ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মারুফ রায়হান

ঢাকার দিনরাত

প্রকাশিত: ০৯:৩৫, ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২০

 ঢাকার দিনরাত

বাইরে বেরুনোর সময় মাস্ক পরা ঢাকাবাসীর সংখ্যা বাড়ছে, সেইসঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মাস্কের দাম। কুড়িটি ফার্মেসিতে মাস্ক চাইলে কপাল ভাল হলে একটির দোকানি বলতেও পারেন, হ্যাঁ আছে। একদাম। যা হোক, স্বীকার করে নিতে লজ্জা নেই বিগত গ্রীষ্মের পর আর মাস্ক পরিনি, আলসেমিই প্রধান কারণ তার; করোনা ভাইরাসের ভয়ে পরতে শুরু করি কিছুকাল হলো। যদিও এখন আর সেই ভয় নেই। ঢাকায় যদি ওই ভাইরাস-আক্রান্ত কোন রোগী না থাকে তাহলে ভয় করার কোন যুক্তি আছে কি? বরং ধুলোর নিঃশব্দ আঘাত থেকে বাঁচার জন্য প্রতিটি ঢাকাবাসীর জন্য আবশ্যক হলো এই মাস্ক। চোখ সুরক্ষা না পেলেও নাক-মুখ বাঁচছে, মানে শ্বাসপ্রশ্বাসে সরাসরি ধুলো প্রবেশ করছে না। ‘সাধারণ’ ভাইরাসের আক্রমণ থেকে রেহাই মিলছে। মাস্ক পরলে মুখের অনেকটাই ঢাকা পড়ছে বলে সহজেই পরিচিত লোকও চিনে উঠতে পারছেন না। এটাকে সুবিধা বা অসুবিধা হিসেবে ভেবে নিতে পারেন যার যার সুবিধা অনুযায়ী। পরিবেশবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা গ্রিন পিস তাদের সর্বশেষ প্রতিবেদনে যে তথ্য দিয়েছে তা ভয়াবহ। তারা বলছে, বায়ুদূষণের কারণে বাংলাদেশে বছরে প্রায় সোয়া লাখ কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে। বায়ুদূষণজনিত রোগে ২০১৮ সালে বাংলাদেশে ৯৬ হাজার শিশুর অকালমৃত্যু হয়েছে। বছরে ৪০ লাখ মানুষ এ্যাজমা বা শ্বাসকষ্টের সমস্যা নিয়ে হাসপাতালে আসছে চিকিৎসা নিতে। বিশ্বের প্রধান শহরগুলোর বায়ুর মান পর্যবেক্ষণকারী আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান এয়ার ভিজুয়ালের হিসাবে, গত বুধবার ঢাকার বাতাস অস্বাস্থ্যকর অবস্থায় ছিল, দূষণের দিক থেকে যা বিশ্বের প্রধান শহরগুলোর মধ্যে ষষ্ঠ। সময়ের নায়কেরা কোন কারণ ছাড়াই আমাদের অনেক সময়ে প্রয়াতজনদের কথা মনে পড়ে যায়। মনোস্তাত্ত্বিকরা বলবেন, কারণ ছাড়া মন সাড়া দেয় না। হয়ত তাই। প্রতিদিনই খবরের কাগজে দেখছি গুণীজনদের মৃত্যুবার্ষিকী। ফলে মনের ওপর তার একটা প্রভাব তো পড়েই। গত দুতিন-দিনে যে-দু-তিনজন গুণী ব্যক্তিকে আমার মনে পড়ল তাদের সবার সঙ্গেই ছিল আমার সুন্দর সম্পর্ক। বলাবাহুল্য তারা নিজ নিজ সময়ের একেকজন নায়ক। সময়ের নায়ক সবাই হতে পারেন না। স্বক্ষেত্রে স্মরণযোগ্য এবং ভিন্ন মাত্রার কোন কাজই তাঁকে দেয় সুখ্যাতি। প্রস্থানের পরও তাঁদের স্মরণ করা হয়। কিন্তু স্মরণের এই ধারা কি নবীন প্রজন্মকে আগ্রহী বা কৌতূহলী করে তোলে ওই ব্যক্তি সম্পর্কে? না তোলারই কথা। আমার মনের ভেতর যাঁদের স্মৃতি সম্প্রতি গুঞ্জরিত হয়ে চলেছে সাঈদ আহমেদ তাঁদের অন্যতম। নিঃসন্দেহে তিনি সময়ের নায়ক, এই ঢাকার একান্ত স্বজন। আদি ঢাকার সুরসিক প্রাজ্ঞ এই ব্যক্তিত্ব বাংলাদেশের আটপৌরে নাট্যধারায় বিশ্বসৌরভ নিয়ে এসেছিলেন। আমরা এবসার্ড নাটকের পথিকৃৎ স্যামুয়েল বেকেটের কথা জানি, যার ওয়েটিং ফর গোডো ঢাকার মঞ্চে অভিনীতও হয়েছে, সেই বেকেটের সঙ্গে আমাদের সাঈদ আহমেদের ছিল সখ্য। নব্বই দশকের কথা বলছি। বিটিভিতে বিশ্বনাটক অনুষ্ঠান পরিকল্পনা ও উপস্থাপনা করতেন। সেই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে স্টুডিও থিয়েটার হিসেবে বিভিন্ন ভাষার সমকালীন ও ক্ল্যাসিক নাট্যকারদের নাটক বা নাট্যাংশ পরিবেশিত হতো। তিনিই বাংলায় সেসব নাটকের অনুবাদ করতেন। সংশ্লিষ্ট নাট্যকারদের অবদান নিয়ে অননুকরণীয় ভঙ্গিতে কথা বলতেন ছোটপর্দায়। এমন একজন মানুষকে কি আমাদের নাট্যভুবন যথাযথভাবে স্মরণে রেখেছে? ঢাকার কুড়িজন কালের নায়কের কথা ভাবতে গেলে নিশ্চয়ই নাট্যক্ষেত্রে সাঈদ আহমেদের নাম আসবে। যেমন আসবে আবদুল্লাহ আল মামুনের নাম। কিন্তু একজন দার্শনিক কিংবা একজন বিজ্ঞানীর কথা যদি ভাবি তবে কার কার মুখ আমাদের মানসপটে ভেসে উঠবে? এই মহানগরীতে নিজ ক্ষেত্রে অবদান রাখায় গভীর নিবিষ্ট ছিলেন এবং এই ঢাকা, বরং সমাজ বা রাষ্ট্র বলাই সমীচীন, তাঁর কাছ থেকে পেয়েছে বিরল উপহার, এমন ব্যক্তিদের নামে সড়কের নামকরণ করেই সমাজ দায়িত্ব পালন করেছে। ঢাকা দিন দিন সম্প্রসারিত হয়ে চলেছে। এক কুড়ি না হোক, দশটি পয়েন্টে দশটি ভাস্কর্য কি নির্মিত হতে পারে না তাঁদের স্মরণে। অথচ শহরের নানাপ্রান্তে রয়েছে বিসদৃশ কদর্য কিছু ভাস্কর্য, যা নিয়ে প্রায়ই সমালোচনা হয়। এই ঢাকায় তাঁরা জন্মগ্রহণ করেছিলেন, কিংবা অন্য শহর বা গ্রাম থেকে এসে এই ঢাকাতের বসত গেড়েছিলেন, এখানেই নিয়োজিত ছিলেন কর্মধর্মে। বেশিদূর যাওয়ার দরকার নেই, আমাদের পাশের দেশে, কাছের শহরেই রয়েছে এমন বহু ভাস্কর্য। সব বড় শহরেই এই প্রথা রয়েছে। শুধু সরকারীভাবে নয়, ব্যক্তি বা কোন বেসরকারী সংস্থার উদ্যোগেও এমন ভাস্কর্য নির্মিত হতে পারে যেটির সঙ্গে মানানসই বিলবোর্ডে থাকবে সেই ব্যক্তিত্বের সংক্ষিপ্ত পরিচয় ও অবদানের কথা। কুড়িল-বিশ্বরোড এবং হাতিরঝিলে রাতের বেলা গেলে বোঝা যায় শহরের অবয়বই কত না বদলে গেছে। মনেই হয় না এক দশক আগে ঢাকায় এ ধরনের সৌন্দর্য ছিল না। আমার বিশ্বাস, দশজন কালের নায়কের ভাস্কর্য প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হলে ঢাকার আন্তর-সৌন্দর্যও অনেকখানি বাড়বে। নবাগত সন্তানরা গর্বিত বোধ করবে পিতৃপুরুষদের মহতী অবদানের বিষয়ে জানতে পেরে। অবাক আলিঙ্গন পহেলা ফাল্গুন, ভালবাসা দিবস এবার ছিল অবাক আলিঙ্গন : পহেলা ফাল্গুন ও ভালবাসা দিবসের। একই দিনে উভয়ের আগমন। ভালবাসা দিবসকে এখন বাংলাদেশের তরুণ সমাজ বেশ ভালভাবেই উপভোগ করে। নানা ব্যক্তিগত আয়োজনে তারা দিনটিকে স্মৃতিময় করে রাখার চেষ্টা করে। একই সঙ্গে ইলেক্ট্রনিক এবং প্রিন্ট মিডিয়া ভালবাসা দিবসকে কেন্দ্রে রেখে বহু বর্ণিল একটি বৃত্ত রচনা করে, যার সময়সীমা ১৪ ফেব্রুয়ারির ২৪ ঘণ্টাকে ছাপিয়ে বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। বলা অসঙ্গত হবে না যে, বিগত এক-দেড় দশকে আমাদের ভালবাসা দিবস উদ্যাপনের বহুমাত্রিকতা তার পরিসর ও ওজন বিবেচনায় পৃথিবীর যে কোন দেশকে ছুঁয়ে ফেলতে পারঙ্গম। আমাদের প্রেমিকরা বিশ্বের কোন দেশের প্রেমিকের তুলনায় সামান্যতমও পিছিয়ে নেই। আর কে না জানে যে, প্রেমের কোন বয়স নেই। আমি সত্তরোর্ধ এমন ব্যক্তিকেও চিনি (নাম বা পেশা বলার কী দরকার!) যিনি এখনও প্রেমকাতর একজন বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া তরুণের প্রতিযোগী হতে সক্ষম, প্রেমপ্রকাশ ও প্রেম উপাদান গ্রহণ উভয় ক্ষেত্রে। সত্যি বলতে কি, জীবনের এক শ’ একটা যন্ত্রণার ভেতর সেঁধিয়ে থাকা মানুষের দেহমনে একটুখানি হলেও ভালবাসার সুবাতাস এসে আছড়ে পড়ে এই দিন, হোক তা কয়েকটি মুহূর্তের জন্য। বড়ই বস্তুবাদী আর কাঠঠোকরার ঠোঁটের মতোই কঠিন ও জটিল স্যুটেড-ব্যুটেড ব্যক্তিও ভালবাসার মন্দিরায় মনটাকে ভিজিয়ে ফেলার জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকেন। গৌরচন্দ্রিকা বাদ দিয়ে আসল কথায় আসি। এই বঙ্গে ফাগুন আর ভালবাসা দিবস আসে হাত ধরাধরি করে। ভালবাসা দিবসের বারতাই যেন এখন বাংলার ফাল্গুন আকাশে-বাতাসে, মাটিতে ও কংক্রিটে ছড়িয়ে দেয়। বাংলাদেশের বাংলা পঞ্জিকায় পহেলা ফাল্গুন হলো তেরোই ফেব্রুয়ারি আর ভ্যালেন্টাইন ডে ঠিক তার পরের দিন। কিন্তু পঞ্জিকা সংস্কারের কর‌্যাণে এবার ১৪ ফেব্রুয়ারিই ছিল ওই দুটি বিশেষ দিবস। তারওপর সেদিন সপ্তাহের প্রধান ছুটির দিন শুক্রবার হওয়ায় আনন্দ-উপভোগের উপলক্ষটাও ছিল বড়। অমর একুশে গ্রন্থমেলায় এসে আছড়ে পড়ে ফাল্গুন আর ভালবাসা দিবসের ঢেউ। ভালবাসা দিবসের রূপ-রস-গন্ধ-উত্তাপ রাজধানীর যে অঞ্চলে সবচেয়ে বেশি দৃশ্যমান হয় তা হলো বইমেলা। বইমেলা যদি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন প্রাঙ্গণ বাংলা একাডেমিতে না হতো তাহলে পহেলা ফাল্গুন আর ভালবাসা দিবসে আমরা ভালবাসার ওই সর্বব্যাপী রূপছটা থেকে অনেকখানি বঞ্চিত হতাম কিনা, সেটা বড় জিজ্ঞাসা। বইমেলা সত্যিই এক মুক্তাঞ্চল, তা যতই পুলিশ-মেটাল ডিটেক্টর-সিসিটিভি ক্যামেরার শ্যেনদৃষ্টি থাকুক না কেন। দলে দলে তরুণ-তরুণী বইমেলায় এসে উদ্যাপন করেন ভালবাসা দিবস। মোল্লারা আর রক্ষণশীলরা চোখ কপালে তুলে রাখলেও তাতে কোন প্রতিবন্ধকতা পড়ে না। একসময় প্রায় নিয়মিতভাবেই ভালবাসা দিবসেও হরতাল ডাকা হয়েছে। তাতে কী। ভালবাসার মানুষদের কেউ দমাতে পারেনি। বইমেলায় তার অপরূপ রূপ প্রত্যক্ষ করা যায়। ভালবাসা দিবসের অভিজ্ঞতা থেকে আমরা বলতে পারি যে, এদিন অল্প বয়সী প্রেমিক-প্রেমিকারা পরস্পরকে নতুন বই উপহার দেয়ার কথা বিবেচনা করেন। তাদের প্রথম পছন্দ কবিতার বই, প্রেমের কবিতার বই হলে তো সোনায় সোহাগা। এরপর তারা খোঁজেন প্রেমের উপন্যাস। এটা একেবারে নিজের চোখে দেখা অভিজ্ঞতা থেকে বলছি। অনেক প-িত লেখক আছেন যারা ভালবাসা নিয়ে মাতামাতিকে বাঁকা নজরে দেখেন। যেন তারা কখনই কাউকে ভালবাসেননি। আবার ভালবাসা প্রসঙ্গে বাচাল হয়ে ওঠেনও কেউ কেউ। ভালবাসা বিষয়টিকে অন্তরে গভীরভাবে ধারণ করে কোন লেখক উচ্চারণ করতেই পারেন : প্রতিবার ভালবেসে আমি হই শুদ্ধ সর্বহারা। ভালবাসা দিবসে পুরুষ লেখককে কোন অনুরাগী একগুচ্ছ লাল গোলাপ উপহার দেবেন এটা কামনা করি মনে মনে। কিন্তু পাঠিকারা লেখকের রচনাকে ভালবাসেন, সেই রচনা তুলে দেন তার প্রেমিকের হাতে। লেখক এখানে হয়ে যান অনেকটা পিতা কিংবা শ্বশুরের মতো, নিদেনপক্ষে বড় ভাই। তবে রবীন্দ্রনাথ ও জীবনানন্দ থাকেন প্রায় ঈশ্বরের আসনে। ভালবাসা দিবসের ক’দিন পরেই আসে জীবনানন্দের জন্মদিন। তাঁকে সেদিন নতুন করে প্রেম নিবেদন করেন জীবনপ্রেমিকরা। বিশেষ কোন নারী বা পুরুষের জন্য প্রেম হয়ত একসময় ঘাস হয়ে আসতে পারে। কিন্তু নিজের জীবনের প্রতি প্রেম, বলা চাই, মহাজীবনের প্রতি প্রেম কখনও ফুরোয় না। তার নব নব অবয়ব তৈরি হয়, প্রকাশের রূপরেখা তৈরি হয়। তার একটি মাইলফলক কিংবা ফিরে তাকানোর দিন হয়ে উঠতে পারে আমাদের এই ভালবাসা দিবস। ভালবাসা দিবসে তাই উচ্চারণ করেই বলি : বাংলা ভাষা ও বাংলাদেশ তোমাকে ভালবাসি। অন্তত একটি বই : আলথুসার একুশে ফেব্রুয়ারি চলেই এলো। বইমেলা বেশ জমজমাট। বইয়ের ক্রেতাসমাগম বাড়তে শুরু করেছে গত শুক্রবার থেকে। এই কলামে এখন পর্যন্ত একটি বইয়ের কথাও বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়নি। অন্তত একটি বইয়ের কথা বলে আজ শেষ করব। নাম শুনলে মনে হবে এটি জীবনী বা দর্শনশাস্ত্রের বই। বিখ্যাত মার্ক্সবাদী ফরাসী দার্শনিক লুই আলথুসারের নামে এই বই ‘আলথুসার’। এটি উপন্যাস, লেখক মাসরুর আরেফিন। আলথুসারের যে সামান্য অংশ, মানে প্রথম দুটি পরিচ্ছেদ ঈদসংখ্যা প্রথম আলোতে বেরিয়েছিল সেটির পান্ডুলিপিও আগেভাগে পড়ার সুযোগ হয়েছিল লেখক পাঠিয়েছিলেন বলে। এবারও পাঠালেন। তবু এবার গোটা লেখাটা শুরু করি প্রথম লাইন থেকে। আমি নিজে দুটো নভেলা লিখেছি, যা বই হয়েছে; আরেকটা আধখানা লিখে জনকণ্ঠ ঈদসংখ্যায় ছাপিয়ে বসে আছি আরও হাজারো কথা বলবার অভিপ্রায়ে। তাই আমি জানি, এভাবে পাতার পর পাতা লিখে যাওয়া কী কঠিন পরিশ্রম আর যুক্তিবুদ্ধির পরম্পরা রক্ষার কাজ। আগস্ট আবছায়া নামের ঢাউশ উপন্যাস লেখার পর একই লেখক এক বছরেরও কম সময়ের মধ্যে আবার এমন একখানা লিখলেন কী উপায়ে! দানবিক শক্তি আছে নাকি তার! প্রথম উপন্যাস থেকে এটির অবস্থান সুদূর। প্রথমটি যদি জাতীয় পর্যায়ের সুগভীর সত্তাস্পর্শী আখ্যান হয়, তবে দ্বিতীয়টিকে বলব, গ্লোবাল। গ্লোরিয়াস। এটি ইংরেজীতে লিখলে বুকারের জন্য দিব্যি বিবেচিত হতো, এবং আমার প্রায় সাড়ে তিন দশকের সম্পাদক-সুলভ লব্ধ অভিজ্ঞতা ও অভিজ্ঞান থেকে কারও প্রতিক্রিয়াকে গোনার মধ্যে না রেখে সোজা কথায় বলতে পারি, এটি হতো ‘লংলিস্টেড’। আলথুসারের গল্প (উপন্যাসে কাহিনীর সূচনা, সরণ ও পরিণতি থাকতেই হয়), এক গল্পের ভেতর শত গল্প, গল্প বলবার ধরন (যা মাসরুরীয়ই বটে), একটা কয়েনের দুই পাশ শুধু নয়, পাতলা ক্ষীণ উচ্চতাটুকুনসহ সব সব দেখানোর জন্যে শক্তি লাগে। তো গল্প থেকে গল্প, উত্তর গোলার্ধ থেকে দক্ষিণ, ধানসিড়ি থেকে টেমস, প্রবাহ ও রুদ্ধতা, বিভিন্ন জাতির ও জাতের মানব-মানবী, তাদের বুক চিরে দেখানো সত্যের অভাবিত চেহারা, দর্শনের সত্য ও সত্যমতো মিথ্যে, মানুষ নামের ভয়ঙ্কর শয়তানদের নৃশংস সব চিন্তাপ্রবাহ; এসবের মধ্যে ধুকপুক করতে থাকা, সৌরজগতে কাঁপতে কাঁপতে পরিভ্রমণরত পৃথিবী নামের গোল পাখিটার কবি-কলিজার অশ্রুত ধ্বনিÑসব এই উপন্যাস ধারণ করেছে। জাতকবি ছাড়া এ জাতের রচনা অসম্ভব- দশপাতা পড়ে এ ছিল আমার প্রাথমিক মন্তব্য। আর শেষ করার পরে বলছি, পৃথিবীর, না, ভুল হলো, পৃথিবীর ঠান্ডা মাথার উন্মাদ শাসনকারীদের গভীরগহীন অচিকিৎস্য অসুস্থতা শনাক্ত করতে পারেন কেবলই কবি, শুধুমাত্র দার্শনিকরাই। এই উপন্যাস এক মহান দার্শনিকেরই নামে, আর যেটির অন্তরাত্মা ঘিরে দীর্ঘশ্বাস বাজছে আরেক মহানের, কবি জীবনানন্দ দাশের। আলথুসার উপন্যাস যিনি লিখলেন তিনি কি দার্শনিক স্বভাবের? দশাগ্রস্ত দর্শনের গূঢ় আপাতঅস্বচ্ছ অবয়ব পাতার পর পাতায় ঝড়ের ঝাপটে শনশন বইয়ে দেয়ার জন্য একজন কথাশিল্পীকে কি কুর্নিশ করবে না দর্শনের ছাত্রেরা! পাঠকের জন্যে কাহিনীর ইঙ্গিত : আলথুসার ‘দমনপীড়নমূলক রাষ্ট্রযন্ত্র’ তত্ত্বের জনক, যিনি ১৯৮০ সালে স্ত্রীকে খুন করার আগে লন্ডনের এক বাসায় স্লিপওয়াক করতেন। ভাবা হয়, এই স্লিপওয়াকই কারণ ছিল তার স্ত্রী হত্যার, অর্থাৎ তিনি ঘুমের মধ্যেই ঘটিয়েছিলেন ওই মর্মান্তিক ঘটনা। আলথুসারের সেই বাসা দেখতে এ-উপন্যাসের নায়ক হাজির হয় লন্ডনের অক্সফোর্ড স্ট্রিটে, সময়টা এপ্রিল ২০১৯। পুরো লন্ডন শহরজুড়ে তখন চলছে বড় পরিবেশবাদী দল ‘এক্সটিংকশন রেবেলিয়ন’-এর তীব্র আন্দোলন। নায়ক জড়িয়ে পড়লেন শ্বাসরুদ্ধকর সব পরিস্থিতিতে। আলথুসার প্রকাশ করেছে প্রথমা প্রকাশন। মেলায় এসেছে শনিবারে। ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২০ [email protected]
×