ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

তরুণ লেখকদের পাঠকপ্রিয় কিছু বইয়ের কথা

প্রকাশিত: ১০:১০, ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২০

তরুণ লেখকদের পাঠকপ্রিয় কিছু বইয়ের কথা

মনোয়ার হোসেন ॥ কাসিদ নামের উপন্যাসে ভর করে দারুণভাবে পাঠক টানছেন জয়দীপ দে। ইতোমধ্যে এই তরুণ লেখকের পাঠকসমাদৃত উপন্যাসটির প্রথম সংস্করণটি শেষ হয়েছে। চলছে দেশ পাবলিকেশন্স থেকে প্রকাশিত বইটির তৃতীয় সংস্করণ। তারুণ্যের জয়গান গাওয়া এমন একঝাঁক কথাশিল্পী ও কবির বই আলো ছড়াচ্ছে অমর একুশে গ্রন্থমেলায়। মাসব্যাপী বইমেলায় প্রতিদিন বের হয় শতাধিক বই। সেই সূত্রে একুশের বইমেলায় বরাবরই এগিয়ে থাকে নবীন লেখকদের গ্রন্থসম্ভার। উৎকর্ষের বিবেচনায় বেশিরভাগ বই ছুঁতে পারে না পাঠকের মনন। অজস্র নবীন লেখকের ভিড়ে মানের বিবেচনায় পাঠক সমাদৃত হন স্বল্পসংখ্যক লেখক। পাঠকের মনোযোগ আকৃষ্ট করা তেমন কিছু বইয়ের কথা উঠে এসেছে এই লেখায়। বিভিন্ন প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত তরুণদের সেসব বইয়ের খবর মেলে ধরা হলো এই প্রতিবেদন। অগ্রজদের পথ ধরে বর্তমানে তরুণ লেখকরা রাঙাচ্ছেন বাংলা সাহিত্যের গদ্য-পদ্যের ভুবন। তাদের ক্রমাগত সৃষ্টির মাঝে ঢেকে যাচ্ছে সাহিত্যের শূন্যতার পথটি। আর এই তরুণ লেখকদের নিজেকে মেলে ধরার সর্বোচ্চ মঞ্চটি হচ্ছে একুশে গ্রন্থমেলা। সৃষ্টিকে সঙ্গী করা তরুণ লেখকের সমাগমে ঝলমল করছে প্রতিদিনের মেলা। প্রখ্যাত সাহিত্যিকদের সমান্তরালে বিক্রি হচ্ছে তাদেরও বই। শুধু তাই নয়, কেউ বা আবার ধাবিত হচ্ছেন বেস্টার সেলার বইয়ের লেখকের তালিকায়। তাই প্রকাশকরাও সুনজরে রাখছেন এই তরুণদের। নিজেদের তাগিদেই খুঁজে নিচ্ছেন মেধাবী লেখনীর তরুণ লেখককে। সময়ের আলোচিত আরেক তরুণ লেখক স্বকৃত নোমান। পাঞ্জেরী থেকে থেকে আসা তার ‘বানিয়াশান্তার মেয়ে’ উপন্যাসটি নজর কেড়েছে পাঠকের। সেই সূত্রে বইটির ভাল বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া লেখকের প্রবন্ধগ্রন্থ ‘টুকে রাখা কথামালা’ প্রকাশ করেছে বিদ্যা প্রকাশ। তারুণ্যের প্রতিনিধিত্বশীল এই লেখক জনকণ্ঠকে বলেন, বর্তমানে তরুণ লেখকদের মাধ্যমেই সাহিত্যে নতুন জোয়ার সৃষ্টি হয়েছে। সমকালীন সাহিত্যে ক্রমশ নবীনদের উত্থান ঘটেছে। গত ১০ বছরের বেশি সময় ধরে তরুণরাই নেতৃত্ব দিচ্ছে সাহিত্য ভুবনে। কারণ, গত শতকের সত্তরের দশকের প্রবীণ লেখকদের অনেকেই প্রয়াত হয়েছেন, আবার অনেকেই নিষ্ক্রিয়। আশি ও নব্বই দশকের লেখকদের একটি অংশ লিখলেও শূন্যতার জায়গাটি পূরণ করেছে নবীনরা। এই লেখকদের মধ্যেই প্রতিশ্রুতিশীল গল্পকার, উপন্যাসিক ও কবি রয়েছেন। ইদানীং প্রবন্ধ ও গবেষণাধর্মী লেখায়ও পারঙ্গমতার পরিচয় দিচ্ছে তরুণরা। কিংবদন্তিতুল্য কিংবা প্রখ্যাত লেখকের সৃষ্টিসম্ভারের বাইরে মূলত বইমেলার ষাট থেকে সত্তর শতাংশ ভূমিকা রাখছে তরুণরা। সাহিত্য সৃজনে এই তরুণদের আছে আলাদা স্বর। সৃষ্টিতে রয়েছে নিরীক্ষা প্রবণতা। বিষয়বস্তুর প্রতি আছে দায়বদ্ধতা। এসব কারণেই নবীনদের বই বেশ ভাল চলছে বইমেলায়। নতুন লেখকের মাধ্যমে পাঠকরাও খুঁজে নিচ্ছে ভিন্নতার স্বাদ। প্রকাশনা সংস্থা বায়ান্ন থেকে বেরিয়েছে তরুণ কবি মারজুক রাসেলের কাব্যগ্রন্থ ‘দেহ বণ্টন বিষয়ক দ্বিপক্ষীয় চুক্তি স্বাক্ষর’। বইটি পেয়েছে ব্যাপক পাঠকপ্রিয়তা। অন্যপ্রকাশ থেকে এসেছে সাদাত হোসাইনের উপন্যাস ‘মেঘেদের দিন’। প্রথমা থেকে প্রকাশিত পিয়াস মজিদের কাব্যগ্রন্থ ‘বসন্ত, কোকিলের কর্তব্য’ সমাদৃত হয়েছে পাঠকের কাছে। বাংলা একাডেমি থেকে এসেছে এই লেখকের প্রবন্ধের বই ‘মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু ও বাংলা একাডেমি’। অন্যপ্রকাশ থেকে এসেছে নওশাদ জামিলের কাব্যগ্রন্থ ‘প্রার্থনার মতো একা’। মোজাফ্ফর হোসেনের উপন্যাস ‘তিমিরযাত্রা’ প্রকাশ করেছে পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স। চন্দ্রবিন্দু এনেছে মাহবুব ময়ূখ রিশাদের উপন্যাস ‘আরিমাতানো’। একই প্রকাশনা থেকে বেরিয়েছে রাসেল রায়হানের উপন্যাস ‘অমরাবতি’। হামিম কামালের উপন্যাস ‘জাদুকরী ভ্রম’ প্রকাশ করেছে চন্দ্রবিন্দু। আলতাফ শাহনেওয়াজ কাব্যগ্রন্থ ‘সামান্য দেখার অন্ধকারে’ প্রকাশ করেছে প্রথমা। অন্যপ্রকাশ এসেছে হক ফারুক আহমেদের কবিতার বই ‘মেঘদরিয়ার মাঝি।’ আগামী বছর থেকে বদলে যাবে বইয়ের চরিত্র : পাঠক না বাড়লেও প্রতিবছর গ্রন্থমেলায় বাড়ছে প্রকাশনা সংস্থা। এসব মৌসুমী বা ভুঁইফোড় প্রকাশনা সংস্থার অধিকাংশ বইয়ে থাকে না সম্পাদনার ছোঁয়া। তাই এক বইমেলায় কয়েক হাজার বই বের হলেও মাানসম্মত বই খুঁজে পেতে হিমশিম খেতে হয় পাঠককে। এবার থেকে এসব প্রকাশনা সংস্থা এবং তাদের মানহীন বইয়ের প্রতি নজর রাখবে গ্রন্থমেলার আয়োজক বাংলা একাডেমি। মঙ্গলবার বিকেলে একাডেমি আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এই প্রত্যয় ব্যক্ত করেন একাডেমির মহাপরিচালক বাংলা একাডেমি হাবীবুল্লাহ সিরাজী। তিনি বলেন, আগামী বছর থেকে বদলে যাবে বইয়ের চরিত্র। যাচাই-বাছাইয়ের মাধ্যমে মানহীন বই এবং নিম্নমানের প্রকাশনা সংস্থার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। একাডেমির শহীদ মুনীর চৌধুরী সভাকক্ষে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন একাডেমির সচিব মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন, মেলা পরিচালনা কমিটির সদস্য সচিব ড. জালাল আহমেদ, গ্রন্থমেলার নক্সাবিদ স্থপতি এনামুল করিম নির্ঝর প্রমুখ। হাবীবুল্লাহ সিরাজী বলেন, অমর একুশে গ্রন্থমেলা একুশের চেতনা বাস্তবায়নে শুরু হয়। এর কোন বাণিজ্যিক উদ্দেশ্য ছিল না। যার কারণে একবার টিকেটের সিদ্ধান্ত নেয়া হলেও, সেটি বাতিল করা হয়। গ্রন্থমেলায় মৌসুমী প্রকাশক বৃদ্ধির অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, একটি ভাল বইও যদি কোন প্রকাশনী করে তারা মেলায় স্টল বরাদ্দ পাবে। প্রকাশকরা বলছেন, মৌসুমী বা নতুন প্রকাশনীর কারণে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এটা বলাই বাণিজ্যিক বিষয়। এ মেলা প্রকাশকদের ব্যবসার মেলা নয়। স্থপতি এনামুল করিম নির্ঝরের নেতৃত্ব গত দুই বছরে আমরা মেলার চরিত্র বদলিয়েছি। আগামী বছর থেকে মেলায় প্রকাশিত বইয়ের চরিত্র বদলে যাবে। লিখিত বক্তব্যে হাবীবুল্লাহ সিরাজী বলেন, এবারের মেলা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে উৎসর্গ করা হয়েছে। একই সঙ্গে বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত হয়েছে তার নতুন বই ‘আমার দেখা নয়াচীন’। এই বইকে ঘিরে পাঠকের বিপুল আগ্রহ আমাদের আনন্দিত করেছে। একইসঙ্গে একাডেমি পরিকল্পিত বঙ্গবন্ধু বিষয়ক শতগ্রন্থের অংশ হিসেবে মঙ্গলবার পর্যন্ত ১৮টি বই প্রকাশিত হয়েছে। তিনি আরও বলেন, এবারের মেলায় শিশুকিশোরদের গুরুত্বের কেন্দ্রে রেখা শিশুবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টিতে আরও তৎপর হয়েছি। আগামী ২২ ফেব্রুয়ারি শিশু-কিশোর প্রতিযোগিতাসমূহের ফলাফল প্রদান করা হবে। এই শিশুকিশোরদের মাঝেই লুকিয়ে আছে আগামী দিনের নিবিষ্ট পাঠক। তিনি আরও বলেন, একুশের দিনে সকাল সাড়ে সাতটায় মেলার মূলমঞ্চের কবিতা পাঠের আয়োজন ও বিকেল চারটায় ‘অমর একুশে বক্তৃতা ২০২০’ আয়োজন করা হবে। নতুন বই মঙ্গলবার ছিল গ্রন্থমেলার ১৭তম দিন। বাংলা একাডেমির জনসংযোগ বিভাগের তথ্যানুযায়ী, এদিন প্রকাশিত হয়েছে ১৪৭টি নতুন বই। সাহস পাবলিকেশন্স থেকে এসেছে হাবীবুল্লাহ সিরাজীর কাব্যগ্রন্থ ‘স্বপ্নহীনতার পক্ষে’। বাংলা একাডেমি থেকে বেরিয়েছে মিনার মনসুর ও দিলওয়ার চৌধুরী সম্পাদিত বঙ্গবন্ধু বিষয়ক বই ‘শেখ মুজিব একটি লাল গোলাপ’। দেশজ প্রকাশন থেকে এসেছে আমরুল ইউসুফের কাব্যগ্রন্থ ‘আমার ঘরের দেয়ালে বঙ্গবন্ধুর কোন ছবি নেই’। অনন্যা থেকে এসেছে নিশাত ইসলামের উপন্যাস ‘পালকি’। গল্প গ্রন্থ ‘দ’ দেশে ও সমজের পাঁচটি বিশেষ বিষয়কে উপজীব্য করে রচিত হয়েছে গল্প গ্রন্থ ‘দ’। ‘দ’ ইতোমধ্যে অমর একুশে বইমেলাসহ সারাদেশে ব্যাপকভাবে পাঠক সমাদৃত হয়েছে। ‘দ’ পাওয়া যাচ্ছে একুশে বইমেলার গদ্যপদ্য প্রকশনীর ৪১৭ এবং ৪১৮নং স্টলে। মেলামঞ্চের আলোচনা বিকেলে গ্রন্থমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় মিনার মনসুর ও দিলওয়ার চৌধুরী সম্পাদিত শেখ মুজিব একটি লাল গোলাপ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন আমিনুর রহমান সুলতান। আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন জাহিদুল হক, জাফর ওয়াজেদ ও আসলাম সানী। সভাপতিত্ব করেন সম্পদ বড়ুয়া। আলোচকবৃন্দ বলেন, বিশুদ্ধ নৈতিকতার অধিকারী বঙ্গবন্ধু নৈতিকতার প্রশ্নে কখনও আপোস করেননি। স্বাধীনতার এ মহানায়ক ৭৫-এর ১৫ আগস্ট সপরিবারে নিহত হওয়ার পর দেশ এক সঙ্কটময় মুহূর্তে উপনীত হয়। এই নির্মম ও পৈশাচিক হত্যাকা-ের প্রতিবাদের মধ্য দিয়ে জাতির মহাশোককে শক্তিতে রূপান্তরের জন্য সেদিন যাদের কলম সোচ্চার হয়ে ওঠে; তাদের লেখনী সংকলিত হয় গ্রন্থে। একটি জাতির আত্মত্যাগ ও মূল্যবোধের ইতিহাস জানার জন্য এ গ্রন্থ একটি আকরগ্রন্থ হয়ে থাকবে। লেখক বলছি মঞ্চে নিজেদের নতুন বই নিয়ে আলোচনা করেন শামীম আজাদ, মলয় বালা, আফসানা বেগম ও অরবিন্দ চক্রবর্তী। সন্ধ্যায় কবিকণ্ঠে কবিতা পাঠ করেন কবি জাহিদুল হক, বিমল গুহ ও দুলাল সরকার। আবৃত্তি পরিবেশন করেন আবৃত্তিশিল্পী আঞ্জুমান আরা, ফয়সল আহমেদ ও মৃন্ময় মিজান। ছিল সাংস্কৃতিক সংগঠন আনন্দনের পরিবেশনা। সঙ্গীত পরিবেশন করেন বুলবুল ইসলাম, শাহনাজ নাসরিন ইলা, অসীম দত্ত, মীর মন্ডল, স্বপ্নীল সজীব, পূরবী বিশ্বাস। স্থাপনা ধারণা প্রদর্শনী : গ্রন্থমেলা উপলক্ষে স্থাপনা ধারণা প্রতিযোগিতার আয়োজন ছিল এবারের গ্রন্থমেলার উল্লেখযোগ্য সংযোজন। প্রতিযোগীদের উপস্থাপনকৃত স্থাপনাকর্ম নিয়ে গ্রন্থমেলায় মঙ্গলবাার বিকেলে একটি প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়। প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন বিশিষ্ট স্থপতি অধ্যাপক সামসুল ওয়ারেস। আজকের মেলা বুধবার গ্রন্থমেলার ১৮তম দিন। মেলা চলবে বেলা ৩টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত। বিকেলে গ্রন্থমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হবে জালাল ফিরোজ রচিত বঙ্গবন্ধু গণপরিষদ সংবিধান শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন মুজতবা আহমেদ মুরশেদ। আলোচনায় অংশগ্রহণ করবেন ডালেম চন্দ্র বর্মণ, মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন এবং সাব্বীর আহমেদ। সভাপতিত্ব করবেন ইতিহাসবিদ অধ্যাপক সৈয়দ আনোয়ার হোসেন। সন্ধ্যায় রয়েছে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।
×