ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

আমেরিকায় আ ’মরি বাংলা ভাষা

প্রকাশিত: ১২:১২, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২০

আমেরিকায় আ ’মরি বাংলা ভাষা

কী আনন্দ, কী আনন্দ, কী আনন্দ, দিবারাত্রি নাচে মুক্তি, নাচে বন্ধ– সে তরঙ্গে ছুটি রঙ্গে পাছে পাছে তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ এমন গানের ছন্দে ছন্দে ছন্দে এক পঞ্চদশী শাড়ির নীল আঁচল আকাশের দিকে উড়িয়ে নেচে চলছে নিউইয়র্কের কোনো মঞ্চে অথবা পথমেলায় কিংবা খোদ নগর সরকারের আয়োজিত উৎসবে। বারো মাস তেরো পার্বণের নগর বিশ্বের বাণিজ্যিক রাজধানীর বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে এমন অপরূপ দৃশ্য ইদানীং আর দুর্লভ নয়- দুর্লভ নয় মার্কিন দেশের অন্যান্য শহর কিংবা পাশের ক্যানাডাতেও। নিউইয়র্ক নগর বর্তমানে বাংলা ভাষা সাহিত্যের তৃতীয় কেন্দ্র। সেখানে আমেরিকান সংস্কৃতিতে জন্ম নিয়ে ইংরেজি ভাষা ও তার পারিপার্শ্বিকতায় বড় হয়ে ওঠা এই সব নবীন প্রজন্ম বোস্টন, লস এঞ্জেলেস, মেরিল্যান্ড, ফিলাডেলফিয়া ডালাস, আটলান্টা এরকম নানা স্থান থেকে বইমেলা ও নানান সম্মেলনে অংশগ্রহণ করতে এসে মঞ্চে বাংলা কবিতা আবৃত্তি করে, গান গায়। যে অসাধারণ দক্ষতায় তারা নৃত্য নাট্য থেকে ক্লাসিকাল নাচ অবধি পরিবেশন করে যায় সেটি দেখে সমগ্র দর্শককূলের হৃদয়টাই বিস্ময়ে যেন নাচে- ‘তাতা থৈথৈ’ ছন্দে। আসলে একটি গান দিয়েইতো বাংলাদেশ নামটির সঙ্গে আবেগময় পরিচয় ঘটেছিলো মার্কিন মানুষের। ১৯৭১ সালের বসন্তে বাংলার স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে নিউইয়র্ক নগরের খ্যাতনামা ‘মেডিসন স্কয়ার গার্ডেনে বিশ্বজোড়া খ্যাতির অধিকারী সেতার বাদক প-িত রবিশংকর ও বিটলস গিটারিস্ট জর্জ হ্যারিসন আয়োজিত তোলপাড় করা কনসার্টটির কথা মনে পড়ে। আমরা তখন অবরুদ্ধ নিজ দেশে থেকে দেশান্তরী হয়েছি, পালিয়ে বেড়াচ্ছি কিংবা লুকিয়ে আছি এককোনে। ১ আগস্ট তারিখে রবিবার দুপুর আড়াইটার থেকে শুরু হওয়া এই অনুষ্ঠান মানুষ শুনেছিলো রাত আটটা পর্যন্ত। তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে গণহত্যা এবং ভারতে আশ্রিত কোটি শরণার্থীদের পক্ষে আন্তর্জাতিক সচেতনতা বাড়াতে এবং ত্রাণ তহবিল সংগ্রহের জন্য এই অনুষ্ঠানটি আয়োজিত হয়েছিল। জর্জ হ্যারিসনের কণ্ঠের সেই গান ‘নাউ ইট মে সীম সো ফার ফ্রম হোয়ার উই অল আর ইট ইজ সমথিং উই ক্যান্ট নেগলেক্ট ’ ঐতিহাসিক মেডিসন স্কয়ার গার্ডেনের দেয়ালগুলোতে আজও বুঝি সেই স্মৃতি কথা গাঁথা হয়ে আছে। বর্তমান সময়ে হ্যারিসনের গানের বাণীটি একটু বদলে গেছে অনেক ‘নাউ ইট মে নট সীম সো ফার ফ্রম হোয়ার উই অল আর!’ দূরের দেশ নয়! আমরা জায়গা করে নিয়েছি আমেরিকার অন্তরে। এই নগরে আমাদের বসবাসের প্রথম লগ্নে বাংলাভাষার নাম জানাতো দূরে থাক বাঙালী জাতির নাম জানাতো তাদের সংখ্যাও তো অতি নগণ্য। পরিচিতিটা ছিল ভারতীয় হিসেবে এবং এই রকম সুবাদেই সহকর্মীদের কেউ কেউ জিজ্ঞাসা করতো -ডু ইউ স্পিক্ হিন্দি? শুরুতে এদেশের মাটিতে পা রাখবার পর উপমহাদেশের দুটি দেশের দোকানপাট অধ্যুষিত জ্যাকসন হাইটসে আমরা যেতাম চেনা শাক সবজি চাল ডাল কিনতে। তারপরেও ছিল দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোর মতো করে বিচ্ছিরি স্বাদের আলুর পুর দেওয়া সিংগাড়া খাওয়া এবং - একরকম হাড় জিরজিরে জিলাপির স্বাদ নিতে উপমহাদেশের দোকানপাটে বোঝাই ৭৪ স্ট্রিটে তখন একটি মাত্র দোকানে লাগানো বাংলায় সাইন বোর্ড মেঘনা- অন্যসব ভারতীয় বা পাকিস্তানী দোকানগুলোর প্রতিটির লেখা ইংরেজিতে। বর্তমান সময়ে বাংলা সাইন বোর্ডে সজ্জিত জ্যাকসন হাইটসে আমাদের সুস্বাদু সিঙ্গাড়া, সমুসা, রোল, কাবাব খেতে বাঙালি রেস্টুরেন্টগুলোতে এমন লম্বা ভিড় হয় দিন রাত ২৪ ঘণ্টা ধরে যে ক্রেতার সঙ্গে বিক্রেতাদের পাল্লা দেওয়া কঠিন। শুধুই দেশি মানুষতো নয় বাকি উপমহাদেশীয়রাও আছে- আছে আরো আরো দেশের মানুষ। এক সময়ের ভারতীয় পাকিস্তানী অনেক নামি রেস্টুরেন্টগুলোর পটল তোলা এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা। নব্বুই এর শুরু থেকে থেকে বিপুল পরিমাণ বাংলাদেশী মানুষ হুড়মুড় করে মার্কিন দেশে এসেছিলো ও পি ও ডি ভি ভিসার মাধ্যমে বৈধ ইমিগ্রান্ট হয়ে। তাদের এই আগমনই মূলত পুরোনো বর্ণহীন ছবিটিকে প্রতিটি ক্ষেত্রে কোথাও উল্টে পাল্টে কোথাও তছনছ করে গড়ে তুলে ছিলো বাংলার এক নতুন চিত্রপট। শুধু তাই নয় পাশাপাশি স্বাধীন বাংলাদেশের ভাষা সাহিত্য সংগীত নৃত্য যেন সুরের আগুন হয়ে আটলান্টিকের কিনারে কিনারে ছড়িয়ে যাবে আমেরিকার নানা রাজ্যে সেকথা কে জানতো! তারপর একদিন একটি যন্ত্র পাখি যেদিন রোদের গন্ধ ছড়ানো ডানার ওপর কি আশ্চর্য এক বর্ণমালা সাজিয়ে হাজার হাজার মাইল আকাশ পেরিয়ে থেমেছিল আমাদের নগর প্রান্তে। কত কত দেশের কত নামের আকাশ যানের পাশাপাশি তার নাম লেখা বাংলায় ‘বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স।’ সেদিনের বাঙালী হৃদয়ের উল্লাসের কথা আজও ভোলার নয়। এই সময়ে উপমহাদেশীয় পুরোনো দোকানপাটগুলোর অধিকাংশকেই প্রতিযোগিতায় হঠিয়ে গড়া হলো বাংলায় নাম লেখা গ্রোসারি, রেস্টুরেন্ট, ক্যাসেট সিডি বইয়ের দোকান, ট্রাভেল এজেন্সি ডক্টরস চেম্বার ইত্যাদি। ব্রুকলিনের চার্চ ম্যাকডোনাল্ড, এস্টোরিয়া এইসব বাঙালী বসবাসের জায়গাগুলোতেও একই সঙ্গে দোকানপাট তৈরি করেছিল বাঙালিরা। পরবর্তীতে জ্যাকসন হাইটস জয় করবার পর দুর্দান্ত সাহসে অপরাধ প্রবণ কালো মানুষের এলাকা জ্যামাইকায় ঘরবাড়ি কিনে বসতি স্থাপন করলো বাংলাদেশী প্রবাসী। দীর্ঘদিন ধরে বলা হতো বাঙালি জানেনা বাণিজ্য। কিন্তু সেই বাঙালি জ্যামাইকা অঞ্চলে বিভিন্ন এলাকায় ব্যবসা গড়ে তুললো জ্যাকসন হাইটসের চাইতে আরো বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে। এরপর সেটি একরকম অলক্ষেই এগিয়ে গেলো ব্রঙ্কস কাউন্টির স্টারলিং এভিনিউ এর বিশাল রাস্তায়- বাংলা বাজার নামে প্রসারিত হলো কুখ্যাত বন্দুকযুদ্ধের সঙ্গমস্থল ছিল যে ব্রঙ্কস। শুধু ব্যবসা বাণিজ্য দিয়েই নয় সেই সঙ্গে নিউইয়র্ক নগরে জায়গা করে নিলো সম্মানের - অধিকারেরও। বাংলা ভাষাকে নিকেশ করে উর্দুকে বাঙালীর ভাষা করবার জন্য ক্ষমতা গর্বী পাকিস্তানিদের প্রচেষ্টার অন্ত চলোনা। অথচ নিয়তির কি পরিহাস সেই ভাষাটি বাংলার সীমানা পেরিয়ে আজ ছড়িয়ে পড়েছে দুনিয়ার দেশে দেশে বিপরীতে সারা দুনিয়া থেকে একরকম ঠাঁইহীন হয়ে গেছে উর্দু ভাষা। এই নিউইয়র্ক নগরে পাঁচটি ভাষার সঙ্গে বাংলা আজ অন্যতম সরকারী ভাষা। আমাদের এলাকাটিতে বাঙালি তেমন নেই বললে চলে। তারপরেও দেখলাম একদিন আমাদের এলাকার কেন্দ্রটিতে ভোট দিতে গিয়ে সবিস্ময়ে দেখলাম দেয়ালের ওপর বাংলা অক্ষরে প্রিন্টেড সব পোস্টারে লেখা -‘এখানে ইতস্তত ঘোরাফেরা করবেন না’ এরপর তীর চিহ্ন দিয়ে লেখা ‘এই দিক দিয়ে ভোট কেন্দ্রে প্রবেশ করুন’ ইত্যাদি লেখা নিয়ে আরো কিছু -নির্দেশনা, বুথে প্রবেশ করে ব্যালট পেপার হাতে নিয়ে আরো হতবাক ইংরেজি ভাষার সঙ্গে সেখানে আছে বাংলা, চাইনিজ কোরিয়ান, স্প্যানিশ ও হিন্দি। এই ভাষাগুলো এখন সর্বত্র নগর সরকারের স্বীকৃত ভাষা। সিটির কিছু কিছু স্কুলে সেকেন্ড ল্যাঙ্গুয়েজে হিসেবে বাংলা পড়ানো শুরু হয়েছে। এমন কি একদিন হঠাৎ হাওয়ার মতো পাবলিক লাইব্রেরীগুলোতেও বাণী হয়ে এলো -‘উই স্পিক ইন ইওর ল্যাঙ্গুয়েজ’- সেখানে বাংলাসহ এই পাঁচ ভাষার নাম। বর্তমান সময়ে প্রতিটি সরকারি দপ্তরে এই কথাগুলো লেখা আছে। নামি দামি অনেক মার্কিন ফার্মসিতে বাংলায় লিখে রাখা হয়েছে : আমরা বাংলায় কথা বলি। প্রসঙ্গক্রমে বলি বহু আগে থেকে নিউইয়র্ক সিটির কুইন্স বরোর সেন্ট্রাল লাইব্রেরিতে সমস্ত বাংলাভাষীর জন্য বাংলা ভাষার গল্প উপন্যাসসহ নানান পত্রপত্রিকা ইত্যাদির একরকম বিশাল সংগ্রহ। ডজনেরও বেশি বাংলা সাপ্তাহিকী। ব্যক্তি গত উদ্যোগে এই নগরে অনেক বছর ধরে পারফর্মিং আর্টসের রয়েছে বেশ কটি স্কুল। পিতা মাতার আগ্রহে উৎসাহে ছেলেমেয়েরা সেখানে নাচ গান কবিতা আবৃত্তি শেখে। পারফর্ম করে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে। শুধু আমাদের নগর জুড়েই নয় আমেরিকার নানান রাজ্য জুড়ে একুশে ফেব্রুয়ারির অনুষ্ঠানগুলোতে তারা সদলবলে গাইবে।
×