ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

গণতন্ত্রের আশা ভরসা

প্রকাশিত: ০৯:৩৭, ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২০

 গণতন্ত্রের আশা ভরসা

গণতন্ত্রের মূল কান্ডারি আসলে কারা? রাজনীতিবিদ না নির্বাচন কমিশন না জনগণ? যারা গণতন্ত্র নামের এই ব্যবস্থা চালু করেছিলেন, তাঁরা এর সংজ্ঞা দিয়েছেন। যেমন, আব্রাহাম লিঙ্কনের সেই বিখ্যাত উক্তি of the people, by the people for the people. এর মানে পরিষ্কার। মানুষের, মানুষের দ্বারা এবং মানুষের জন্য। তিন, তিনবার মানুষ শব্দটি যোগ হয়েছে। যার অর্থ একটাই- গণতন্ত্র মানে মানুষ বা জনগণ। কিন্তু আমাদের দেশে কি হচ্ছে? সম্প্রতি ঢাকা মানে রাজধানীতে দু/দু’জন মেয়র নির্বাচিত হয়ে গেলেন। তারিখ নিয়ে ঝুটঝামেলার পর তারিখ ছিল ভাষার মাসের প্রথম দিনটি। নির্বাচনের পর ফলাফল বা হারজিত নিয়ে যে আগ্রহ, তার বেশি দেখলাম ভোটারদের অনুপস্থিতি নিয়ে। কি সাংঘাতিক সব পরিসংখ্যান। গোড়াতেই একটা কথা বলি। আমি গত ২৩ বছর যে দেশে আছি সেখানে ভোট বাধ্যতামূলক। নাগরিকত্ব গ্রহণের আগে জানতাম না। পরে জেনেছি আপনার কাছে নীল ক্যাঙ্গারু“মার্কা পাসপোর্ট আছে আর আপনি ভোটের দিন কেন্দ্রে যাননি- এটা হতেই পারে না। দু-একদিনের ভেতর বেশ ভাল অঙ্কের একখানা জরিমানাপত্র হাজির হবে বাড়িতে এবং তা না দেয়ার মতো কোন মামা-চাচার জন্ম হয়নি এদেশে। অবশ্যই এর ব্যতিক্রম আছে। যদি আপনি গুরুতর অসুস্থ হন বা কোথাও দেশের বাইরে থাকেন, এসব কারণে আপনাকে মাফ করা হবে। তাই ভোট প্রদানের হারও তেমন। আরও একটা চমৎকার বিষয় হলো, আপনি একক কোন দলকে এগিয়ে রাখতে পারেন বটে, তবে সবাইকে টিক দিতে হবে। আপনি নৌকার সমর্থক হলে তাদের ১ নম্বরে রাখবেন। বাকিদেরও টিক দিতে দিতে, যাদের চান না তাদের পাশে শেষ নম্বরটি জুড়ে দেবেন। কিন্তু অবহেলা চলবে না। এসব আমাদের দেশে অসম্ভব। এখনও আমরা সে জায়গায় পৌঁছিনি। কোনকালে পৌঁছাব বলেও মনে করি না। কারণ আমাদের গোড়ায় গলদ। আমাদের মূল জায়গায় গন্ডগোল। যে জাতি তার জন্ম পিতা কিংবা জন্মের ইতিহাস মানে না, তাকে এমন সুযোগ দেয়া যায়? আবার যারা মানুষের ভোটাধিকারের চাইতে রাতেই বাক্স ভরে ফেলে, তাদেরইবা বিশ্বাস কি? ফলে আমাদের দেখার বিষয় জনগণের অংশগ্রহণ। এবারের মেয়র নির্বাচনে ছিল সেদিক থেকে হতাশাজনক। ঢাকার দুটি সিটি কর্পোরেশনে মোট ভোটার সংখ্যা ৫৪ লাখের বেশি। কিন্তু নির্বাচনের দিন ভোটকেন্দ্রে দেখা গেছে খুব কম লোককেই। নির্বাচন কমিশন বলছে, ভোট পড়েছে ৩০ শতাংশেরও কম। এর কারণ কি? অথচ প্রচারের কমতি ছিল না। একটা জিনিস খেয়াল করবেন, বড় দুই দলেরই প্রচারে কিন্তু প্রচুর মানুষের অংশগ্রহণ ছিল। পাড়ায় পাড়ায় পোস্টারের ছড়াছড়ি ছিল। কেউ কিন্তু কারও পোস্টার ছিঁড়ে ফেলেনি। তার পরও ভোট দিতে তারা এলো না। ভোটব্যাংক যাদের ছিল, পার্টিগুলোর সেই ভোটাররা কেন এলো না? এটা সত্যি গবেষণার দাবি রাখে। এই হলো পরিবেশ। কিন্তু কেন? আমরা সবাই জানি, এর আগের ভোটগুলো নিয়ে মানুষের সন্দেহ আর আবেগ ছিল ভিন্ন। তাদের আবেগ যেমন মাঠে মারা গিয়েছিল, তেমনি নানা জায়গায় দিনের ভোট রাতেই বাক্সে ভর্তি এমন গুজবে ছিল দেশ মাতোয়ারা। সন্দেহ নেই এর প্রভাব আমরা দেখেছি। বিএনপি কোথায় কোথায় হারতে পারে তার একটা সমীকরণ সবার ছিল। কিন্তু তাদের বাঘা বাঘা নেতাদের জামানত বাজেয়াফত হওয়ার ঘটনা একটু বেশি। এসব কারণের পাশাপাশি একমুখিতা মানুষকে নিশ্চয়ই ক্লান্ত করে তুলেছে। ওপার বাংলার কথা মনে রাখব আমরা। তিরিশ বছরের বেশি এমন একতরফা রাজত্ব করেছিল সিপিএম। সেই কমিউনিস্ট পার্টি জ্যোতি বসু ও বুদ্ধদেবের পর এখন বলতে গেলে এতিম। বাংলাদেশে এখনও সে পরিস্থিতি তৈরি হয়নি। তবে সাবধানতার মার নেই। মনে রাখতে হবে আগে মানুষ ভোটকে উৎসব মনে করত। বলা হতো ভোট উৎসব। সে উৎসব এখন ভয়, আতঙ্ক কিংবা নৈরাশ্যের প্রতীক। এই জায়গাটা সরকারের সবল ও বলিষ্ঠ ভাবমূর্তির অন্তরায়। সবাই মানেন দেশ এগোচ্ছে। দেশের মানুষের দুঃখ-দারিদ্র্য লাঘব হচ্ছে। মানুষ আগের চেয়ে অনেক ভাল আছে। কিন্তু তার সামাজিক ও রাষ্ট্রিক অধিকারগুলোও বিবেচনার দরকার বৈকি। ভোট যদি ঠিকমতো না হয় বা মানুষ যদি ভোটবিমুখ হয়, সবচেয়ে লোকসান রাজনৈতিক দলের। বিশেষত যাদের ভিত্তি জনগণের হৃদয়মন। সেখানে বিএনপির চাইতে আওয়ামী লীগ এগিয়ে। তারা জনগণের দল। রাজপথে তাদের যে সাহস ও সংগ্রাম, তার কাছে বিএনপি শিশু। তাই দুর্দিনে দলটি দিন দিন হীনবল আর নেই হয়ে পড়ছে। আর আওয়ামী লীগ মানেই সাহস। তাই তাদের আমলে ভোটের এই দুর্গতি মূলত তাদের জন্যই খারাপ। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে তাদের যে উদ্ভাস, তার স্বার্থেই নির্বাচনকে জনবিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে হবে। এটা সরকারী দলের নেতারাও মানছেন। তাদের নেতারা স্বীকার করেছেন, এত কম ভোটারের উপস্থিতি ভয় ও আশঙ্কার। আসলেই তা। কারণ এতে মানুষ ক্রমাগত রাজনীতিবিমুখ হয়ে পড়ছে। চলে যাচ্ছে বিশ্বাস বা আস্থা। এর ফাঁকে কারা বেড়ে ওঠে, কারা সুযোগ পায় তা আমরা জিয়াউর রহমান, এরশাদ থেকে ওয়ান ইলেভেনের সময় দেখেছি। ফলে এখনই সময়। মানুষ এখনও ভোট চায়। চায় বলেই ঘরে ঘরে এত আলোচনা, এত উত্তেজনা। আর এদিক থেকে মিডিয়ারও দায় আছে। তারা এখন মন ভোলানো কথা ছাড়া আর কিছু বলে না। এতে সাময়িক লাভ হলেও মিডিয়ার যে দায়িত্ব তা পালন করা হয় না। হয় না বলেই মানুষ চ্যানেল বা মিডিয়ার নাম শুনলেই বলে দিতে পারেন, কারা কি লিখবে বা বলবে। আমাদের এসব ভ্রান্তি থেকে বেরুতে হবে। এটা জরুরী। নিরাপত্তার বিষয়টি ভুললে চলবে না। ছোটখাটো রিগিং আর বড় বড় জালিয়াতি ভিন্ন। মানুষের মনে নিরাপত্তাবোধ তৈরি করা জরুরী। এ কাজ রাজনীতির। ইভিএমের মতো একটি আধুনিক পদ্ধতি কেন প্রশ্নের মুখোমুখি হবে? কেন মানুষ তাতে ভরসা রাখতে পারবে না? আমরা আশা করব, আগামী দিনের নির্বাচনে এই সংশয় ও হতাশা দূর হবে। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার সরকার এই সমস্যার সমাধান করে আরও একবার স্বচ্ছতা আর জবাবদিহির প্রমাণ দেবে। এটা না হলে দেশের গণতন্ত্র কিছুতেই মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না। যার জের টানতে হতে পারে দীর্ঘ সময়। [email protected]
×