ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

ওয়াহেদ ম্যানশনের সামনে দোয়া, গণস্বাক্ষর সংগ্রহ ॥ চুড়িহাট্টা ট্র্যাজেডির এক বছর

প্রকাশিত: ০৯:৫৯, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২০

   ওয়াহেদ ম্যানশনের সামনে দোয়া, গণস্বাক্ষর সংগ্রহ ॥ চুড়িহাট্টা ট্র্যাজেডির এক বছর

স্টাফ রিপোর্টার ॥ পুরান ঢাকার চকবাজারের চুড়িহাট্টার অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার এক বছর পেরিয়ে গেলেও আজও ক্ষতিপূরণ পাননি নিহতের স্বজন ও ক্ষতিগ্রস্তরা। এক বছর পূর্তিতে বৃহস্পতিবার সকাল ৯টা থেকে সেই ওয়াহেদ ম্যানশনের সামনে ভিড় করতে দেখা যায় নিহতদের স্বজন এবং স্থানীয়দের। এছাড়া ঐক্যবদ্ধ সামাজিক সংগঠনগুলোর ব্যানারে ওয়াহেদ ম্যানশনের সামনে আয়োজন করেন দোয়া প্রার্থনার। একইসঙ্গে নিহতদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে কালো ব্যাচ ধারণসহ গণস্বাক্ষর গ্রহণ করা হয়। তাছাড়া জোহরের নামাজের পর ওয়াহেদ ম্যানশনে কোরান খতম করা হয়। এদিকে এদিন দুপুরে নগর ভবনে এক অনুষ্ঠানে চুড়িহাট্টায় আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত ৩১ পরিবারকে সহায়তা দিয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন (ডিএসসিসি)। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, বৃহস্পতিবার সকাল থেকে চুড়িহাট্টায় ওয়াহেদ ম্যানশনের সামনে এসে উপস্থিত হতে থাকেন অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় নিহতের আত্মীয়, স্বজন ও পরিবারের সদস্যরা। তারা হারানো স্বজনদের স্মরণে ছবি হাতে একত্রিত হন। জমায়েত হওয়া স্বজনদের মধ্যে অনেকে ওয়াহেদ ম্যানশনের মালিকের বিচারও দাবি করেন। অপরদিকে সকাল ৯টার দিকে ঐক্যবদ্ধ সামাজিক সংগঠনগুলোর ব্যানারে ওয়াহেদ ম্যানশনের সামনে আয়োজন করা হয় দোয়া প্রার্থনার। একইসঙ্গে নিহতদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে কালো ব্যাচ ধারণসহ গণস্বাক্ষর গ্রহণ করা হয়। এতে নিহতের স্বজনরা গণস্বাক্ষর কর্মসূচীতে একাত্মতা জানিয়ে স্বাক্ষর করতে দেখা যায়। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, এক বছর হয়ে গেলেও তারা কোন ধরনের সরকারী ও বেসরকারী সাহায্য এখনও পাননি। বেসরকারী ব্যাংকগুলোর অনুদানের ৩০ কোটি টাকাও তারা পাননি। নিহত জুম্মানের ছেলে রাশেদ হাসান, নিহত আব্দুর রহিমের ছোট ভাই এছাহাক আলী, নিহত সিদ্দিক উল্লাহর ছেলে আহসান উল্লাহসহ স্বজন হারানো অনেকেই গণস্বাক্ষরে কর্মসূচীতে স্বাক্ষর করেন। শুক্রবার সব ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে চুড়িহাট্টার অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় নিহতদের আত্মার শান্তি কামনা করে প্রার্থনার আহ্বান জানানো হয়েছে স্বজনদের পক্ষ থেকে। এদিকে নোয়াখালীর আহসান উল্লাহের বাবা সিদ্দিক উল্লাহ (৪৫) ওই ঘটনায় প্রাণ হারান। আহসান বলেন, চার ভাই, এক বোন আর মায়ের জন্য একমাত্র উপার্জনক্ষম ছিলেন আমার বাবা। বাবার মৃত্যুর পর আমার দুই ভাইয়ের পড়াশোনা বন্ধ করে কাজে লাগিয়ে দিয়েছি। প্রশাসন আমাদের বিভিন্ন রকম সহায়তা করবে বলেছিল। কিছুই পায়নি। আমাদের সঙ্গে কেউ যোগাযোগ করেনি। আমরাও চেষ্টা করে পারিনি। ওই দুর্ঘটনায় নিহত শাহীন মোল্লার (৪০) স্ত্রী ময়না বেগম জানান, সিটি কর্পোরেশন থেকে বলা হয়েছিল যে, নিহতের পরিবার থেকে স্বজনদের চাকরি দেয়া হবে। আমার পরিবারে তো আর কেউ নেই এক ছেলে ছাড়া। আমাকে বা ছেলেকে একটা চাকরি দিলে আমরা খেয়ে পরে থাকতে পারতাম। এই একটা বছর কিভাবে চলছি আমরা জানি। বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সহ-সভাপতি হাফেজ হারুন জানান, চুড়িহাট্টা অগ্নিকাণ্ডের একবছর হয়ে গেল। ঘটনার পর সরকারী-বেসরকারী কত সংস্থা এখানে এসেছে। তারা বিভিন্ন সময় আশ্বাস দিয়েছে, কিন্তু কিছুই হয়নি। এখনও অগ্নিকাণ্ডের দায়ীদের আইনের আওতায় আনা হয়নি। তিনি জানান, নিহত অনেকের স্বজনরা এখনও চাকরির জন্য দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন, কিন্তু চাকরি পাচ্ছেন না। হাফেজ হারুন জানান, চুড়িহাট্টা অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় যারা নিহত, আহত হয়েছেন, যে পরিবারগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, সরকারের কাছে তাদের জন্য সাহায্য-সহযোগিতা করার আকুল আবেদন জানাচ্ছি। সকাল থেকে ওয়াহিদ ম্যানশনের সামনে একটি টেবিলে গণস্বাক্ষরের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সেখানে এলাকাবাসী ও পথচারীরা গণস্বাক্ষর করছেন। সেই সঙ্গে তাদের একটি করে কালো ব্যাচ পড়িয়ে দেয়া হয়। গণস্বাক্ষরে জনমানুষের কয়েকটি দাবি উঠে এসেছে। কেউ লিখেছে, ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণের দাবি জানাচ্ছি, দোষীদের শনাক্তের দাবি। আবার কেউবা লিখেছেন, পুরান ঢাকায় কেমিক্যাল গোডাউন চাই না। স্থানীয়রা নিহতের আত্মার মাগফিরাত কামনার জন্য কোরান খতমের শেষে দোয়া অনুষ্ঠিত হয়। ক্ষতিগ্রস্ত ৩১ পরিবারকে সহায়তা পুরান ঢাকার চকবাজারের চুড়িহাট্টায় আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত ৩১ পরিবারকে সহায়তা দিয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন (ডিএসসিসি)। বৃহস্পতিবার দুপুরে নগর ভবনে এক অনুষ্ঠানে এসব পরিবারকে সহায়তা দেন মেয়র সাঈদ খোকন। সহায়তার অংশ হিসেবে ৩১ পরিবারের ২১ জনকে সিটি কর্পোরেশনে পরিচ্ছন্নকর্মী হিসেবে (মাস্টার রোল) নিয়োগপত্র দেয়া হয়েছে। চারজনকে দুই লাখ টাকা করে দেয়া হয়েছে। দুজনকে একটি দোকান বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। উচ্চ শিক্ষিত চারজনকে যোগ্যতা অনুসারে আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে চাকরি দেয়ার নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছে। অনুষ্ঠানে সাঈদ খোকন জানান, আমরা ৩১ জনের আবেদন পেয়েছিলাম। ওই আবেদনের ভিত্তিতে আজ তাদের সহায়তা দেয়া হলো। দুর্ঘটনার দিন আমি সিটি কর্পোরেশনের কর্মকর্তাদের নিয়ে অসহায় মানুষের পাশে ছিলাম। আমরা আপ্রাণ চেষ্টা করেছি জীবন বাঁচাতে, কিন্তু পারিনি। ১৫-২০ গজ দূরে দাঁড়িয়ে মানুষগুলোর পাশে ছিলাম। আমাদের চেষ্টার কোন কমতি ছিল না। আমার দায়িত্বের পাঁচ বছরে গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হয়েছে। এর মধ্যে চুড়িহাট্টার দুর্ঘটনা একটি। সাঈদ খোকন জানান, আগে জীবন, পরে জীবিকা। দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন জীবনের নিরাপত্তাকে অগ্রাধিকার দিয়েছে। পুরান ঢাকার ব্যবসায়ীদের নিয়ে বসেছি। আলাপ-আলোচনা হয়েছে, অগ্নিনির্বাপণ বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। আমরা যদি ঘটনা ভুলে যাই, তাহলে পুনরাবৃত্তি ঘটতে পারে। সব সময় সতর্ক থাকতে হবে। রাসায়নিক গুদামের কারণে সৃষ্ট ওই অগ্নিকাণ্ডের ভয়াবহতার কথা তুলে মেয়র খোকন জানান, চাইলেই পুরান ঢাকার রাসায়নিক গুদামগুলো বন্ধ করে দেয়া যায় না। ঢাকার বিভিন্ন নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের সরবরাহ হয় এখান থেকে। ঘটনার পরপর এগুলো বন্ধ করে দিলে তার নেতিবাচক প্রভাবও পড়বে। কিন্তু জীবনের আগে তো ব্যবসা নয়। জীবন আর জীবিকার সংগ্রামের সমন্বয় করতে আমরা চেষ্টা করছি। দ্রুত পুরান ঢাকা থেকে কেমিক্যাল গোডাউন সরানো গেলে ঝুঁকি কমবে। আশা করি, শিল্প মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে ভূমিকা রাখবে। গোডাউনগুলো স্থানান্তরের জন্য ইতোমধ্যে শিল্প মন্ত্রণালয়কে নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। তারা কাজ করছে। আমরা নিরাপদ ঢাকা শহর গড়ে তুলব। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, ২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে পুরান ঢাকার চকবাজারের চুড়িহাট্টায় আগুন লেগে ৭১ জন প্রাণ হারান। আগুনে পুড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ওই এলাকার কেমিক্যাল গোডাউনসহ বহু স্থাপনা। এই ঘটনায় ওয়াহেদ ম্যানশনের দুই ছেলেসহ অজ্ঞাত ১০-১২ জনকে আসামি করা হয়। ডিএমপি লালবাগ বিভাগের উপকমিশনার মুনতাসুরুল ইসলাম জনকণ্ঠকে জানান, মামলার আসামি হিসেবে থাকা ওয়াহেদ ম্যানশনের মালিকের দুই ছেলে জামিনে রয়েছেন। বাকি অজ্ঞাত ১০-১২ জনের মধ্যে ৩/৪ জনকে প্রাথমিকভাবে শনাক্ত করা হয়েছে। শনাক্তকৃতরা অগ্নিকান্ডের সঙ্গে কিভাবে জড়িত, সেটি নিশ্চিত হওয়ার চেষ্টা চলছে।
×