুখে কোরান পড়ানোর যে পদ্ধতি চালু ছিল সে ধারা আজও চলছে। মাদ্রাসা সাফ্ফায় কোরানের তাফসির ও ফিকাহ্ শেখানো হতো। মাদ্রাসা শিক্ষাকে আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের সমপর্যায়ে আনার উদ্যোগ নিয়েছিলেন তৈমুর লঙের বংশধর উলুঘ বেক। চৌদ্দ শ’ বিশ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন সমরখন্দের সবচেয়ে বড় উলুঘ বেক মাদ্রাসা। সেখানে মাদ্রাসার প্রথাগত শিক্ষার সঙ্গে গণিত, দর্শন, জ্যোতির্বিজ্ঞান ইত্যাদি শিক্ষার ব্যবস্থা করেছিলেন। তৈমুর লঙের পৌত্র উলুঘ বেক নিজে গণিত ও জ্যোতির্বিজ্ঞানের প-িত ছিলেন। ওই মাদ্রাসায় তিনিও পড়াতেন। সমরখন্দে তিনি একটি জ্যোতির্বিজ্ঞান পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রও প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এবং কোপারনিকাসের আগে নিজের আবিষ্কার করা টেলিস্কোপে অনেক নতুন তারার অস্তিত্ব খুঁজে বের করেছিলেন। কিন্তু তার এ আধুনিক চিন্তা ভাবনা ও বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির ঘোরবিরোধী ছিলেন প্রথাগত মাদ্রাসার মোল্লারা। কারণ তাদের আশঙ্কা ছিল, মাদ্রাসা শিক্ষা আধুনিকতায় আলোকিত হলে তাদের অস্তিত্ব বিপন্ন হবে। তারা উলুঘ বেকের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে নামেন এবং এক পর্যায়ে তাঁর শিরñেদের ব্যবস্থা করেন। সমরখন্দের ভাইস রয় এবং পরে মধ্যএশীয় অঞ্চলের আমির উলুঘ বেক যথেষ্ট শক্তিশালী ও প্রভাবশালী হওয়ার পরও মুক্ত জ্ঞান চর্চার অপরাধে প্রাণ হারিয়েছিলেন কূপমণ্ডুক মোল্লাদের হাতে।
×