আমরা বঙ্গবন্ধু মুজিবের পরিচয়ে পরিচিত। আমরা শেখ হাসিনার আলোয় আলোকিত। পিতা বাঙালীর জাতি-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে গেছেন কন্যা পিতার পদাংক অনুসরণ করে বাংলাদেশকে এমন এক উচ্চতায় তুলে এনেছেন যেখান থেকে নিচে তাকালে বড় বড় অর্থনীতির শক্তিকে দেখা যাবে।
আমাদের তো কোন পরিচয় ছিল না। আমরা হাজার বছরের বাঙালী হয়েও এর কোন স্বীকৃতি ছিল না। আমরা ১৯৭১ সালের আগে পাকিস্তানী ছিলাম না বাঙালী ছিলাম জানতাম না। জানতাম শুধু আমরা ইস্ট পাকিস্তানী। তারাও বহু আগে থেকে আমরা পথে পথে ঘুরেছি, বনে জঙ্গলে ঘুমিয়েছি, নদীতে ভেলা ভাসিয়েছি নিজের এতটুকু ভূখ- আবিষ্কার করতে পারিনি। কে আমাদের দেবে ভাষা, কে দেবে দেশ, শত শত বছর আমরা এর পিছনে দৌড়েছি, কোন লাভ হয়নি কিন্তু আমরা যেখানে পেরেছি লড়াই করেছি, যদিও সে লড়াই ধরে রাখতে পারিনি। একজন মাত্র মানুষ উঠে দাঁড়ালেন, চিৎকার করে বললেন :
-ভায়েরা আমার
- আমি শেখের বেটা বলছি
-আমি শেখ মুজিব বলছি
-আমি মুজিব ভাই বলছি
- জাগো
-উঠে দাঁড়াও
- সাত কোটি মানুষকে দাবায়া রাখতে পারবা না
মুহূর্তের মধ্যে সাত কোটি নিরস্ত্র মানুষ সশস্ত্র হয়ে উঠল এবং এক রাতের মধ্যে সবাই এক কাতারে দাঁড়ালেন, প্রশ্ন করলেন :
- কে আমি
- আমরা কারা
- কি আমাদের পরিচয়
বজ্রকণ্ঠে উত্তর এলো
- তোমরা ইতিহাসের সন্তান
- তোমরা ভলগা পাড়ের জেলে
- তোমরা চর্যাপদ
-তোমরা লুইপা
- তোমরা কাহ্নপা
- তোমরা বিদ্যাপতি
- তোমরা চন্ডীদাস
- তোমরা শাওতাল বালি
-তোমরা আলাওল
-তোমরা মুকুন্দদাশ
- তোমরা ঈশ্বরগুপ্ত
- তোমরা জীবনানন্দদাশ
- তোমরা মীর মশাররফ
-তোমরা মধুকবি মাইকেল
-তোমরা রাজা রামমোহন রায়
- তোমরা বিদ্যাসাগর
- তোমরা তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
- তোমরা শরতচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
-তোমরা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
- তোমরা কাজী নজরুল ইসলাম
- তোমরা নেতাজি
- তোমরা সি আর দাশ
- তোমরা শেরে বাংলা
- তোমরা শহীদ সোহরাওয়ার্দী
- তোমরা মাওলানা ভাসানী
- তোমরা হাজী শরীয়তুল্লাহ
-তোমরা মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী
- তোমরা ইসমাইল হোসেন সিরাজী
- তোমরা জয়নুল আবেদীন
-তোমরা জসীমউদ্দীন
- তোমরা মাস্টারদা সূর্যসেন
- তোমরা তিতুমীর
- তোমরা ঈশা খাঁ
- তোমরা শমসের গাজী
-তোমরা ওস্তাদ বড়ে গোলাম আলী খাঁ
-তোমরা আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু
- তোমরা অতীশ দীপঙ্কর
- তোমরা রানী ভবানী
- তোমরা নবাব সিরাজ
- তোমরা বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত
-তোমরা বেগম সুফিয়া কামাল
- তোমরা জাহানারা ইমাম
- তোমরা প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার
- তোমরা শেখ হাসিনা
- তোমরা জয়বাংলা
- তোমাদের মৃত্যু নেই
তার পরের ইতিহাস আমাদের সবার জানা। রাষ্ট্রভাষা বাংলার আন্দোলনই প্রথমবারের মতো বাংলার ঘরে ঘরে কুঁড়েঘরে এমনকি গ্রামীণ কুলবধূদের রান্নাঘরে পর্যন্ত পৌঁছে যায়। মানুষ অধিকার সচেতন হয়। তারা বুঝতে পারে তাদের ভাত-কাপড়ের অধিকারের সঙ্গে সঙ্গে কথা বলার অধিকারও থাকতে হবে, নইলে ভাত কাপড় শিক্ষা চিকিৎসা বাসস্থানের অধিকারও হারিয়ে যাবে। তাইতো প্রথমে যেসব বঙ্গসন্তান জীবন দান করলেন :
- ভাষাসৈনিক রফিক
-ভাষাসৈনিক শফিক
- ভাষাসৈনিক সালাম
-ভাষাসৈনিক বরকত
-ভাষাসৈনিক জব্বার
এবং নাম-না-জানা আরও অনেকে।
১৯৪৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর রাষ্ট্রভাষা বাংলার আন্দোলনের কার্যকর সূচনা হয়েছিল যার নেতৃত্বে ছিলেন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালী স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের জাতির পিতা বাঙালীর রাষ্ট্রপিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সেইতো শুরু। তিনি বার বার কারাগারে গেলেন অনশন করলেন আন্দোলন থামল না বরং আরও বেগবান হতে থাকল বাধার বিন্ধ্যাচল ভেঙ্গে ভেঙ্গে। সেদিন বঙ্গবন্ধুর সহযাত্রীর মধ্যে একজন ছিলেন তার নাম ছিল অলী আহাদ যার কন্যা এখন ব্যারিস্টার সংসদ সদস্য। সংসদে দাঁড়িয়ে অবলিলায় মিথ্যে বলে যাচ্ছে। সবাই খুব ইনজয় করে। অলি আহাদ সাহেব রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে পরবর্তী আন্দোলন সংগ্রামে বঙ্গবন্ধুর বিরোধিতা করতে করতে এক পর্যায়ে আন্দোলন থেকে ছিটকে পড়েন এবং শেষ পর্যন্ত বিতর্কিত রাজনৈতিক নেতা হিসেবে চিহ্নিত হন। কন্যার কথাবার্তায় সেই ক্ষোভ পরিলক্ষিত। এমনকি কেউ কেউ ভেবেছিলেন মজলুম জননেতা মাওলানা ভাসানী থেকে বেরিয়ে এসে বঙ্গবন্ধু হারিয়ে যাবেন। কিন্তু দেখা গেল বঙ্গবন্ধুই টিকে গেলেন এবং এত ভালভাবে টিকলেন যে বিশ্ব অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল। বঙ্গবন্ধু যখন তার ঐতিহাসিক ছয় দফা দিলেন তখন আতাউর রহমান খানকেও অনুরোধ করেছিলেন ছয় দফা নিয়ে এগিয়ে যেতে। খান সাহেব সেদিন না-কি বলেছিলেন ‘তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছে’ এ-তো নিজের কল্লাটা পাকিস্তানীদের তলোয়ারের নিচে বাড়িয়ে দেয়া। বঙ্গবন্ধু রবীন্দ্রনাথের কবিতার লাইন ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলোরে’। জীবনের ঝুঁকি নিলেন বার বার মৃত্যুর মুখে পতিত হলেন, তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে পাকিস্তানের মিয়ানওয়ালি কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে যেখানে তাকে দেখিয়ে কবর পর্যন্ত খোড়া হয়েছিল। পাকিস্তানের ২৩ বছরের মধ্যে ১৩ বছরেই কারাগারে কাটিয়েছেন কিন্তু বাঙালীর মুক্তি ও স্বাধীনতার লক্ষ্য এতটুকু বিচ্যুত হননি। আমাদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার স্বাধিকার ও স্বাধীনতা দিলেন, বাঙালীর স্বাধীন জাতি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে দিলেন। যে ১৩ বছর তিনি কারাগারে কাটিয়েছেন মনে হয় একটি মুহূর্তও অযথা নষ্ট করেননি। ডায়রি লিখেছেন, তারই ফলশ্রুতিতে আমরা পেলাম ইতিহাস ও সাহিত্যের এক অনন্য ভা-ার। যেমন ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ ‘কারাগারের রোজনামচা’ এ দুটি ছাড়াও সম্প্রতি বেরিয়েছে চীন সফরের অভিজ্ঞতা ওপর মূল্যবান প্রামাণ্য গ্রন্থ। এই গ্রন্থগুলোর সাহিত্যমূল্য বিচার করলেও বিশ্বসাহিত্যের পর্যায়ে পড়ে।।
বিএনপি এ ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর আপোসহীন বৈশিষ্ট্য খালেদা জিয়ার গায়ে সেঁটে দিয়ে যে কাজটি করলেন কাকের গায়ে ময়ূর পুচ্ছ গুজলেন। দেখা গেল তিনি ময়ূর হতে গিয়ে কাকের চেয়েও অধম হলেন, যে কারণে তাকে আজ কারাগারে কাটাতে হচ্ছে।
একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ। রাস্তাঘাট নেই, পুলভার্ট মুক্তিযোদ্ধারাই উড়িয়ে দিয়েছে গেরিলা কৌশল হিসেবে, যত্রতত্র বিস্ফোরক মাইন। বঙ্গবন্ধু মাত্র তিন মাসে ভারত ও রাশিয়ার সহযোগিতায় সব সচল করলেন। ভারতের মহীয়সী প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী কেবল যে যুদ্ধে আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছেন তা-ই নয় পাশাপাশি যুদ্ধ করেছেন এবং বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত করার জন্য সমস্ত বিশ্ব ঘুরে বেরিয়েছেন এবং শেষ পর্যন্ত সফল হয়েছেন। বঙ্গবন্ধু ১৯৭২-এর ৮ জানুয়ারি পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে ব্রিটিশ এয়ারওয়েজ করে লন্ডন দিল্লী হয়ে ১০ জানুয়ারি ঢাকায় ফেরেন। স্বাধীনতা পূর্ণতা লাভ করল। ঐতিহাসিকদের মতে এই ১০ জানুয়ারিই হলো আমাদের আজকের মধ্যম আয়ের তথা সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার ভিত্তি। যার পথ বেয়ে কন্যা শেখ হাসিনা আজকের বিশ্ব শ্রেষ্ঠ প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রনেতা, দেশকে আজকের পর্যায়ে তুলে এনেছেন।
হাসি পায় যখন শুনি উন্নয়ন হলে কি হবে গণতন্ত্র নাই। বিএনপি নেতাদের সঙ্গে এই কোরামে অংশ নেন কতিপয় লাল পাঞ্জাবি পরা এনজিও ব্যক্তিত্ব বা বিএ এমএ পাস মাস্টার বুদ্ধিজীবী। এরা গণতন্ত্রের মানে জানে না তা নয়, আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে বলার কিছু নেই তাই গণতন্ত্রের পথ ধরে উঠতে চাচ্ছে। আমি মনে করি, আমরা অর্থাৎ বঙ্গবন্ধুর ভাষায় ‘আমার গরিব দুঃখী মানুষ’ ভাত খেতে পারছে, সুন্দর সুন্দর কাপড় পরতে পারছে এরচেয়ে বড় গণতন্ত্র আর কী হতে পারে? বস্তুত বাংলাদেশে এই গণতন্ত্র অর্থাৎ ভাতের গণতন্ত্র বেশি প্রয়োজন ছিল, যা বঙ্গবন্ধুকন্যা অক্লান্ত পরিশ্রম করে সে প্রয়োজন মিটিয়েছেন, যে কারণে আমাদের প্রধানমন্ত্রী আজ বিশ্বনন্দিত দূরদর্শী রাষ্ট্রনেতা, অনেকেই যাকে অনুসরণ করছেন।
শেখ হাসিনার চলার পথও স্বাভাবিক ছিল না। অন্তত ২০ বার তাকে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে, ৩২ নম্বরের বাড়িতে পর্যন্ত বার বার গুলি চালানো হয়েছে, চট্টগ্রাম, নাটোর, বঙ্গবন্ধু এভিনিউ, রাসেল স্কয়ার তার ওপর গুলিবর্ষণের চিত্র কল্পনা করলে আজও গা শিউরে ওঠে। কি বীভৎস সেই সব দৃশ্য। আল্লাহর অশেষ কৃপা যে তিনি তাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন এবং তাকে দিয়ে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ে তোলার পথে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। কি নেই আমাদের এখন? যে পর্যটক ১০ বছর আগে বাংলাদেশ সফর করেছেন আজ এলে যেমন অবাক হবেন ঠিক আজ থেকে দু’বছর পর অর্থাৎ ২০২১ সালের পর এলে অন্য বাংলাদেশ দেখবেন, যে বাংলাদেশ উন্নত বিশ্বের কাতারে এমনকি ক্ষেত্রবিশেষ অনেক উন্নত দেশকে পেছনে ফেলে এগিয়ে চলেছে।
এই ভিত্তির ওপর আগামী ১৭ মার্চ থেকে ২০২১ এর ১৭ মার্চ মুজিববর্ষ এবং তারপর ২৬ মার্চ ২০২১ স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি তথা সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনের আয়োজন করা হয়েছে। দেশব্যাপী ব্যাপক কর্মসূচীর মাধ্যমে দিবসটি উদযাপন করা হবে। ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি শ্রী প্রণব মুখার্জি মুজিববর্ষ উপলক্ষে আয়োজিত জাতীয় সংসদের বিশেষ অধিবেশনে ভাষণ দেবেন। আগামী ২২ ও ২৩ মার্চ সংসদের এই অধিবেশন অনুষ্ঠিত হবে। তাছাড়াও মুজিববর্ষ এবং স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে আয়োজিত কর্মসূচীতে অনেক বিদেশী অতিথি অংশ নিতে পারেন আশা করা হচ্ছে। এই উদযাপনের লক্ষ্য হলো দেশকে চেনা এবং এগিয়ে নেয়া। মুজিববর্ষ উদযাপনের মাধ্যমে জাতি নতুন করে বাংলাদেশকে আবিষ্কার করবে। একুশের শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এ লেখা শেষ করলাম।
ঢাকা- ২০ ফেব্রুয়ারি ঃ ২০২০
লেখক : সংসদ সদস্য
সদস্য, মুজিববর্ষ উদযাপন জাতীয় কমিটি
সাবেক সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক জাতীয় প্রেসক্লাব
[email protected]