ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মতিলাল দেব রায়

আওয়ামী লীগ বনাম বিএনপি

প্রকাশিত: ১০:১৯, ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২০

আওয়ামী লীগ বনাম বিএনপি

১৯৪৯ সালের ২৩ জুন ঢাকার টিকাটুলীতে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ নামে যে দলটি আত্মপ্রকাশ করেছিল সেই দলটিই আজকের আওয়ামী লীগ। অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির পুরোধা পুরুষ ছিলেন বঙ্গবন্ধু। ১৯৫৫ সালের ২১ অক্টোবর আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে তিনি মুসলিম শব্দ বাদ দিয়ে অসাম্প্রদায়িক ‘আওয়ামী লীগ’ নামকরণ করেন। তিনি ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের সফল রূপকার। তাঁর ৭ মার্চের ভাষণই ছিল স্বাধীনতা ঘোষণা ও গেরিলা যুদ্ধের কৌশল, মুক্তির জন্য দেয়া পৃথিবীর একটি অসাধারণ ও সর্বশ্রেষ্ঠ ভাষণ। দেশ স্বাধীন হবার মাত্র ৫০ দিনের মাথায় এ দেশ থেকে বিদেশী সৈন্য প্রত্যাহার ছিল একটি বিস্ময়কর ঘটনা। বঙ্গবন্ধুর প্রজ্ঞা এবং দৃঢ় নেতৃত্বের কারণেই ১৯৭২ এর ১২ মার্চ বিদেশী সৈন্য প্রত্যাহার শুরু হয়। বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশে একটি গণমুখী শিক্ষানীতি প্রণয়নের উদ্যোগ নেন। এ লক্ষ্যে ১৯৭২ সালের ২৬ জুলাই ড. মুহম্মদ কুদরাত-এ-খুদাকে সভাপতি করে একটি শিক্ষা কমিশন গঠন করেন। কমিশন ১৯৭৪ সালের মে মাসে পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট পেশ করে। আওয়ামী সরকারের নিরলস প্রচেষ্টায় ডিজিটাল বাংলাদেশ আজ আর কল্পনা নয়, বাস্তবত। প্রায় ৫ হাজার ২৭৫টি ডিজিটাল সেন্টার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ২০০ ধরনের ডিজিটাল সেবা প্রদান করা হচ্ছে। এই খাতের উদ্যোক্তাদের মাসিক আয় প্রায় ২০ হাজার থেকে এক লাখ টাকা, যা পর্যায়ক্রমে আরও বাড়তে পারে। বর্তমানে দেশে মোবাইল গ্রাহকের সংখ্যা প্রায় ১১ কোটি ৯৭ লাখের ওপরে। ইন্টারনেট গ্রাহকের সংখ্যা আনুমানিক ৪ কোটি ৩২ লাখ। দিন দিন ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা বাড়ছে। আজকে দেশের যুব সম্প্রদায়ের অধিকাংশ ল্যাপটপ ব্যবহার করছে এবং পৃথিবীর তথ্য ভাণ্ডারে প্রবেশ করার সুযোগ পাচ্ছে। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার কর্তৃক ২৫ হাজার ওয়েবসাইট নিয়ে বিশ্বের বৃহত্তম ওয়েব পোর্টাল ‘জাতীয় তথ্য বাতায়ন’ চালু করা হয়েছে। আইটি সেক্টরে বিদেশ থেকে প্রায় ১২৫ মিলিয়ন ডলার আয় হচ্ছে। বাংলাদেশে সংবাদ মাধ্যম এখন পূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করছে। যতদূর জানা যায় এখন পর্যন্ত আওয়ামী লীগ সরকার নতুন ৩২টি টেলিভিশন, ২২টি এফএম রেডিও এবং ৩২টি কমিউনিটি রেডিও চ্যানেলের অনুমোদন দিয়েছে। বর্তমান সরকার কর্তৃক তথ্য অধিকার আইন প্রণয়ন ও তথ্য কমিশন প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার সরকার বাংলাদেশ সাংবাদিক কল্যাণ ট্রাস্ট প্রতিষ্ঠা করেছে। আন্তর্জাতিক পরিসরে সরকারের ভাবমূর্তি বৃদ্ধি পাওয়ায় জাতীয় সংসদের স্পীকার কমনওয়েলথ পার্লামেন্টারি এ্যাসোসিয়েশনের নির্বাহী কমিটির চেয়ারপার্সন নির্বাচিত হয়েছেন। একজন সংসদ সদস্য ইন্টার পার্লামেন্টারি ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন। দুটি গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাচিত হওয়ায় গণতান্ত্রিক বিশ্বে বাংলাদেশ নতুন যোগের সৃষ্ট করেছে। বাংলাদেশ IMSO, ITU এবং হিউম্যান রাইটস কাউন্সিলসহ ১২টি আন্তর্জাতিক সংস্থার নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছে। বাংলাদেশকে জাতিসংঘের এমডিজি এ্যাওয়ার্ড, সাউথ-সাউথ এ্যাওয়ার্ড এবং ITU-এর ‘ওয়ার্ল্ড সামিট অন ইনফরমেশন সোসাইটি’ পুরস্কারে ভূষিত করা হয়েছে । আওয়ামী লীগ সরকার সারাদেশে চৌদ্দ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিক প্রতিষ্ঠা করেছে, যা স্বাস্থ্য খাতে এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ। এই সরকার কর্তৃক প্রায় ৪০টিরও বেশি সরকারী-বেসরকারী মেডিক্যাল কলেজ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। বিএনপি সরকার কর্তৃক এরকম কোন প্রতিষ্ঠান তৈরি করার মতো পরিকল্পনা চোখে পড়েনি। আওয়ামী লীগ সরকার আমেরিকার ফ্লোরিডা থেকে বঙ্গবন্ধু সেটেলাইট সফলভাবে মহাশূন্যে স্থাপন করেছে। বিএনপিকে এরকম কোন উন্নয়নমূলক এবং বৈজ্ঞানিক কার্যক্রম গ্রহণ করতে জনগণ দেখেনি। বিএনপির বৈজ্ঞানিক কোন উদ্ভাবনী দক্ষতা ও চিন্তা নেই। ২০০১ সালে আওয়ামী লীগ সরকার বিদ্যুত উৎপাদন রেখে এসেছিল ৪ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট। বিএনপি-জামায়াতের সময় তা কমে দাঁড়ায় ৩ হাজার ২০০ মেগাওয়াটে। এখন আমাদের বিদ্যুত উৎপাদন সক্ষমতা ১৩ হাজার ২৮৩ মেগাওয়াটের চেয়েও বেশি । আওয়ামী লীগ সরকার মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীকে সহায়তাকারী রাজাকারের তালিকা তৈরি করেছে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা শুরু করেছে, অনেক গণকবর চিহ্নিত করে সংরক্ষণ করার ব্যবস্থা করেছে। এ ব্যাপারে বিএনপির নিষ্ক্রিয়তা লক্ষ্য করা যায়। আওয়ামী লীগ সরকার সারাদেশের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক সরবরাহ করছে, যা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। বিএনপি শিক্ষা সঙ্কোচন নীতি গ্রহণ করে। বরিশালে কোন এক হাইস্কুলে পরীক্ষা চলাকালীন নকল করছিল কয়েকজন ছাত্র। দেখতে পেয়ে হাইস্কুলের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের হেডমাস্টারকে স্কুলের মাঠে প্রকাশ্যে জুতাপেটা করেছিলেনÑ এই হচ্ছে তৎকালীন বিএনপি সরকারের শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী এহসানুল হক মিলনের কাণ্ড। তার দ্বারা শিক্ষাক্ষেত্রে কি উন্নতি আশা করা যায়? বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার সারাদেশে গত বছর ৩ হাজার ২৭০টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে এমপিওভুক্ত করেছে। দ্বিতীয় পর্যায়ে আরও ২ হাজার ৩০০টির বেশি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে এমপিওভুক্ত করার ঘোষণা দিয়েছে, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে বিরল। আওয়ামী লীগ সরকার শিক্ষা সম্প্রসারণ নীতিতে বিশ্বাস করে বলেই এটি সম্ভব হয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকার নারীদের ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে ৫০টি সংরক্ষিত সংসদীয় আসন সৃষ্টি করে। এ সরকার কর্তৃক নারীর ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে একজন নারীকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিয়োগ দেয়া হয়, যা ভারতীয় উপমহাদেশে বিরল। বিএনপি সরকার নারীদের ক্ষমতায়নের জন্য এরকম কোন পদক্ষেপ নিতে পারেনি। সড়কে সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা দেয়ার জন্য নিরাপদ সড়ক আইন ২০১৮ সংসদে পাস করে আওয়ামী লীগ সরকার। বিএনপি সংসদে এই আইন পাস করার জন্য কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। বাংলদেশ রেলওয়েকে নিরাপদ ও যাত্রীসেবার মান উন্নয়নের লক্ষ্যে একের পর এক প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। রেলওয়ের উন্নয়নে এই সরকার খুবই আন্তরিক। এই সরকারের যুগান্তকারী পদক্ষেপ যেমন বুড়িগঙ্গা নদীকে দখল ও দূষণমুক্ত করার জন্য গৃহীত পদক্ষেপ, দেশের নদী খননের জন্য মহাপরিকল্পনাসহ অনেক প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। যার ফলে দেশের উন্নয়ন কয়েক ধাপ এগিয়ে যাবে। দেশের হাওড় অঞ্চলের মানুষের উন্নয়নে হাওড় রক্ষা বাঁধ নির্মাণ, রাস্তার উন্নয়ন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাসহ ব্যাপক কর্মসূচী গ্রহণ করা হয়েছে, যা পূর্ববর্তী কোন সরকার চিন্তাও করেনি। বিএনপি সরকারের সময় হাওড় উন্নয়নে কোন দীর্ঘমেয়াদী কর্মসূচীর পরিকল্পনা করা হয়নি। বিএনপির শাসন আমলে অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধা হত্যা করা হয়। আওয়ামী লীগ সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করেছে মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট প্রতিষ্ঠা করে। সারাদেশের সব মুক্তিযোদ্ধার তালিকা তৈরি করে প্রকাশ করেছে। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর আওয়ামী লীগ সরকারের সৃষ্টি। দুর্নীতি বন্ধ করার জন্য আওয়ামী লীগ সরকার নিজের দলের মধ্যে শুদ্ধি অভিযান শুরু করেছে। বিএনপির অধিকাংশ নেতা দুর্নীতিগ্রস্ত। এই দলের প্রধান এতিমদের জন্য বরাদ্দকৃত অর্থ আত্মসাত মামলায় কারাবন্দী। দ্বিতীয় নেতা বিদেশে পলাতক। জাতিসংঘ তথা আন্তর্জাতিক ফোরামে আওয়ামী লীগ প্রধান কর্তৃক বিভিন্ন সময় দেয়া বক্তৃতা আন্তর্জাতিক অঙ্গনের দৃষ্টি কেড়েছে এবং বাংলাদেশের ভাবমূর্তি বৃদ্ধি হয়েছে। বিএনপি সরকারের আমলে বিরোধী দলকে অর্থাৎ আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করার লক্ষ্যে বিএনপি সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় ২১ আগস্ট ২০০৪ সালে আওয়ামী লীগ সভানেত্রীকে হত্যার জন্য গ্রেনেড হামলা করা হয়। সে হামলায় আইভি রহমানসহ অনেক নেতাকর্মী নিহত ও আহত হন। তারপরও আওয়ামী লীগ কোন প্রতিহিংসার রাজনীতি করেনি, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে বিশ্বাস করে না বলে। উপজেলা পর্যায়ে অবস্থিত সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি কমানোর জন্য, যাতে করে জনগণ খুব তাড়াতাড়ি তাদের ভূমি সংক্রান্ত রেকর্ড ও কাগজপত্র পেতে পারেন, সে ব্যাপারে ডিজিটাল পদ্ধতির উন্নয়ন করা হয়েছে। বিএনপি দেশের সাধারণ মানুষের উন্নয়নের লক্ষ্যে তেমন কোন কাজ করেছে কিনা তা আজকে সকলের প্রশ্ন। তারা আবার ক্ষমতায় গেলে লুটপাটের রাজনীতি কায়েম করার প্রচেষ্টায় লিপ্ত হবে। তাদের সরকারের কাজের কোন গঠনমূলক সমালোচনা করতে কেউ দেখেনি। দেশের কত রকমের সমস্যা আছে। তারা একটি সমস্যা নিয়েও বিগত সময় আলোচনা বা কোন পরামর্শ সরকারের কাছে সমাধানের জন্য উপস্থাপন করেনি, তারা শুধু ক্ষমতায় যেতে চায়। তারা ক্ষমতায় গেলে দেশের উন্নয়ন তো হবেই না, বরং দেশে সন্ত্রাসের রাজত্ব ও মৌলবাদী রাষ্ট্র কায়েম করবে। তাদের কোন দক্ষতা, দূরদর্শিতা ও পরিকল্পনা নেই। পরিকল্পনাহীন সরকার আর বৈঠা ছাড়া নৌকা একই রকম, কোনটি দিয়েই গন্তব্যে যাওয়া যায় না। একটি দেশের উন্নয়ন কার্যক্রমকে টেকসই করতে হলে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ এবং তাকে বাস্তবায়ন করতে হয়। তার জন্য প্রয়োজন একটি দীর্ঘমেয়াদী সরকার। দীর্ঘমেয়াদী সরকারই নিশ্চিত করতে পারে সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও উন্নয়ন। লেখক : নিউইয়র্ক প্রবাসী
×