ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী

রাজনৈতিক উদ্যোক্তা ॥ বাংলার বন্ধু মুজিব

প্রকাশিত: ০৮:৪২, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২০

রাজনৈতিক উদ্যোক্তা ॥ বাংলার বন্ধু মুজিব

আজ একুশে ফেব্রুয়ারি। ভাষা আন্দোলনের এই দিনে সশ্রদ্ধচিত্তে স্মরণ করছি ভাষা শহীদদের। ভাষা আন্দোলনে শেখ মুজিবুর রহমানের দৃঢ় ভূমিকা এবং তাঁর নেতৃত্বে আমরা ভাষাভিত্তিক একটি রাষ্ট্র পেয়েছি। বঙ্গবন্ধুর অবদান বাংলা ভাষার জন্য অনস্বীকার্য। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বলা যায় রাজনৈতিক উদ্যোক্তা। বঙ্গবন্ধুকে সৃষ্টিশীলতার জন্য রাজনৈতিক উদ্যোক্তা হিসেবে অভিহিত করা যায় এ কারণে যে, তিনি ধারণা, চিন্তা-চেতনা, উদ্ভাবন ও প্রায়োগিক কলা-কৌশল বাস্তবায়ন করে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্মদানের পাশাপাশি এবং শাসক হিসেবে উৎকর্ষ ও মানবীয় গুণাবলীর উন্মেষ ঘটিয়েছেন। নীতিজ্ঞানবহির্ভূত কর্মকা- রোধ করে, মানব প্রত্যয়ে মুজিব রাজনীতির বিজ্ঞান-শিল্প ও কলা-কৌশলকে একই সূত্রে গেঁথে সকল বাধা বিদূরিত করে জাতিকে উন্নত করার প্রয়াস নিয়েছিলেন। তিনি ব্রিটিশ আমল থেকে ত্যাগী রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে সব সময় জনগণের পাশে থেকে তাদের মনস্তত্ত্ব, দর্শন চিন্তা, শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে একাত্ম হয়ে লড়াই করে গেছেন। তাঁর রাজনৈতিক দর্শন, রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, প্রচার, প্রশাসনিক দক্ষতা গুণে রাজনৈতিক সমস্যাগুলোর সমাধানকল্পে নতুন উপায় উদ্ভাবন ও বাস্তবায়নে আমৃত্যু সচেষ্ট ছিলেন। তিনি সময় উত্তীর্ণ একজন কালজয়ী নেতা, যিনি অন্যায়ের সঙ্গে আপোস করেননি। বীরত্বের সঙ্গে তিনি আমলাদের মোকাবেলা করেছেন। তাদের কখনও অযাচিতভাবে প্রশ্রয় দেননি। পাকিস্তানীরা যেমন তাঁর ভয়ে সর্বদা তটস্থ ছিল, যারা এদেশী তারাও কিন্তু তাঁকে ভালবেসে হাসিমুখে তাঁর পক্ষে কাজ করেছে। অবশ্য সব সময়ই যুগে যুগে বিশ্বাসঘাতক থাকে। তাদের বিশ্বাসঘাতকতা দেশ ও জাতির জন্য ক্ষতির কারণ। তারা জানে না শেখ মুজিবুর রহমানের মতো একজন মহান ব্যক্তিত্বের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করলে আখেরে তা বাঙালী জাতির জন্যই ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। বঙ্গবন্ধু তাঁর বোধ-বিচার-বিবেক দ্বারা পরিচালিত হয়ে সামাজিক সমস্যা, মানবিক ও অর্থনৈতিক সমস্যা সমাধানকল্পে সদূরপ্রসারী দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করে নানামুখী পদক্ষেপের মাধ্যমে ক্ষমতা প্রয়োগের ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন। এথেন্সের পাহাড়ের চূড়ায় যে গণতন্ত্রের সূচনা সেখানে নাগরিকরা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলেন যে, নগরীর সমস্যাসমূহ সমাধানকল্পে একটি কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ ও বাস্তবায়নের উদ্যোগ আবশ্যক। বঙ্গবন্ধুর জীবন যদি আমরা পর্যালোচনা করি তবে দেখা যায় যে, সব সময়ই তিনি হিত সাধন ও মঙ্গল যাচনা করেছেন, যাতে করে জনকল্যাণ সাধন করা যায়। বঙ্গবন্ধুর জীবনাদর্শ আমরা যদি পর্যালোচনা করি তবে দেখব- একদিকে তিনি যখন প্রতিবাদী ব্যক্তিত্ব ছিলেন তখন সংসবদ্ধভাবে নিয়ম-নীতির পক্ষে ছিলেন। কখনও অযথা ভাংচুর, জ্বালা-পোড়াও কর্মকান্ডে বিশ্বাসী ছিলেন না। বরং শান্তিপ্রিয়ভাবে শেষ সময়টুকু পর্যন্ত নিজের অস্তিত্ব ও কর্মকান্ডের মাধ্যমে রাজনীতির জটিল সম্পর্কগুলোকে ব্যক্তিগত স্নেহ-ভালবাসায় সমাধানে ব্রতী ছিলেন। যৌগিক কর্মকান্ডকে সরল রেখায় প্রকাশ করে মানুষের উন্নয়ন করেছিলেন ও উপকারে সচেষ্ট ছিলেন। রাজনৈতিক উদ্যোক্ত হিসেবে তিনি বিরল ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন। তিনি এমন ধরনের পণ্যসামগ্রী ও পরিষেবার ব্যবস্থা করেছিলেন যাতে করে মানুষের কল্যাণ হয়। রাজনৈতিক উদ্যোক্তা হিসেবে মুজিব সামাজিক সমস্যাগুলো সমাধানকল্পে তাঁর জীবন-যৌবনকে উৎসর্গ করেছিলেন। বাঙালীর স্বাধিকার প্রতিষ্ঠা থেকে স্বাধীনতার সৃষ্টি, বাংলা ভাষাভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা এবং বাঙালীর যে ক্ষমতা দীর্ঘকাল ধরে পরাধীনতার অর্গলে বাধা ছিল সেখান থেকে মুক্তির দিকনির্দেশনার ক্ষেত্রেও সবাইকে একত্রিত করে বহুমাত্রিক দল হিসেবে কাজ করার জন্য নেতৃত্ব প্রদানে পারঙ্গমতার পরিচয় দিয়েছিলেন। তিনি এমন এক বিরল মহামানব ছিলেন, যিনি কিনা রাজনৈতিক ব্যক্তি হিসেবে নতুন ধারণা, পদ্ধতি, সময়ের সদ্ব্যবহার ও বাঙালীর বিকাশ সাধনে সক্ষম হয়েছিলেন। বাঙালী জাতি হিসেবে কিভাবে উন্মেষ ঘটবে, বিভিন্ন বৈচিত্র্যমন্ডিত এবং আকর্ষণীয় চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে দ্বিতীয় ঔপনিবেশিক আমলের স্রষ্টা পাকিস্তানী বাহিনীর রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম এবং সে সংগ্রামের স্বরূপ উৎপাটিত করে কিভাবে স্বাধীনতা সংগ্রামকে বাস্তবায়ন করা যায় সেক্ষেত্রে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। তিনি দ্বিতীয় বিপ্লব অর্জনের যে প্রয়াস গ্রহণ করেছিলেন, তা বাস্তবায়ন করা গেলে দেশ ও জাতির মঙ্গল হতো। কিন্তু একটি সুযোগসন্ধানী ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রকারী গোষ্ঠী তাঁর দ্বিতীয় বিপ্লবের আকাক্সক্ষাকে ধূলিসাত করে দিল। একজন রাজনৈতিক উদ্যোক্তা হিসেবে মুজিব সব সময় স্বপ্ন দেখতেন। তাই তো ৩ জুন ১৯৭২ বাংলাদেশ জাতীয় সমবায় ইউনিয়নের অনুষ্ঠানে জাতির পিতা বলেন, ‘সমবায়ের মাধ্যমে গ্রাম-বাংলায় গড়ে উঠবে ক্ষুদ্র শিল্প, যার মালিক হবে সাধারণ কৃষক, শ্রমিক এবং ভূমিহীন নির্যাতিত মানুষ। ...কৃষকরা তাদের উৎপাদিত ফসলের বিনিময়ে পাবে ন্যায্যমূল্য, শ্রমিকরা পাবে শ্রমের ফল, ভোগের ন্যায্য অধিকার। ... আমাদের সমবায় আন্দোলন হবে সাধারণ মানুষের যৌথ আন্দোলন। বস্তুত দেশে যাতে শ্রম আন্দোলন গড়ে ওঠে, কৃষিজীবীরা ন্যায্যমূল্য পায় সেজন্য বঙ্গবন্ধু নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। সমবায়ের মাধ্যমে মানুষের ভাগ্য উন্নয়ন, সামন্ততান্ত্রিক পদ্ধতি থেকে মুক্তি, জুলুমবাজ-নির্যাতনকারীদের হাত থেকে হতভাগ্যদের ভাগ্য পরিবর্তনের ক্ষেত্রে কঠোর ও বাস্তবসম্মত প্রয়াস গ্রহণ করেন তিনি। তবে দুর্নীতিগ্রস্তরা সেদিনও তলে তলে নানাভাবে তাঁর শুভ প্রয়াসকে বাধাগ্রস্ত করেছে। এদের কেউ কেউ পরবর্তীতে গিরগিটির মতো রং পাল্টিয়ে মূল স্রোতধারায় ফিরে এলেও পেছন থেকে সদা সচেষ্ট ছিল ছুরিকাঘাত করতে। অথচ ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কালরাতে পাকিস্তানী ও তার দোসররা ধ্বংসলীলা শুরু করে। বঙ্গবন্ধুকে যখন পাকিস্তানীরা ধরে নিয়ে গিয়ে হত্যাও করতে পারে, তাতে ভীত না হয়ে বরং তিনি ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। ইংরেজীতে লিখিত বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণার ভাষা রূপান্তর করলে দাঁড়ায়, ‘পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনী অকস্মাৎ ২৬ মার্চের জিরো আওয়ারে পিলখানায় ইপিআর ও রাজারবাগস্থ পুলিশ বাহিনীর ওপর হামলা চালিয়েছে; কয়েক লাখ নিরস্ত্র মানুষকে হত্যা করেছে। ঢাকার সড়কে ইপিআর ও পুলিশ বাহিনীর সঙ্গে কঠিন লড়াই শুরু হয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য জনগণ শত্রু বাহিনীর বিরুদ্ধে বীরত্বের সঙ্গে লড়াই করছে। বাংলাদেশের প্রত্যেক স্থানে যে কোন মূল্যে শত্রু বাহিনীকে প্রতিরোধ করার জন্য দেশের সর্বস্তরের জনগণকে নির্দেশ দেয়া হলো। আল্লাহ যেন আপনাদের সহায় হোন।’ এক্ষেত্রে মুজিবের সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত, নিজেকে আড়াল করে মানুষের মঙ্গল করার তীব্র বাসনা এবং জানমালের যাতে ক্ষতি না হয়, বরং মানুষ যাতে নিরাপদে থাকতে পারে, প্রয়োজনে শত্রুপক্ষকে দমনের জন্য তৎপর হয় ও দেশকে স্বাধীন করতে তৎরপর হয়, সেজন্য নির্দেশনা ছিল। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের অনবদ্য ভাষণের জন্য নিউজউইক ম্যাগাজিন তাঁকে রাজনীতির কবি হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। আবার ইউনেস্কো ৭ মার্চের ভাষণকে ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে ৩০ অক্টোবর, ২০১৭ সালে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দিয়েছে। চতুর্থ সংশোধনী বিল ১৯৭৫-এর ২৫ জানুয়ারি সংসদের সপ্তম অধিবেশনের দ্বিতীয় বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, ‘সরকারী কর্মচারী-মন্ত্রী হই, প্রেসিডেন্ট হই আমরা যারা আছি, আমরা জনগণের সেবক, আমরা জনগণের মাস্টার নই। ... যাদের পয়সায় আমাদের সকলের সংসার চলে, যাদের পয়সায় আমাদের রাষ্ট্র চলে, যাদের পয়সায় আজ আমার এ্যাম্বেসি চলে, যাদের পয়সায় গাড়িতে চড়ি, যাদের পয়সায় আমরা পেট্রোল খরচ করি, যাদের পয়সায় আমরা কার্পেট ব্যবহার করি, তাদের জন্য কি করলাম? সেটাই আজ বড় জিনিস।’ তাঁর এ বক্তব্যে সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে জনকল্যাণের বাসনা, তাদের জন্য পর্যাপ্ত পরিষেবা প্রদান করা ও পূর্ণ ভারসাম্যসূচক অবস্থায় স্থিতিশীলতা। সবার জন্য প্রাপ্যতা সুনিশ্চিত করতে তাঁর ধ্যান-ধারণা ও কর্মস্পৃহাকে তিনি পূর্ণাঙ্গভাবে ব্যবহার করেছিলেন। তিনি সেদিনের সে বক্তৃতায় আরও বলেছিলেন, ‘দেশকে বাঁচান, মানুষকে বাঁচান, মানুষের দুঃখ দূর করুন। আর দুর্নীতিবাজ, ঘুষখোর, চোরাকারবারিদের উৎখাত করুন।’ দেশের অগ্রযাত্রা যাতে ব্যাহত না হয় সেজন্য একজন সৃষ্টিশীল রাজনৈতিক উদ্যোক্তা স্বীয় ধ্যান-ধারণা ও মনন এবং মেধা-প্রজ্ঞার মিশেল ঘটিয়ে সর্বাত্মক দেশের অগ্রযাত্রা সুনিশ্চিত করতে সচেষ্ট ছিলেন। তাঁর এ প্রয়াসে তিনি আমৃত্যু সচেষ্ট ছিলেন, কখনও পিছপা হননি। রাষ্ট্রযন্ত্র পরিচালনা করা অতিশয় দুরূহ। অথচ সেই দুরূহ কাজটিকে বঙ্গবন্ধু স্বীয় শক্তিতে বলীয়ান হয়ে কাজ করে গেছেন। তাঁর কাছে যারা দেশকে ভালবেসেছে নিঃশর্তভাবে, কখনও দেশের উন্নয়নে হঠকারিতা করেনি, তাদের তিনি প্রশংসা করেছেন। তিনি সব সময় কালোবাজারি, মুনাফাখোরদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। যারা মিথ্যা গুজব রটিয়েছে তাদের বিরুদ্ধে তাঁর অবস্থান সুস্পষ্ট ছিল। আজকের দিনে দাঁড়িয়ে দেখি বঙ্গবন্ধুকন্যাও পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে দেশের উন্নয়ন, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতাকে সর্বাগ্রে স্থান দেন। যারা লুটেরা তাদের বিরুদ্ধে জননেত্রী শেখ হাসিনা কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন। তাদের বিরুদ্ধে শাস্তি প্রদানে যথাযথ কর্তৃপক্ষকে প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা উচিত। বঙ্গবন্ধু যে সততার কথা বলতেন, যে সততা বাস্তবায়নে প্রায়োগিক কলা-কৌললে গুরুত্বারোপ করেছিলেন, এখন সে সততাকে ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত টপ-ডাউন এ্যাপ্রোচের মতো ছড়িয়ে দিতে হবে। তিনি সর্বদা বাজার ব্যবস্থাপনা এবং সরকারের দক্ষতা ও কার্যকারিতার ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। বাঙালী বড় বেশি আবেগপ্রবণ। দ্রুত তারা উত্তেজিত হয় আবার শ্রান্ত হয়ে এলিয়ে পড়ে। দেশে এখন যারা সততা ও ন্যায়পরায়ণতার সঙ্গে জীবনযাপন করবেন তাদের অবশ্যই অগ্রাধিকার দিতে হবে। কথায় কথায় স্তোকবাক্য, ক্ষমতায় থেকে উল্টাপাল্টা বলা, ছদ্মবেশী আওয়ামী লীগারদের দৌরাত্ম্য কমাতে হবে। বঙ্গবন্ধুর যে আদর্শ সেখান থেকে বিচ্যুত হওয়া ঠিক নয়। তিনি যে চিন্তা-ভাবনা থেকে বাংলার মানুষের বন্ধু ছিলেন সেখানে মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর প্রয়াস নিয়েছিলেন। তাঁর বিয়োগান্তক মৃত্যুর পর সে কাজ থেমে গিয়েছিল। আজ তাঁর সুযোগ্য কন্যা সে অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করতে সচেষ্ট রয়েছেন। মানুষ তার নিজের অস্তিত্বের মাধ্যমে সবার জন্য একটি আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন কর্মকা-কে বাস্তবায়ন করবেন- যাতে করে সে সময়ের প্রেক্ষাপটে হতদরিদ্র অবস্থার অবসান ঘটবে। সুযোগসন্ধানীরা অবশ্য নানা সময় সুযোগের অপব্যবহার করে থাকে। শিক্ষাক্ষেত্র আমলাতন্ত্রমুক্ত রাখার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন গঠন করে দেশে উচ্চশিক্ষা প্রসারে বঙ্গবন্ধু প্রয়াস গ্রহণ করেন। অথচ আজ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের অধঃস্তন কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একাংশ যেভাবে আমলা হয়ে উঠেছে, বিশেষ করে বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের কতিপয় লোভীর কারণে এক ধরনের মধুচক্র সৃষ্টি হয়েছে- যা ভাঙ্গা আবশ্যক হয়ে পড়েছে। যে সাধু উদ্দেশ্য নিয়ে ইউজিসি গঠিত হয়েছিল আজ সেখান থেকে তা অনেকখানি দূরে সরে গেছে। শিক্ষাকে সর্বজনীন করেছেন বঙ্গবন্ধু। তিনি শিক্ষার বিকাশ সাধনে লোভমুক্ত পরিবেশে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পরিচালনা করতে চেয়েছিলেন। সচিবালয়ভিত্তিক আমলার আধিপত্য বঙ্গবন্ধু হ্রাস করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু এক ধরনের মাফিয়া নেক্সাস বর্তমানে ইউজিসিকে কুরে কুরে খাচ্ছে। সেখনকার লজিস্টিক সাপোর্ট প্রদানের জন্য নিয়োজিত কর্মকর্তাদের এখন আমলার রকম ও ভেদ এমন পর্যায়ে গেছে যে, কেবল ভুক্তভোগীরাই জানেন। জানি না এরা উচ্চশিক্ষায় কতটুকু ইতিবাচক প্রভাব রাখবে। তবে ইউজিসির আমলাতন্ত্র ভাঙ্গা জরুরী হয়ে পড়েছে। নচেত উচ্চশিক্ষায় বঙ্গবন্ধুর আদর্শের বৈরিতা প্রকাশ পেতে পারে। ১৯৭৫ সালের ২১ জুন রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশ বলে বাংলার বন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তৎকালীন ১৯টি জেলা থেকে বাড়িয়ে ৬১টি জেলা করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। ওই বছরের ১৬ জুলাই প্রতিটি জেলায় গবর্নর মনোনয়নের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। তাঁর এ চিন্তা ছিল অত্যন্ত সুদূরপ্রসারী। মনে আছে তখন গুজবে দেশ ভরিয়ে দিয়েছিল বিশ্বাসঘাতকরা। তারা এমন কথাও রটনা করেছিল যে, এটি রাজতন্ত্র তৈরির প্রয়াস। সেদিন যারা এ ধরনের রটনা করে বাঙালীদের বোকা বানাতে চেয়েছিল তারা বস্তুত মূর্খের দল। কেননা অপপ্রচারের দরুন সাময়িক বিভ্রান্তি সৃষ্টি হতে পারে, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে এর কোন প্রভাব নেই। তবে তৎক্ষণাৎ প্রাসাদ ষড়যন্ত্রকারীরা নির্মম ও নৃশংসতার পরিচয় দিয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর নৃশংস হত্যাকান্ডের পর ড. কামাল হোসেনের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন জাগে। একটি সদ্য স্বাধীন দেশের জনগণের দোরগড়ায় মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণ করার জন্য যা যা প্রয়োজন তা বাস্তবায়নে তিনি উৎপাদন ব্যবস্থা, সুষম বণ্টন ব্যবস্থা এবং দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য, কৃষি ও কর্মসংস্থানে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। অর্থনীতিকে মজবুত কাঠামোর ওপর দাঁড় করাতে সচেষ্ট ছিলেন। কিছু দুষ্টু লোক তখনও সমাজ ব্যবস্থায় বহাল ছিল। অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য রাজনৈতিক উদ্যোক্তা হিসেবে বঙ্গবন্ধু যে বহুমাত্রিক কর্মক্ষমতা ধারণ করেছিলেন তা তাঁকে বিশ্বজনীন নেতৃত্বগুণে ভূষিত করেছে। তিনি বিশ্বের সহায়-সম্বলহীন মানুষকে উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় পথনির্দেশ করেছেন। বঙ্গবন্ধু জুলিও কুরি শান্তি পুরস্কার ২৩ মে ১৯৭৩ এশীয় শান্তি সম্মেলনে পেয়েছিলেন। মহামানবকে শান্তি পুরস্কার অনুষ্ঠানে বিশ্বশান্তি পরিষদের মহাসচিব শ্রী রমেশ চন্দ্র বলেন যে, বাংলাদেশ শুধু একা নয়, সারাবিশ্ব আছে বাংলাদেশের পাশে; এ দেশের ত্রিশ লাখ শহীদ সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সংগ্রামে শুধু বাংলাদেশের শহীদ নন, তারা এশিয়া তথা সারা দুনিয়ার শহীদ। বঙ্গবন্ধু আজ বিশ্ববন্ধু। সকল প্রগতিশীল শক্তির পক্ষে বঙ্গবন্ধু সেদিন ঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। নিপীড়িত-নির্যাতিত মানবতার পক্ষে তাঁর অবস্থান ছিল কঠোর। দুঃখজনক যে, তাঁর প্রাপ্য শান্তিতে নোবেল প্রাইজ তাঁকে দেয়া হয়নি। অথচ তিনি সমগ্র বিশ্বের বন্ধু, রাষ্ট্রনায়ক, কালোত্তীর্ণ মানব হিসেবে সমগ্র বিশ্বে সমাদৃত হয়েছিলেন। আজ বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের কথা মানুষ সশ্রদ্ধচিত্তে স্মরণ করে থাকে। কালের ভেলায় তিনি নিজের সময়কে উত্তীর্ণ করেছেন। বঙ্গবন্ধুর মাহাত্ম্য যে, বাঙালীর অধিকার তিনি ফিরিয়ে দিতে চেয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর যে জীবন আদর্শ সেখানে মানবপ্রেম সর্বাগ্রে উৎসারিত হয়েছে। তিনি চেয়েছিলেন সোনার বাংলা গড়তে। সকল শোষণ-বঞ্চনা দূর করে মানুষের ক্রয় ক্ষমতা বৃদ্ধি, ব্যাস্টিক অর্থনীতির ভিত্তি স্থাপন ও সামষ্টিক অর্থনীতিকে মজবুত করাই তাঁর প্রয়াস। তাঁর এ নিখাদ প্রয়াসে কোন ফাঁক-ফোকর ছিল না। তারপর লখিন্দরের বাসরঘরে যেমন ছোট্ট ছিদ্র দিয়ে সাপ ঢুকে লখিন্দরকে দংশন করেছিল, তেমনি একটি ক্ষুদ্র গোষ্ঠী সেদিন বঙ্গবন্ধুকে দংশন করেছিল। যে বিশাল অন্যায় অপকর্ম সেদিন ঠান্ডা মাথায় একটি কুচক্রী মহল করেছিল, এরপর থেকেই ইতিহাস বিকৃতি এবং পেছনের দিকে চলা শুরু হয়। একুশ বছর লেগেছে ওই পেছনে চলা থেকে জাতির বেরিয়ে আসতে। রক্ষীবাহিনী নিয়েও মিথ্যাচারের শেষ ছিল না। ফিনিক্স পাখি যেমন ধ্বংসস্তূপ থেকে বেরিয়ে আসে, তেমনি বঙ্গবন্ধুর হত্যার একুশ বছর পর আবারও সামনে চলা শুরু তাদের। মাঝখানে কুচক্রী বিএনপি-জামায়াতীরা ছিল। এখন আবার বঙ্গবন্ধুকন্যার নেতৃত্বে দেশ এগিয়ে চলেছে। রাজনৈতিক উদ্যোক্তা বঙ্গবন্ধু বাংলা ভাষাকে বিশ্ব দরবারে সম্মানের সঙ্গে প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন। লেখক : ম্যাক্রো ও ফিন্যান্সিয়াল ইকোনমিস্ট ও প্রফেসর [email protected]
×