ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

যমুনাপাড়ে ১ হাজার কোটি টাকার বিশাল নির্মাণযজ্ঞ শুরু

প্রকাশিত: ০৯:১২, ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২০

 যমুনাপাড়ে ১ হাজার কোটি টাকার বিশাল নির্মাণযজ্ঞ শুরু

বাবু ইসলাম, সিরাজগঞ্জ ॥ সিরাজগঞ্জে বিধ্বংসীরূপী প্রমত্তা যমুনাকে বশে আনতে চলতি বছর যমুনাপাড়ে ১ হাজার কোটি টাকার বিশাল নির্মাণযজ্ঞ শুরু হয়েছে। নদী তীর সংরক্ষণ প্রকল্পের আওতায় যমুনার ভয়ঙ্কর ভাঙ্গন প্রতিরোধে সিসি ব্লক দিয়ে পাড় মুড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। কাজিপুর সীমানায় খুদবান্দি-সিংড়াবাড়ি-শুভগাছা এলাকায় প্রায় ৬ কিমি নদী তীর সিসি ব্লক দিয়ে মুড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। একই সঙ্গে চারটি স্পার সংস্কার এবং চার কিমি নদী খনন কাজ শুরু হয়েছে। প্রমত্তা যমুনাকে বশে আনার নিরন্তর চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। বঙ্গবন্ধু সেতুর পশ্চিমপাড়ে সেতুর উজানে নদী তীর রক্ষা, বাঁধ নির্মাণ এবং নদী ড্রেজিং করার কাজও শুরু হয়েছে। যমুনার ভয়ঙ্কর ভাঙ্গন প্রতিরোধে ব্যবস্থা গ্রহণ অব্যাহত রয়েছে। যমুনা নদীর গতিবিধি লক্ষ্য রেখে সময়োপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়ে থাকে। এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া বলে সংশ্লিষ্ট পানি উন্নয়ন বিভাগ জানিয়েছে। এদিকে যমুনায় ক্যাপিটাল ড্রেজিং করে অপসারিত পলি মাটি দিয়ে চারটি ক্রসবার নির্মাণ করার পর নদীর গতিপথ পরিবর্তন হয়েছে। নদীর পশ্চিম তীরে সাড়ে ১৬ বর্গকিলোমিটার ভূমি পুনরুদ্ধার করা হয়েছে। ষাটের দশকের শুরুতে ১৯৬৩ সালে ব্রহ্মপুত্র ডানতীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ প্রকল্পে যমুনা নদীর ডানতীরে রংপুর, গাইবান্ধা, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ এবং পাবনা জেলার বেড়াখোলা পর্যন্ত ২১৭ কিমি বাঁধ নির্মাণ কাজ শুরু করে ১৯৬৮ সালে তা সমাপ্ত করা হয়। এর মধ্যে সিরাজগঞ্জ অংশে বাঁধের দৈর্ঘ্য প্রায় ৮০ কিমি। এ প্রকল্প বাস্তবায়নের ফলে যমুনার ভাঙ্গন থেকে প্রায় ১২ লাখ মানুষের সহায় সম্পদ রক্ষা করা হয়। কিন্তু অপ্রতিরোধ্য যমুনায় সিরাজগঞ্জ অংশে প্রতি বছরই কোন না কোন এলাকা ভয়ঙ্কর ভাঙ্গনের কবলে পড়ে। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর সিরাজগঞ্জ শহর ভয়ঙ্কর ভাঙ্গনের মুখে পড়ে। জোড়াতালি দিয়ে চলতে চলতে এক সময় দাবি উঠে শহর রক্ষা বাঁধ নির্মাণের। এ প্রেক্ষিতে ১৯৯৫ সালে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে সিরাজগঞ্জ শহর বরাবর ২ দশমিক ৫৫ কিমি নদী তীর সংরক্ষণ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়। এ প্রকল্পের কাজ শেষ হয় ১৯৯৯ সালে। ব্যয় করা হয় ৩শ’ ৩৫ কোটি টাকা। এ প্রকল্প সিরাজগঞ্জ হার্ড পয়েন্ট নামে পরিচিত। এটি একটি দর্শনীয় স্থানে পরিণত হয়েছে। এরপর ২০১৩ সালে যমুনায় ক্যাপিটাল ড্রেজিং প্রকল্প হাতে নিয়ে ২২ কিমি নদী খনন করা হয়। যমুনার তলদেশের পলি মাটি দিয়ে চারটি ক্রসবার নির্মাণ করা হয়। এই ক্রসবার নির্মাণের ফলে যমুনার গতিপথ পরিবর্তন হয়েছে। যমুনা নদীর পশ্চিম তীরে সাড়ে ১৬ বর্গকিলোমিটার ভূমি পুনরুদ্ধার হয়েছে। এ প্রকল্পের কাজ শেষ হয় ১৯১৭ সালে। ১৯৯৭ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত যমুনারপাড়ে একশ; কোটি টাকা খরচ করে ১১টি স্পার নির্মাণ করা হয়েছিল। কিন্তু তা রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে অকার্যকর হয়ে যমুনা গর্ভে বিলীন হয়েছে। যমুনা নদী প্রকৃতপক্ষেই অপ্রতিরোধ্য প্রকৃতির নদী। এই যমুনা ব্রহ্মপুত্র নদের নিম্ন প্রবাহ। ১৭৮২ থেকে ১৭৮৭ সালের মধ্যে সংঘটিত এক ভূমিকম্পে সৃষ্ট ভয়াবহ বন্যায় ব্রহ্মপুত্রের গতিপথ পরিবর্তিত হয়ে যমুনা নদী নামে প্রবাহিত হচ্ছে। কুড়িগ্রাম জেলা সীমানা থেকে শুরু হয়ে গাইবান্ধা, বগুড়া এবং সিরাজগঞ্জ জেলা হয়ে মানিকগঞ্জ জেলার আরিচায় পদ্মা নদীতে মিলিত হয়েছে। যমুনা নদীর দৈর্ঘ্য ২০৫ কিমি এবং প্রস্থ তিন কিমি থেকে ২০ কিমি পর্যন্ত। অর্থাৎ গড়ে ১০ কিমি। এ নদীতে বর্ষা মৌসুমে প্রতিদিন ১২ লাখ টন পলিমাটি বহন করে। বাহাদুরাবাদে পরিমাপকৃত যমুনায় বার্ষিক পলি বহন ক্ষমতা প্রায় ৭শ’ ৩৫ মিলিয়ন টন। প্রতি বছরই নতুন নতুন চর জেগে উঠে। আবার প্রতি বছরই নদীর ডানতীরে ভয়াবহ ভাঙ্গনে গ্রাম জনপদ যমুনাগর্ভে বিলীন হয়। বর্ষায় ভয়ঙ্কর বিধ্বংসী রূপে এই যমুনায় পানিপ্রবাহ একক খাতে পরিণত হয়। আবার শুকনো মৌসুমে নদীতে চর জেগে উঠে এবং কোথাও নদী সর্পাকৃতি, কোথাও চুলের বেণীর মতো এঁকে বেঁকে চলে। ইতোমধ্যে যমুনা নদীর ডানতীরে বঙ্গবন্ধু সেতুর পাশে ব্যক্তি মালিকানাধীন ১১টি কোম্পানির সমন্বয়ে গঠিত সিরাজগঞ্জ ইকোনমিক জোন লিমিটেড বেসরকারী অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার কাজ শুরু করেছে। সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার তিনটি মৌজা ও বেলকুচি উপজেলার দুটি মৌজায় ১ হাজার ৪৫ দশমিক নয় তিন একর জমির ওপর এই অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপন কাজ এগিয়ে চলেছে। ২০১৯ সালের ৩ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবনে এক অনুষ্ঠানে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে এ প্রকল্পের উদ্বোধন করেন। এ প্রকল্পে সাতশ’ ছোট বড় শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠবে। পাঁচ লাখ কর্মজীবী মানুষের কর্মসংস্থান হবে এই বেসরকারী অর্থনৈতিক অঞ্চলে। বঙ্গবন্ধু সেতুর পশ্চিমপাড়ে যমুনার তীর ঘেঁষে সরকারীভাবে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশনের তত্ত্বাবধানে একটি ইপিজেড নির্মাণ কাজও শুরু হয়েছে। সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার সয়দাবাদ এবং কালিয়া হরিপুর ইউনিয়নের চারশ একর জমির ওপর এই সরকারী ইপিজেড স্থাপনের জন্য কাজও এগিয়ে যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সে ২০১৬ সালের ২২ নবেম্বর মঙ্গলবার দুপুরে এর উদ্বোধন করেন। এ প্রকল্পে ৬শ’ ২৮ কোটি ১০ লাখ টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে। প্রকল্পে ছোট বড় ৮শ’ ২০টি প্লট করে শিল্প কারখানা গড়ে তোলা হবে। এ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে এক লাখ কর্মজীবী মানুষের কর্মসংস্থান হবে। বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশনের তত্ত্বাবধানে এই প্রকল্পটি দেশের সর্ববৃহৎ প্রকল্প বলে জানিয়েছেন বিসিক কর্মকর্তারা। সিরাজগঞ্জ পানি উন্নয়ন বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী শফিকুল ইসলাম জনকণ্ঠকে জানান- যমুনাপাড়ের নদী তীর সংরক্ষণ প্রকল্প একটি চলমান প্রক্রিয়া। কাজিপুরের খুদবান্দি-সিংড়াবাড়ি-শুভগাছা এলাকায় প্রায় ৬ কিমি নদী তীর সিসি ব্লক দিয়ে মুড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। একই সঙ্গে চারটি স্পার সংস্কার এবং চার কিমি নদী খনন কাজ শুরু হয়েছে। প্রমত্তা যমুনাকে বশে আনার নিরন্তর চেষ্টা করা হচ্ছে। যমুনার ভয়ঙ্কর ভাঙ্গন প্রতিরোধে ব্যবস্থা গ্রহণ অব্যাহত রয়েছে। এছাড়াও নদী তীর সংরক্ষণ প্রকল্প নামে একাধিক স্থানে প্রকল্প গ্রহণ করে নদী শাসন কাজ করে যমুনাকে বশে এনে সিরাজগঞ্জে উন্নয়ন কর্মকান্ড চালানো হচ্ছে। যমুনা নদীতে ক্যাপিটাল ড্রেজিং করে যমুনার দুর্গম চরে খাদ্যশস্য উৎপাদনে ভূমিকা পালন করছে। যমুনার পাড়কে দর্শনীয় স্থান হিসেবে গড়ে তোলার পরিকল্পনাও হাতে নেয়া হয়েছে।
×