ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

দায় ও দায়িত্ব

ইচ্ছামতো রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি আর কত?

প্রকাশিত: ১১:১৬, ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২০

ইচ্ছামতো রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি আর কত?

রাজন ভট্টাচার্য ॥ নগরবাসীদের মধ্যে যে কাউকে যদি জিজ্ঞেস করা হয় পথ চলায় সবচেয়ে বড় অসুবিধা কি? একবাক্যে উত্তর আসবে রাস্তা খোঁড়াখুুঁড়ি। যদিও নাগরিক জীবনে এই সমস্যা নতুন কিছু নয়। অনেক পুরনো। যুগের পর যুগ ধরে ইচ্ছেমতো যখন খুশি সড়কের মাটি তুলে ফেলা হচ্ছে। তারপর যাচ্ছে মাসের পর মাস। সংস্কারের উদ্যোগ নেই। কখন রাস্তা বন্ধ থাকে। কখনও দুর্যোগ মাড়িয়ে পথ চলতে দেখা যায় নগরবাসীকে। অথচ যে শহরে প্রায় দুই কোটি মানুষের বসবাস, সেখানে এ রকম কর্মকা- কতটা শোভনীয়। ঢাকা সিটি কর্পোরেশন মোটেও এ রকম কা-জ্ঞানহীন কায়কারবারের দায় এড়াতে পারে না। এ নিয়ে তীব্র সমালোচনা হলেও হয়ত সিটি কর্তৃপক্ষের কিছু যায় আসে না। যদি আসতই তাহলে ইচ্ছেমতো সড়ক কাটা নিশ্চয়ই বন্ধ হতো। নয়ত কিছুটা হলেও কাজ কর্মে পরিবর্তন আসত। তা হয়নি। যে রকম শুরু হয়েছিল, সেরকম চলমান! বাণিজ্যিক কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত মতিঝিলের একটি রাস্তার উদাহরণ দেয়া যায়। বাংলাদেশ ব্যাংক আর সেনা কল্যাণ সংস্থার সামনে দিয়ে কমলাপুর পর্যন্ত গলির কথা বলছি। মুগদা-বাসাবো-মান্ডাসহ ঢাকার নি¤œাঞ্চল থেকে মতিঝিল হয়ে মূল শহরে প্রবেশকারী লাখো রিক্সাসহ ছোট ছোট অসংখ্য পরিবহন এই সড়কটি ব্যবহার করে। চার মাসের বেশি সময় রাস্তাটি কেটেছে একটি সেবা সংস্থা। কাজ শেষ হয়েছে দু’মাস হলো। তারপর রাস্তাটি গাড়ি চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করা হয়েছে। কিন্তু গাড়ি চলাচল কি আদৌ সম্ভব? না। কারণ সড়কের মাঝখানে বড় করে কাটা। পাকা না করায় যেখানে গর্ত হয়ে আছে। এক পাশে মাত্র একটি রিক্সা চলার কোন রকম সুযোগ আছে। তাহলে লাখো রিক্সার যাতায়াত কোন পথে সে প্রশ্নে পরে আসছি। সরেজমিন গিয়ে দেখা গেছে, রাস্তাটি কাটার সুযোগ নিয়ে সেনা কল্যাণ সংস্থার সামনে থেকে কমলাপুর মূল সড়ক পর্যন্ত বসেছে ভ্রাম্যমাণ দোকান। রাস্তার মাঝখানজুড়ে বসানো হয়েছে বিশাল বিশাল পসরা। আছে সবজি, প্লাস্টিকের দোকান, মাছ, কামাড়ের দোকান, কাপড়সহ রকমারি নিত্যপণ্য। স্থানীয় ব্যবসায়ী মিজান, আকবরসহ কয়েকজন জানালেন, রাস্তাটি দিয়ে খুব একটা যানবাহন চলতে পারে না। তাই দোকান দিয়েছি। সড়কটি মেরামত শেষে পুরোপুরি চালু হলে এখানে দোকান রাখার সুযোগ নেই। কমলাপুর ও আরামবাগ সিগনালে যেসব ট্রাফিক পুলিশ সদস্য কাজ করেন তাদের বক্তব্য হলো, গলি দিয়ে যানবাহন চলাচল করতে না পারায় এখন সকাল থেকে কমলাপুর-আরামবাগ-মতিঝিল পর্যন্ত মূল সড়কটিতে যানজট থাকে। অনেক সময় কমলাপুর-আরামবাগ সিগন্যাল আটকে রাখতে হয়। এমন ঘটনাও আছে এইটুকু রাস্তা পার হতে ৪৫ মিনিট পর্যন্ত লেগে যায়। এর মূল কারণ হলো লাখো রিক্সার সমাগম। আর মতিঝিল থেকে দৈনিক বাংলা, পল্টনসহ প্রেসক্লাব পর্যন্ত এখন চলাচল একেবারেই দায়। কারণ মেট্রো রেলের কাজ চলছে রাতদিন। রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি হচ্ছে সমানতালে। সেইসঙ্গে যেখানে সেখানে ইট, বালু রাখায় ধুলো বালিতে দুর্ভোগের যেন শেষ নেই। এখন মতিঝিলের পুরো বাতাস ভারি। খিলগাঁও উড়াল সড়ক হয়ে বাসাবো নামতেই মূল সড়কের বেশকিছু অংশ কাটা প্রায় ২০ দিন ধরে। বিটিসিএল কর্তৃপক্ষ ভূগর্ভস্থ কাজের জন্য রাস্তাটি কেটেছিল। কাটার অন্তত ১০ দিন একটানা পানি ওঠেছে মাটি চুয়ে। এখন ঠিক হলেও রাস্তাটি আর পাকা হচ্ছে না। বালু, সুরকি দিয়ে ভরাট করা জায়গাটি দেবে গিয়ে ফের গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। ধুলোয় একাকার আশপাশ। মীরপুর-১ নম্বর থেকে ভেতরের রাস্তা দিয়ে কল্যাণপুর আসতে সব অলিগলি কাটা দীর্ঘদিন ধরে। এক নম্বরের পোস্ট অফিসের গলি থেকে আগারগাঁও বিএনপিবাজার পর্যন্ত সড়কের দু’পাশেই কাটা। ধানমন্ডি ৯/এ থেকে মোহাম্মদপুর পর্যন্ত রাস্তা কেটে কুটিকুটি করা হয়েছে। এই এলাকার বাম লেনের চিত্র এ রকম। ৩/এ সড়কের চিত্র একই রকম। হাজারীবাজরের ভেতরের সড়কটি দীর্ঘদিন নষ্ট থাকলেও দেখার যেন কেউ নেই। বংশাল থেকে চাঁনখারপুলের ভেতরের সড়কটি এখন আর সড়ক বলার উপায় নেই। দীর্ঘদিন ভেঙে চুড়ে খানখান রাস্তা। মেরামতের উদ্যোগ নেই। মিন্টু রোডের রাস্তাটিও কাটাছেঁড়া চলছে বেশ কয়েকদিন ধরেই। সিটি কর্পোরেশনের অনুমতি নিয়েই এসব রাস্তা কাটে বিভিন্ন সেবা সংস্থা। সিটি কর্পোরেশন কর্তৃপক্ষও কাটাকাটিতে সিদ্ধহস্ত। কয়েক বছরের পরিকল্পনা নিয়ে কাজ হয়। এরমধ্যে সময়সীমা শেষ হওয়ার আগেই দেখা যায় সমস্যা বাড়ে। তখন আবারও মেরামত, নয় নতুন প্রকল্পের বাস্তবায়ন। তাই জনদুর্ভোগ সৃষ্টিতে সিটি কর্পোরেশন কোনভাবেই দায় এড়াতে পারে না। তেমনি নতুন নতুন পরিকল্পনা নিয়ে রাস্তা কাটতে না পারায় দায়ও সিটি কর্তৃপক্ষের এড়ানোর সুযোগ নেই। সামনে বর্ষা। এখন প্রায় সব এলাকায় অলিগলি কাটাছেঁড়া। অব্যাহত ফুটপাথ, ড্রেনেড প্রকল্পের কাজ চলছে। বৃষ্টি হলেই এসব কাজের কারণে জনদুর্ভোগ মাত্রা ছাড়াবে। তাই বর্ষায় সড়ক না কাটার দাবি নগরবাসীর। তেমনি ইচ্ছেমতো সড়ক না কেটে নিয়মের মধ্যে কাজ করার দাবিও রয়েছে সবার। নগরবীদ নূরুল ইসলাম নাজেম বলেন, ইচ্ছেমতো রাস্তা কাটাকাটির কারণে মানুষের দুর্ভোগ পোহাতে হয় সারা বছর। এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণ দিতে হবে। অনেক হয়েছে। এখন পরিকল্পনা করে সবকিছু করা উচিত। তেমনি একটি নিয়েমের মধ্যে থেকে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি করা প্রয়োজন। সবার আগে নাগরিক সুবিধা অসুবিধার কথা মাথায় রাখতে হবে। এদিকে ঢাকা মহানগরীতে বছরের যে কোন সময় রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি বন্ধে নীতিমালা তৈরি করছে সরকার। এই নীতিমালা অনুযায়ী, বর্ষাকালে বিশেষ করে মে থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বছরের ৫ মাস রাস্তা খনন করা যাবে না। দিনের বেলায় কোন রাস্তা খোঁড়া বা কাটার কাজ করা যাবে না। অনুমতি ছাড়া খনন করা হলে মূল খরচের পাঁচগুণ হারে জরিমানা ফি আদায় করা হবে। সিটি কর্পোরেশনের অনুমতি সাপেক্ষে শুধু রাতেরবেলা রাস্তায় যখন যানবাহন কম থাকে তখন খোঁড়াখুঁড়ি করতে হবে। আধুনিক যন্ত্রপাতি সমন্বয়ে অভিজ্ঞ ঠিকাদার দিয়ে খনন কাজ করতে হবে। অনুমতি প্রদান, খনন ও রাস্তা পুনর্বাসনের কাজ সর্বোচ্চ তদারকি করতে ওয়ানস্টপ সমন্বয় সেল গঠন করা হবে। তৈরি খসড়া নীতিমালাটি চূড়ান্ত অনুমোদনের শেষ পর্যায়ে রয়েছে। খুব দ্রুতই নীতিমালাটি প্রণয়ন করা হবে। সূত্র জানায়, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় রাজধানীতে বসবাসকারী সিটি কর্পোরেশন এলাকায় বর্ষাকালে নির্দিষ্ট সময় রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি বন্ধ করতে বা শীতকালেও যখন তখন রাস্তা খুঁড়ে সৃষ্ট ভয়াবহ জনদুর্ভোগ বন্ধ করতে এই বিশেষ উদ্যোগ হাতে নিয়েছে। এজন্য ২০০৩ সালে অবিভক্ত ঢাকা সিটি কর্পোরেশন থাকাকালে তৈরি সড়ক খনন নীতিমালাটি বাতিল করে নতুন এই নীতিমালা তৈরি হচ্ছে। ‘ঢাকা মহানগরীর সড়ক খনন নীতিমালা-১৮’ নামের এই নীতিমালা প্রণয়নের কাজ বর্তমানে চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। বিষয়টি স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী তাজুল ইসলাম জনকণ্ঠকে নিশ্চিত করেছেন। মন্ত্রণালয়ের নগর উন্নয়ন শাখার অতিরিক্ত সচিব মাহবুব হোসেনকে প্রধান করে গঠিত কমিটি নতুন নীতিমালা প্রণয়নে কাজ করছে। সূত্র মতে, নীতিমালার খসড়া ইতোমধ্যেই স্থানীয় সরকার মন্ত্রীকে দেখানো হয়েছে। মন্ত্রী কিছু বিষয়ে সংশোধনের পরামর্শ দিয়েছেন। এসব সংশোধনীর পর অতি দ্রুতই নীতিমালাটি চূড়ান্ত করা হবে। নীতিমালায় বলা হয়েছে, রাস্তার যে এলাকায় সড়ক খনন করা হবে সেই এলাকায় নাগরিকের সুবিধার্থে কমপক্ষে ৭ দিন আগেই সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি প্রচার, মাইকিং করা, স্থানীয়দের সহায়তা চেয়ে প্রচারপত্র বিলি, কেবল অপারেটরের মাধ্যমে প্রচার, কাজ শুরুর কমপক্ষে ৩ দিন আগে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা, একইসঙ্গে নাগরিকদের এ নিয়ে কোন ধরনের অভিযোগ বা পরামর্শ দিতে সিটি কর্পোরেশন ও খননকারী সংস্থার নাম, ঠিকানা ও মোবাইল ফোন নম্বর সাইন বোর্ড আকারে কাজ শুরুর স্থানে টাঙ্গিয়ে দিতে হবে। নতুন নীতিমালায় নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে রাস্তা খোঁড়ার কাজ শেষ না হলে আইনানুযায়ী জরিমানা দিতে হবে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে। এছাড়া যে কোন সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানকে চাইলেই যে কোন রাস্তা খননের অনুমতি দিতে পারবে না সিটি কর্পোরেশন কর্তৃপক্ষ।
×