ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

রাকিব হত্যারহস্যের জট আট মাসেও খোলেনি

প্রকাশিত: ১০:০২, ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২০

 রাকিব হত্যারহস্যের জট আট মাসেও খোলেনি

আজাদ সুলায়মান ॥ রাজধানীর তেজগাঁওয়ে একটি হত্যা মামলার রহস্য আট মাসেও উদঘাটন হয়নি। নিহতের বাবা থানা থেকে পিবিআই, শেষ পর্যন্ত আইজিপির কাছে নালিশ করেও কোন প্রতিকার পাননি। উল্টো পুলিশের শাসানিতে বাদীর পরিবারই এখন হুমকির মুখে। নিরূপায় হয়ে গণমাধ্যমকে শেষ ভরসা ধরে ছুটে বেড়াচ্ছেন এক হাউস থেকে আরেক হাউসে। তার বিশ্বাস, প্রভাবশালী আসামির কাছে পুলিশ ধরাশায়ী হওয়ায় এ হত্যারহস্য উদঘাটনে পুলিশ নিষ্ক্রীয়। বাদী দিল মোহাম্মদ খান বলেন, তার একমাত্র ছেলে ইরফান খান রাকিব হত্যার কথা পুলিশ যেখানে স্বীকারই করতে চায় না, সেখানে কীভাবে বিচারের আশা করা যায়। তেজগাঁও জোনের পুলিশ কর্মকর্তারা দুর্ঘটনাস্থল ও মামলার এজাহারও পাল্টে দিয়েছেন। পুলিশ এখন একে দুর্ঘটনা হিসেবে সাজানোর চেষ্টা করছে। অথচ ঘটনাস্থলে দুর্ঘটনার কোন তথ্য প্রমাণাদি নেই পুলিশের কাছেও। এমন তুঘলকি কায়দায় চলছে এ হত্যাকা-ের তদন্ত। অভিযোগের প্রতিকার চেয়ে আইজিপি বরাবর আবেদন করেছেন দিল মোহাম্মদ খান। এ ঘটনায় প্রথমে তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানায় মামলা দায়ের করার একদিন পর তা পাঠানো হয় হাতিরঝিল থানায়। ওই মামলা নিয়ে দুই থানা পুলিশের বক্তব্যেও রয়েছে গরমিল। মামলাটি বর্তমানে তদন্ত করছে পিবিআই। মামলার এজাহার ও নিহতের পারিবারিক ভাষ্য থেকে জানা গেছে, গতবছরের ৬ জুলাই রাত আটটার দিকে সিদ্ধেশ্বরীর খন্দকার গলির ৩৫/৩৬ নম্বর হোল্ডিংসের কল্পছায়া এ্যাপার্টমেন্ট থেকে সাদারঙের একটি প্রাইভেট কার নিয়ে বের হয় রাকিব (১৬)। সে মগবাজারের ন্যাশনাল ব্যাংক পাবলিক স্কুলের দশম শ্রেণীর ছাত্র। রাকিবই গাড়ি চালাচ্ছিল। এরপর তার সঙ্গে মিলিত হয় সাদী রাফিন সাবাব জয়সহ আরও পাঁচ ছয়জন। এদের মধ্যে সাদী মগবাজারের কোন একটি স্থান থেকে রাকিবের গাড়িতে ওঠে। অন্যরা নিজেদের গাড়ি নিজেরাই চালাচ্ছিল। তারা তিন শ’ ফুট রোডে গিয়ে উচ্চগতিতে গাড়ি চালায়। সেখানে আড্ডা শেষে হাতিরঝিলের উদ্দেশে রওনা দেয়। মগবাজার ফ্লাইওভার দিয়ে বেইলী রোডে অফিসার্স ক্লাবের সামনে আসার পর রাকিব অসুস্থবোধ করলে গাড়ির স্টিয়ারিংয়ে বসে সাদী। রাত দশটার দিকে অফিসার্স ক্লাব থেকে সাদী রাফিন ও সাবাব তিনটি প্রাইভেট কারে মগবাজার ফ্লাইওভার দিয়ে রওনা দেয়। ফ্লাইওভারের তেজগাঁও সাতরাস্তা প্রান্ত দিয়ে রাকিবের প্রাইভেট কারটি নামার পর স্থানীয়রা দেখতে পায় গাড়ির সামনের দিকে বাঁ পাশের অংশ চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গেছে। বিজিপ্রেসের কাছে পথচারীরা গাড়িটি ধাওয়া করে। একপর্যায়ে গাড়িটি আটকের পর পুলিশ গিয়ে সেখান থেকে রাকিবকে রক্তাক্ত অবস্থায় ও সাদীকে অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার করে। রাকিবকে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেয়ার পর চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। এ ঘটনায় রাকিবের বাবা দিল মোহাম্মদ খান বাদী হয়ে রাকিবের বন্ধু জয় সাদী রাফিন সাবাবসহ অজ্ঞাতনামা বেশ ক’জনকে আসামি করে হত্যা মামলা দায়ের করতে চাইলে তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানা পুলিশ তাতে বাধা দেয়। তারা নিজেদের এজাহার লিখে দিয়ে তার স্বাক্ষর নেয়। এরপর দ-বিধির ২৭৯ , ৩০৪/খ ও ৩৩৮ ধারায় একটি মামলা রেকর্ড করে। রাকিবের মৃত্যুকে কিছুতেই দুর্ঘটনা হিসেবে গ্রহণ করেনি তার পরিবার। তাকে উদ্ধার থেকে শুরু করে দুর্ঘটনার কবলেপড়া গাড়ি ও দুর্ঘটনার স্থান নিয়ে শুরু থেকেই প্রশ্ন ছিল রাকিবের মা বাবার। ঘটনার পরদিন রাকিবের বাবা দিল মোহাম্মদ খান তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানায় একটি অভিযোগ দায়ের করেন। পুলিশ বিষয়টি তদন্ত করে দেখতে পায় মগবাজার ফ্লাইওভারের ওপর অকুস্থলটি হাতিরঝিল থানার মধ্যে। তাই অভিযোগটি তারা হাতিরঝিল থানায় পাঠিয়ে দেয়। তবে রাকিবের বাবার অভিযোগ, হাতিরঝিল থানায় মামলাটি অন্তর্ভুক্তির সময় এর অভিযোগে পরিবর্তন করা হয়েছে। মামলায় রাফিন ছাড়াও অজ্ঞাত দুই বন্ধুকে আসামি করা হয়। এছাড়া জয় নামে এক বন্ধু রাকিবকে হত্যার হুমকি দিয়েছিল। এসব বিষয় এজাহার থেকে বাদ দেয়া হয়। এরপর ৮ মাস পেরোচ্ছে। কিন্তু মামলার তদন্তে বিন্দুমাত্র অগ্রগতি নেই। পুলিশও নিশ্চিত করতে পারেনি এটা দুর্ঘটনা, নাকি হত্যাকা- ? এ অবস্থায় মামলার বর্তমান তদন্ত সংস্থা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। এ ঘটনায় জনকণ্ঠের পক্ষ থেকে তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল, হাতিরঝিল থানা, পিবিআই ও ট্রাফিক বিভাগের সঙ্গে আলোচনা করে দুর্ঘটনার পক্ষে কোন ধরনের তথ্যপ্রমাণাদি পাওয়া যায়নি। বরং এটা যে পরিকল্পিত হত্যাকা- সে ধরনেরই কিছু আলামত ও ঘটনাপ্রবাহ পাওয়া যায়। এ বিষয়ে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ওই রাতে মগবাজার ফ্লাইওভারের কোন ধরনের দুর্ঘটনা ঘটেনি। রাকিবের মা-বাবার কথায়, দুর্ঘটনার খবর পেয়ে যখন এই পথ দিয়ে সাতরাস্তার দিকে যাচ্ছিল, তখনও দুর্ঘটনার কোন আলামত তাদের নজরে পড়েনি। এমনকি ভোরবেলা যখন তারা দুর্ঘটনার আলামত দেখতে আসেন তখনও কোন চিহ্ন তাদের নজরে আসেনি। গাড়ির সামনের বাঁ দিকের অংশ যেভাবে চূর্ণবিচূর্ণ হয়েছে তাতে রাকিবের শরীরের বিভিন্ন স্থানে কেটে যাওয়ার কথা। কিন্তু লাশ উদ্ধারের সময় তার নাক মুখে সামান্য জমাটবাঁধা রক্ত দেখা গেছে। এ ধরনের জখম হলে মাত্র আধাঘণ্টার মধ্যে কারও রক্ত জমাট বাঁধার কথা নয়। এমনকি গাড়িটি যেহেতু সাদী চালাচ্ছিল। তার শরীরের কোথাও কোন কাটা দাগ বা কোন ক্ষতচিহ্ন ছিল না। সাংবাদিকরা যখন থানায় সাদীর সঙ্গে কথা বলছিলেন তখন তার গায়ের জামাটাও ছিল বেশ ফ্রেশ। দুর্ঘটনার কোন আলামত ছিল না। জামা ছেঁড়া দূরের কথা একটু দাগও ছিল না। শুধু নাকের ওপর সামান্য একটা পট্টি লাগানো ছিল। যেভাবে গাড়িটি দুমড়েমুচড়ে চুরমার হয়ে গেছে তাতে সাদীর বেঁচে থাকারই কথা নয়। রাকিব মারা গেলে তো সাদীরও মরে যাওয়ার কথা। এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর ট্রাফিক পুলিশের উপ-কমিশনার মফিজ জানান, ওই রাতে মগবাজারের ফ্লাইওভারে কোন সড়ক দুর্ঘটনার খবর পুলিশের খাতায় রেকর্ড নেই। শুধু ৭ তারিখের একটা মামলায় দুর্ঘটনার কথা উল্লেখ করা হয়েছে, যার বাদী রাকিবের বাবা। হাতিরঝিল পুলিশের ভাষ্যমতে, দুর্ঘটনায় প্রাইভেট কারটির ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। পুলিশ গাড়িটি জব্দ করে তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানায় রাখে। গাড়ির পেছনের ডান পাশের সিটে পা রাখার স্থানে জমাটবাঁধা রক্ত ছিল। অথচ বলা হচ্ছে, রাকিব সামনের সিটে বসেছিল। কিন্তু দেখা গেছে, ওই স্থানে কোন রক্ত ছিল না। অন্যদিকে সাদী ও রাফিন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দীতে জানায়, ফ্লাইওভারের ওপর ট্রাকের ধাক্কায় প্রাইভেট কারের বাঁ পাশ ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যায়। এতে রাকিব মারা যায়। স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দীতে উল্লেখ করা দুর্ঘটনাস্থল মগবাজার ফ্লাইওভারের পাশের মর্ডান হারবাল গ্রুপের কার্যালয়। এখানকার কর্মচারী জালাল জমাদার জানালেন, যে সময় দুর্ঘটনার কথা বলা হচ্ছে, সে সময় তারা তাদের কক্ষেই ছিলেন। একটি গাড়ির সঙ্গে আরেকটি গাড়ির সংঘর্ষ ও মানুষ মারা যাওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি হলে তাদের নজর এড়াত না। বিজিপ্রেসের সামনে প্রাইভেট কারটি যেখানে জনতা ধাওয়া করে আটক করে, সেখানকার প্রত্যক্ষদর্শী চা দোকানি অনিক জানান, ভাঙ্গা গাড়ি নিয়ে ফ্লাইওভার থেকে নামার সময় জনতা ধাওয়া দিয়ে রাকিবের গাড়িটি থামায়। এ সময় রাকিবের বন্ধুরা তাকে রেখে পালিয়ে যাওয়ার সময় সাদী নামে একজনকে আটক করে পুলিশে সোপর্দ করে জনগণ। সেই রাতে এলাকায় কোন ধরনের দুর্ঘটনা ঘটেছিল কি না তা জানতে আমরা কথা বলি ফ্লাইওভারের পাশের ক’জনের সঙ্গে। তাদের একজন রফিক জানান, রাতে ফ্লাইওভারে যদি কোন ট্রাকের সঙ্গে ধাক্কা লেগে দুর্ঘটনা ঘটত তাহলে বিকট শব্দ হতো। আশপাশের লোকজন জড়ো হয়ে যেত। একটি ট্রাকের সঙ্গে দূরন্তগতির প্রাইভেট কার ধাক্কা লেগে দুর্ঘটনায় পড়লে সেখানে অনেক আলামত থাকত। ব্রিজের ওপর দাগ লেগে থাকত জোরে ব্রেক কষার কারণে। পাশের ডিভাইডার ভেঙ্গে যেত। এসব কিছুই মেলেনি। এছাড়া ওই ওভারব্রিজের আগাগোড়া সবটুকুই রয়েছে সিসি ক্যামেরা আওতাভুক্ত। যা পুলিশ ইচ্ছে করলে সংগ্রহ করতে পারত। কমপক্ষে পনেরো দিন পর্যন্ত ওই ক্যামেরাগুলোর ফুটেজ সংরক্ষণ থাকলেও পুলিশ সংগ্রহ করেনি। এ সম্পর্কে ট্রাফিক পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, তর্কের খাতিরে তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল ও হাতিরঝিল থানা পুলিশের ভাষ্য মতে এটা দুর্ঘটনা হিসেবে ধরে নিলেও প্রশ্ন ওঠে তাহলে তো সবার আগে ও সে রাতে বা সকালে ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করার কথা। পুলিশ কেন তা করেনি, সেটাই বড় প্রশ্ন ? রাকিবের মায়ের দাবি এটা পরিকল্পিত হত্যাকান্ড। কিন্তু কেন তাকে হত্যা করা হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, রাকিবের বন্ধু জয় সাদী রাফিন ও সাবাব ইয়াবাসেবী, ব্যবসায়ী। তারা ঘটনার মাসখানেক আগেও রাকিবকে হত্যার হুমকি দিয়েছিল। রাকিব তাদের কথামতো চলত না বলেই অত্যন্ত ঠান্ডা মাথায় সাদীর নেতৃত্বে হত্যা করে সড়ক দুর্ঘটনার নাটক সাজায় পুলিশ। রাকিবের মৃত্যু হত্যা, নাকি দুর্ঘটনাজনিত সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের ডাক্তার বলেন, মরদেহে রক্তক্ষরণের প্রমাণ মিলেছে এমনভাবে যা হত্যা ও দুর্ঘটনা দুটোই হতে পারে।
×