ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

জনজোয়ারে উদ্দীপ্ত বই উৎসব

প্রকাশিত: ১০:১৫, ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২০

জনজোয়ারে উদ্দীপ্ত বই উৎসব

মনোয়ার হোসেন ॥ বিশ্বের সবচেয়ে মধুর ভাষা হচ্ছে বাংলা- এভাবেই বাংলা ভাষাকে স্বীকৃতি দিয়েছে জাতিসংঘের ইউনেস্কো। আর এই ভাষার অধিকার রক্ষায় বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারি প্রাণ সঁপে দিয়েছিলেন ভাষাশহীদরা। শুক্রবার ছিল ভাষার জন্য আত্মাহুতি দেয়া সেই ঐত্যিহাসিক দিন মহান শহীদ ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। আর এমন দিনে চেতনায় উদ্দীপ্ত হয়েছিল ভাষাশহীদদের নিবেদিত অমর একুশে গ্রন্থমেলা। বইকেন্দ্রিক উৎসবটি পরিণত হয় জনজোয়ারে। বইমেলার দুই ক্যানভাস বাংলা একাডেমি ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানকে ঘিরে ঘিরে বানের জলের মতো অগণন মানুষের ঢল নামলে ঘটেনি কোন অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা। বরং সবাই যেন বায়ান্নর বাঙালী জাতীয়তাবাদের উন্মেষের চেতনাটাকে বুকে ধারণ করে নিজেকে উপস্থাপন করেছেন পরিশীলিতভাবে। তাদের সকলেই বই না কিনলেও অনেকেই বইয়ের সঙ্গে গড়েছেন। আর যারা বই কেনেনি তারা মেলায় ঘুরেফিরে কিংবা সেলফি তুলে উপভোগ করেছেন নির্মল আনন্দ। এদিন সকাল আটটা থেকে শুরু হয় বিকশিত মননের প্রতিচ্ছিবি একুশে গ্রন্থমেলা। শহীদ মিনারে ভাষাশহীদদের শ্রদ্ধা জানানো প্রভাতফেরি শেষ করে দলবেঁধে, পরিবার নিয়ে কিংবা একাই প্রবেশ করেছেন গ্রন্থমেলায়। দেখেশুনে কিনে নিয়েছেন আপন মননের উপযোগী গ্রন্থটি। সকালে তুলনামূলক ভিড় কম হলেও সেই চেহারা বদলে যায় তিনটার পর। ক্রমশই রাজধানীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে থেকে বইয়ের মেলাকেন্দ্রিক জনস্রোত আসতে শুরু করে। বিকেল পাঁচটার পর জনজোয়ার বয়ে যায় বইমেলায়। সন্ধ্যার পর আরও বেড়ে যায় সেই জনসমুদ্রের পরিধি। একদিকে শাহবাগ ও অন্যদিকে দোয়েল চত্বর পর্যন্ত ছড়িয়ে যায় বইমেলাকেন্দ্রিক বিপুল জনসমাগম। আর অগণন জনতার মধ্যে অসংখ্য বইপ্রেমীর উপস্থিতিতিতে প্রবলভাবে জমে ওঠে বইয়ের বেচাকেনা। অসংখ্য পাঠকের ব্যাপক চাহিদায় বই বিতানের বিক্রয়কর্মীদের হিমশিম খেতে হয়। এক পাঠকের বইয়ের সরবরাহ শেষ না হতেই বিক্রয়কর্মীর কছে চলে আসছিল আরেকটি বইয়ের চাহিদা। বাংলা একাডেমির জনসংযোগ বিভাগের তথ্যানুযায়ী, একুশে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বই প্রকাশিত হয়েছে ৩৩৮৯টি। এদিন বিকেলে মেলার সোহরাহওয়ার্দী উদ্যান অংশে কথা হয় কলাবাগানের বাসিন্দা ফারহানা রহমানের সঙ্গে। কথা প্রসঙ্গে বলেন, এর আগেও দু’দিন এসেছি বইমেলায়। তবে আজকের বইমেলার দিনটির তাৎপর্য আমার কাছে অন্যরকম। তাই ভাষা আন্দোলন এবং মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক বই সংগ্রহ করে শ্রদ্ধা জানাচ্ছি ভাষাশহীদদের। বিশেষ ভাষা আন্দোলনের অনেক ইতিহাস আমার আজানা। সেই তৃষ্ণা থেকে সংগ্রহ করেছি আহমদ রফিকের ‘একুশের দিনলিপি’ এবং বশীর আল হেলালের ‘ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস’। এছাড়া কিনেছি আফসান চৌধুরী সম্পাদিত ‘১৯৭১ গণনির্যাতন-গণহত্যা : কাঠামো, বিবরণ ও পরিসর’। সন্ধ্যায় কথা হয় মোহাম্মদপুর থেকে আসা আরেক আরেক পাঠক পার্থ বণিকের সঙ্গে। আলাপচারিতায় বলেন, সংগ্রামী মানুষদের বই পড়তে আমার ভাল লাগে। এজন্য বাংলা একাডেমি থেকে বঙ্গবন্ধুর লেখা ‘আমার দেখা নয়াচীন’ কিনলাম। শেখ মুজিবুর রহমানের লেখা আগের দুটি বই পড়ে ভাল লেগেছে। জাতির জনকের লেখা বই পড়লে তাকে জানার পাশাপাশি সেই ইতিহাসকে জানা যায়। এছাড়াও কিনেছি অনুবাদিত গ্রন্থ ‘ফিদেল কাস্ত্রো : চে স্মৃতিকথা’ এবং আবুল কাসেম ফজলুল হকের ‘রেনেসাঁস ও গণজাগরণ’। ফাগুনের বিকেলে উদ্যানের খোলা আঙিনায় ঘিরে ধরা পাঠকদের সংগৃহীত বইয়ের মলাটে অটোগ্রাফ দিচ্ছিলেন জনপ্রিয় লেখক আনিসুল হক। ‘এখানে থেমো না’ বা ‘ভূত’সহ গল্প ও উপন্যাসের বইয়ে শুভেচ্ছা বাণী লিখতে লিখতে এই লেখক বলেন, ভাষা দিবসকে কেন্দ্র করে মানুষের এই উচ্ছ্বাস আমাদের আশা জোগায়। তাদের মুখে ঘুরে ফেরা বিভিন্ন স্লোগান কিংবা পোশাকে বর্ণমালার ব্যবহার দেখে মনে হচ্ছে ভাষার প্রতি আমাদের ভালবাসাটা ক্রমাগত বাড়ছে। পাশাপাশি বইনির্ভর এমন উৎসবে স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের মাধ্যমে বিকশিত হচ্ছে সাধারণ মানুষের মনন। জনসমাগত বেশি হলেই বই বেশি বিক্রি হয় না উল্লেখ করে অন্যপ্রকাশের প্রধান নির্বাহী মাজহারুল ইসলাম বলেন, একুশে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে মেলায় প্রচুর জনসমাগম হয়েছে। এত মানুষ আসায় বই বিক্রি বাড়লেও সেটাকে ব্যাপক বলা যায় না। কারণ এসব বিশেষ দিনে মেলায় আসা অধিকাংশ মানুষই বই কিনে না। মূলত আগামী আটদিন বই বেশি বিক্রি হবে। এসময় মূলত পাঠকরাই আসবে মেলায়। তবে বিশ্বব্যাপী অনেক বইমেলা হলেও ভাষাশহীদদের স্মৃতিতে নিবেদিত এই মেলার গুরুত্ব অন্যরকম। সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে পরিণত হওয়া এই মেলাটি মানুষের ভেতরকার সৌন্দর্যবোধকে উস্কে দেয়। পাশাপাশি পাঠক, লেখক ও প্রকাশকের মধ্যে সেতুবন্ধনটিও চমৎকারভাবে ধরা দেয় এই মেলায়। এলো রেকর্ডসংখ্যক নতুন বই গ্রন্থমেলার ২১তম দিন মেলায় এসেছে রেকর্ডসংখ্যক ৫০৮টি নতুন বই। এর আগামী প্রকাশনী এনেছে ‘মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস সমগ্র’। আবিষ্কার এনেছে রবিউল হুসাইনের কাব্যগ্রন্থ ‘কি আছে এই অন্ধকারের গভীরে’। মাহাকাল প্রকাশ করেছে হাবীবুল্লাহ সিরাজীর কাব্যগ্রন্থ ‘ছিন্নভিন্ন অপরাহ্ন’ ও রীনা মজুমদারের ‘বাস্তবতার বেড়াজালে’। কথা প্রকাশ এনেছে মুনতাসীর মামুনের ‘বাংলাদেশ ১৯৭১ : গণহত্যা নির্যাতনের রাজনীতি’। পুঁথিনিলয় এনেছে জাকির তালুকদার ‘গল্প সমগ্র ২’, বিপ্রদাশ বড়ুয়ার ‘তিনটি গোয়েন্দা কাহিনী’ ও ইমদাদুল হক মিলনের ‘তোমার ভালোবাসা’। য়ারোয়া বুক কর্নার এনেছে কাজী রোজীর ‘শেখ মুজিবুর বাঙালির বাতিঘর’। জ্ঞানকোষ এনেছে মুহম্মদ জাফর ইকবালের ‘আমার সাইন্টিস মামা’। লুৎফর রহমানের রিটনের শিশুতোষ গ্রন্থ ‘বেড়ালের গল্প’ প্রকাশ করেছে ঝিঙেফুল। মেলামঞ্চে একুশের বক্তৃতা : গ্রন্থমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় অমর একুশে বক্তৃতা। বঙ্গবন্ধু, বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ ও সাম্প্রতিক উন্নয়ন প্রসঙ্গ শীর্ষক একুশে বক্তৃতা প্রদান করেন অধ্যাপক নজরুল ইসলাম। অনুষ্ঠানে স্বাগত ভাষণ প্রদান করেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক হাবীবুল্লাহ সিরাজী। সভাপতিত্ব করেন বাংলা একাডেমির সভাপতি জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। হাবীবুল্লাহ সিরাজী বলেন, এবছর বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ, ২০২১ সালে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর মহান পরম্পরায় ২০২২ সালে ভাষা আন্দোলনের সত্তর বছর পূর্তি হতে যাচ্ছে। বাংলা একাডেমি জাতীয় জীবনের এই তিন মাহেন্দ্রক্ষণকে স্মরণীয় করে রাখতে এখন থেকেই নানা কর্মসূচী গ্রহণ করেছে। অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, বঙ্গবন্ধুর জীবনের সার্বক্ষণিক চিন্তা ছিল বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের মানুষ বাঙালীর কথা। তাঁর ‘সোনার বাংলা’ প্রত্যয়ে দেশ বাংলা ও বাঙালি এ দুই ধারণাই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। মহান এই নেতার সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তাঁরই মতো অসমসাহসী ও বিচক্ষণ; তিনি তাঁর পিতার, আমাদের জাতির জনকের, স্বপ্নের ‘সোনার বাংলা’ গড়ার প্রত্যয় নিয়ে ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্র্য-দুর্নীতিমুক্ত, সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন। অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বলেন, বাংলাদেশ তার সকল সমস্যা ও সংকট সত্ত্বেও উন্নয়নের ধারায় যে অনেক ধাপ এগিয়ে গেছে সে ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। তবে উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে সম্পদের ন্যায়পূর্ণ বণ্টন নিশ্চিতের মাধ্যমে বৈষম্য দূর করতে হবে এবং সামাজিক ও পরিবেশগত সমস্যা সমাধানের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। শুক্রবার ‘লেখক বলছি’ অনুষ্ঠানে নিজেদের নতুন বই নিয়ে আলোচনা করেন জি এইচ হাবীব, শাহেদ কায়েস, শিল্পী রহমান এবং সুহান রিজওয়ান। কবিকণ্ঠে কবিতাপাঠ করেন মিনার মনসুর, শিহাব সরকার, আনিসুল হক এবং শেখর বরণ দাশ। আবৃত্তি পরিবেশন করেন আবৃত্তিশিল্পী ভাস্বর বন্দ্যোপাধ্যায় এবং মোঃ জালাল উদ্দিন হীরা। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে ছিল ফকির সিরাজের পরিচালনায় সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘ঋষিজ শিল্পীগোষ্ঠী’র পরিবেশনা। সঙ্গীত পরিবেশন করেন কণ্ঠশিল্পী ফকির আলমগীর, কল্যাণী ঘোষ, বুলবুল মহলানবীশ, মহাদেব ঘোষ, সমর বড়ুয়া এবং নাহিদ নাজিয়া। আজকের মেলা : আজ শনিবার গ্রন্থমেলার ২১ম দিন। মেলা চলবে বেলা ১১টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত। বেলা ১১টা থেকে বেলা ১টা পর্যন্ত মেলায় থাকবে শিশুপ্রহর। বেলা ১১টায় শিশু-কিশোর চিত্রাঙ্কন, আবৃত্তি ও সঙ্গীত প্রতিযোগিতায় বিজয়ীদের পুরস্কার প্রদান করা হবে। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করবেন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব আসাদুজ্জামান নূর। বিকেলে অনুষ্ঠিত হবে শামসুজ্জামান খান সম্পাদিত ‘বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ : বহুমাত্রিক বিশ্লেষণ’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ পাঠ করবেন মফিদুল হক। আলোচনায় অংশ নেবেন ড. সোনিয়া নিশাত আমিন, গোলাম কুদ্দুছ এবং মামুন সিদ্দিকী। সভাপতিত্ব করবেন ড. মুহাম্মদ সামাদ। সন্ধ্যায় রয়েছে কবিকণ্ঠে কবিতাপাঠ, আবৃত্তি এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।
×