ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ফনিন্দ্র সরকার

পিলখানা হত্যাকান্ড ॥ পরাজিত শত্রুর ষড়যন্ত্র

প্রকাশিত: ০৯:৩৫, ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২০

পিলখানা হত্যাকান্ড ॥ পরাজিত শত্রুর ষড়যন্ত্র

আজ ২৫ ফেব্রুয়ারি পিলখানা হত্যাকান্ডের ১১ বছর। ২০০৯ সালে বিডিআর বিদ্রোহের নামে পৈশাচিক হত্যাযজ্ঞ সংগঠিত হয়েছিল পিলখানায়। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে আরও একটি কালোদিন হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে ২৫ ফেব্রুয়ারি। এই দিনটি উপস্থিত হলেই সেদিনের মর্মান্তিক ঘটনা মনে করিয়ে দেয় স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীরা কত ভয়ঙ্কর। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা লাভের সময় বাঙালী জাতির মধ্যে কতই না উচ্চমান ভাব ছিল। আমাদের মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে স্বাধীনতা অর্জনে ৩০ লাখ লোক শহীদ হন এবং কয়েক লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমহানি ঘটে। সদ্য স্বাধীন সার্বভৌম দেশের শাসনভার গ্রহণ করে জাতির পিতা দেশবাসীর উদ্দেশে আবেগতাড়িত কণ্ঠে পরাধীনতার গ্লানি মুছে ফেলার আহ্বান জানান। ‘চলো আমরা ওপরে উঠি, আর নিচে নামা নয়’। আমরা যেন দেশকে, আমাদের দেশের দুর্বলতর মানুষকে ভালবাসতে শিখি ও পূর্ণ উদ্যমে তাদের সেবা করি। এমন মহান বার্তা দিয়ে তিনি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটিকে গড়ে তোলার কাজে হাত দেন। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর আমরা বিজয় অর্জন করি। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি মহানায়কের পাকিস্তানের কারাগার থেকে লন্ডন-দিল্লী হয়ে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন ঘটে। তাঁর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনে যেন মহতী শক্তি বিকশিত হয়। তিনি স্বাধীন স্বদেশ বাংলাদেশে-ভালবাসা-করুণা, সহনশীলতা ও মমত্ববোধের এক প্রবাহ ধারা সৃষ্টিতে মনযোগী হয়ে দেশ সেবায় আত্মনিয়োগ করেন জনগণকে সঙ্গে নিয়ে। কিন্তু পরাজিত শত্রুরা বঙ্গবন্ধুর এই উদারতাকে দুর্বলতা ভেবে সুযোগ খুঁজতে কীভাবে স্বাধীনতার অর্জনের সাফল্যকে ধ্বংস করে দেয়া যায়। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট তাদের ষড়যন্ত্র সফল হয়। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে শত্রুরা মসনদে বসে। ভূ-লুণ্ঠিত হয় বাঙালীর সমস্ত অর্জন। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে তারা জাতিসত্তাকেই ধ্বংস করে দেয়। বাংলাদেশ শাসিত হতে থাকে পাকিস্তানী ভাবধারায়। নব্যপাকিস্তানের রূপান্তর ঘটে। আমাদের সৌভাগ্য বিদেশে অবস্থানের কারণে বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা বেঁচে যান। রাজনৈতিক নানা ঘটনাপ্রবাহের মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনা দেশে ফিরে আওয়ামী লীগের হাল ধরেন। ১৯৯৬ সালে ১২ জুনের নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ ২১ বছর পর ক্ষমতায় ফিরে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশ আবার জেগে ওঠে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পুনর্প্রতিষ্ঠায় শেখ হাসিনা রাত-দিন পরিশ্রম করেন। তিনি ন্যায়ভিত্তিক শাসন ব্যবস্থার আলোকে দেশ পরিচালনা করেন। এরপর ২০০১ সালের ১ অক্টোবরের একটি ষড়যন্ত্রের নির্বাচনে ষড়যন্ত্রকারী পরাজিতরা ভয়ঙ্কর শক্তি নিয়ে ক্ষমতায় ফিরে আবার। দেশে আবারও শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধবিরোধী কর্মকান্ড। ’৭১-এর চিহ্নিত দেশ বিরোধীদেরও মন্ত্রী করেন খালেদা জিয়া। মূলত বিএনপি নামক সংগঠনটিই পাকিস্তানপন্থী-মুক্তিযুদ্ধবিরোধী একটি প্ল্যাটফর্ম। ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোটের শাসনের ৫ বছর ছিল রাজনৈতিক মহাদুর্যোগের কাল। সন্ত্রাসবাদ ও জঙ্গীবাদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছিল বাংলাদেশ। শেখ হাসিনাকে হত্যার ষড়যন্ত্র হয়েছে বহুবার। ২০১৪ সালে ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে আওয়ামী লীগের সমাবেশে শেখ হাসিনাসহ শীর্ষ নেতাদের হত্যার উদ্দেশ্যে গ্রেনেড হামলা করা হয়েছিল। সৌভাগ্যক্রমে শেখ হাসিনাসহ শীর্ষ নেতারা বেঁচে গেলেও আইভি রহমানসহ ২৪ জন নেতাকর্মী নিহত ও শতাধিক আহত হন সেই হামলায়। তাই ২১ আগস্টও একটি কালোদিন হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে জাতির জীবনে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে তীব্র আন্দোলন গড়ে ওঠে। বিএনপি-জামায়াত জোটের শাসনের অবসান ঘটে এবং সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ২ বছর ক্ষমতায় থেকে ২০০৮ সালে ২৯ ডিসেম্বর একটি অবাধ সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন দেয়। সেই নির্বাচনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মহাজোট বিপুল সংখ্যাগড়িষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় আসে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের বয়স তখন মাত্র দেড় মাস। কোন কিছু গুছিয়ে ওঠার আগেই ঘটে যায় পিলখানা হত্যাযজ্ঞ। তদানীন্তন বিডিআর বাহিনীর বাৎসরিক সম্মেলন উপলক্ষে ঢাকার পিলখানায় চলছিল উৎসবের আয়োজন। বিডিআরের উর্ধতন কর্মকর্তারা সেনাবাহিনীর সদস্য। এটাই প্রচলিত নিয়ম। সেনা অফিসার-সাধারণ জোয়ানদের মধ্যে একটা বিভাজন রেখা টেনে দিয়ে উত্তেজনাকর পরিস্থিতি তৈরি করে পরাজিতরা। স্বাধীনতাবিরোধী যে গোষ্ঠী ক্ষমতায় আসতে পারেনি তাদেরই সুগভীর চক্রান্তের নীলনক্সা হিসেবেই বিডিআর বিদ্রোহের অবতারণা করা হয়। বিদ্রোহে ৫৮ জন মেধাবী চৌকস সেনা অফিসারকে হত্যা করা হয় নির্মমভাবে। বিডিআরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল শাকিলকে সপরিবারে হত্যা করা হয় নৃশংসভাবে। তছনছ করে দেয়ার চেষ্টা হয় একটি সু-শৃঙ্খল বাহিনীকে। সেদিনের বিদ্রোহের পেছনে মূল উদ্দেশ্য ছিল শেখ হাসিনার সরকারকে উৎখাত করা। তথাকথিত বিদ্রোহী জোয়ানরা বার বার প্রধানমন্ত্রীকে পিলখানায় আমন্ত্রণ জানিয়েছিল সমস্যা সমাধানের জন্য। সেদিন যদি প্রধানমন্ত্রী তাদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হতেন, তবে প্রধানমন্ত্রীর ওপরও হামলা হতে পারত। পরবর্তীতে বিদ্রোহে অংশগ্রহণকারীদের বিচার কার্যক্রমে সে প্রমাণও স্পষ্ট হয়। শেখ হাসিনা অত্যন্ত সু-কৌশলে তার রাজনৈতিক প্রজ্ঞার আলোকে বিদ্রোহ দমনে সক্ষম হন। সে ঘটনার প্রেক্ষিতে সেনা ছাউনিতে অর্থাৎ ক্যান্টনমেন্টেও উত্তেজনাকর পরিবেশ বিরাজ করছিল। সেনাদের ভেতরও বিক্ষুব্ধভাব বিরাজ করছিল। সে ভাব শেখ হাসিনা তাঁর প্রজ্ঞা ও ধীশক্তির মাধ্যমে প্রশমন করেছিলেন। শেখ হাসিনার জীবন সর্বজনীন মাতৃভাবনার জীবন, তথা সমন্বিত নারীসত্তা। পরস্পরের মধ্যে কলহ, অবিশ^াস, আত্মকেন্দ্রিকতা ও উদ্দেশ্য প্রবণতার যাঁতাকলে পিষ্ট এ দেশের মানুষের বিস্মৃত মানবতা উদ্ধারে এক সঠিক পথ নির্দেশনা খুঁজে পাওয়া যায় তাঁর রাজনৈতিক দর্শনে। আজ বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনার বিচারকার্য সম্পন্ন হয়েছে। ইতিহাসে পিলখানা হত্যাযজ্ঞ বিচারের এ যাবতকালের সর্বোচ্চ সংখ্যক অপরাধীর শাস্তির রায় ঘোষণা করা হয়। অধীর আগ্রহে জাতি অপেক্ষা করছে এ রায় বাস্তবায়নের। পাদটীকা : মনে রাখতে হবে যে, ষড়যন্ত্রকারী স্বাধীনতাবিরোধীচক্র এখনও সক্রিয়। বেশ বদল করে বর্ণচোরা হয়ে সরকারের অভ্যন্তরে দলের ভেতরে ঘাপটি মেরে আছে। তারা অতিমাত্রায় বঙ্গবন্ধু প্রেমিক সেজে শেখ হাসিনার আস্থা অর্জনে কৌশলী। সুযোগ বুঝে থাবা বিস্তারের অপেক্ষায় আছে। যে কোন অঘটন ঘটাতে প্রস্তুত রয়েছে। অতএব সাবধান! লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক [email protected]
×