ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

বিনামূল্যে স্কুলড্রেস ;###;মেধাবীরা পাচ্ছে বাইসাইকেল

ষষ্ঠ থেকে এইচএসসি পরীক্ষা পর্যন্ত প্রাতিষ্ঠানিক কোনো ফি দিতে হয় না

প্রকাশিত: ০২:২০, ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২০

ষষ্ঠ থেকে এইচএসসি পরীক্ষা পর্যন্ত প্রাতিষ্ঠানিক কোনো ফি দিতে হয় না

স্টাফ রিপোর্টার, বরিশাল ॥ বছরের প্রথমদিনে শিক্ষার্থীদের বিনামূল্যে বই দেওয়াসহ সরকারের নানা উদ্যোগের কারণে সরকারী বিদ্যালয়ে পড়ালেখার তেমন কোনো খরচ নেই। তবে বেসরকারী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে পড়ালেখা করাটা এখন অনেকটাই ব্যয়বহুল। কিন্তু এর উল্টো চিত্র বিরাজ করছে জেলার বাকেরগঞ্জ উপজেলার দেউলী গ্রামে অবস্থিত বীর মুক্তিযোদ্ধা কাঞ্চন শিকদার বিদ্যানিকেতন নিন্ম মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও বিলকিস জাহান টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড বিএম কলেজে। বর্তমানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দুইটিতে ষষ্ঠ থেকে এইচএসসি পর্যন্ত ৯৪৭ জন শিক্ষার্থী রয়েছে। যাদের পড়ালেখায় প্রাতিষ্ঠানিক কোনো ব্যয় নেই। বিদ্যালয় দুইটিতে ভর্তি হওয়ার পর থেকে শিক্ষার্থীদের যেমন মাসিক বেতন দিতে হয়না, তেমনি দিতে হয়না অতিরিক্ত ক্লাস (কোচিং) ফি। বরং প্রতিবছরের প্রথমদিকে বিদ্যালয় থেকে বিনামূল্যে সকল শিক্ষার্থীদের দেওয়া হয় স্কুল ড্রেসের কাপড়। এছাড়া প্রত্যেক শিক্ষার্থীদের মধ্যে পড়াশুনায় প্রতিযোগিতার সৃষ্টির লক্ষ্যে ক্লাসের প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থান অধিকারীদের দেওয়া হয় বিনামূল্যে বাইসাইকেল। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১২ সালে রণাঙ্গণের বীর মুক্তিযোদ্ধা ও অবসরপ্রাপ্ত প্রধানশিক্ষক মোঃ কাঞ্চন আলীর দান করা জমির ওপর তার দুই পুত্র এসএম জুলফিকার হায়দার ও এসএম জুবায়ের হায়দার বিলকিস জাহান টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড বিএম কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর ২০১৩ সালে কাঞ্চন আলীর স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য প্রতিষ্ঠা করা হয় কাঞ্চন শিকদার বিদ্যানিকেতন নিন্ম মাধ্যমিক বিদ্যালয়। বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর থেকেই পরিচালনা পর্ষদে থাকা কাঞ্চন আলী ও তার দুই পুত্র বিনামূল্যে প্রতিষ্ঠান দু’টিতে শিক্ষার্থীদের পাঠদানের ব্যবস্থা চালু করেন। নিজেরা ক্লাস নেওয়ার পাশাপাশি যুগিয়েছেন বেশ কয়েকজন পরিশ্রমী শিক্ষক। মুক্তিযোদ্ধা কাঞ্চন আলীর ছোট পুত্র ও বিলকিস জাহান টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড বিএম কলেজের অধ্যক্ষ জুবায়ের হায়দার জনকণ্ঠকে বলেন, বাবা (কাঞ্চন আলী) দীর্ঘ ৩৬ বছর বিভিন্ন বিদ্যালয়ে প্রধানশিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেছেন। এখনও তিনি আমাদের প্রতিষ্ঠিত দু’টি প্রতিষ্ঠানে বিনাপারিশ্রমিকে ইংরেজি পড়ান। তিনি আরও বলেন, মূলত বাবার স্বপ্ন পূরণ করা এবং প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেয়ার জন্যই বিদ্যালয় দু’টি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। তবে বিলকিস জাহান টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড বিএম কলেজ প্রতিষ্ঠার একটি লক্ষ্যছিলো গ্রামপর্যায়ে কারিগরি শিক্ষার বিস্তার ঘটানো। অধ্যক্ষ জুবায়ের হায়দার বলেন, আমাদের ও আশপাশের গ্রামের মানুষ অনেক সহজ-সরল ও দরিদ্র। যাদের সন্তানরা সহসাই উচ্চ শিক্ষিত যেমন হতে পারেনা, তেমনি সমাজের ভালো জায়গায়ও যেতে পারেন না। তাই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দু’টি প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই আমরা বিনাবেতনে শিক্ষার্থীদের পাঠদান শুরু করেছি। এখানে শিক্ষার্থীদের ভর্তি হতে কোনো টাকা নেওয়া হয়না, তেমনি তাদের মাসিক কোনো বেতনও নেই। তবে অন্য প্রতিষ্ঠানের মতো এখানে শিক্ষার্থীদের অতিরিক্ত ক্লাস করানো হয়। আর শিক্ষকদের নিয়মিত বেতনসহ অতিরিক্ত ক্লাসের টাকা প্রতিষ্ঠাতা ও দাতারই দিচ্ছেন। এছাড়া সরকার যেহেতু বিনামূল্যে বই দিচ্ছে, সেক্ষেত্রে এ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের পাঠদানে খাতা ও কলম কেনা ছাড়া আর কোনো ব্যয় নেই। তিনি আরও বলেন, প্রথমে আমাদের পক্ষ থেকেই বিনামূল্যে শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়ের নির্ধারিত পোশাক তৈরি করে দেওয়া হতো। পরে শিক্ষার্থীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় এখন আমরা কাপড় ক্রয় করে দিচ্ছি, আর শিক্ষার্থীরা নিজেদের মতো করে বানিয়ে নিচ্ছে। এছাড়া প্রত্যেক শিক্ষার্থীদের মধ্যে পড়াশুনায় প্রতিযোগিতার সৃষ্টির জন্য শুরু থেকেই বার্ষিক পরীক্ষায় প্রতি শ্রেণিতে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থান অধিকারীকে আমরা বিনামূল্যে বাইসাইকেল দিচ্ছি। যা ছেলে-মেয়ে উভয়ই পাচ্ছে। পাশাপাশি শুধুমাত্র ষষ্ঠ শ্রেণির সেরা ২০ জন শিক্ষার্থীকে বাইসাইকেল দেওয়া হয়ে থাকে। কারণ হিসেবে অধ্যক্ষ জুবায়ের হায়দার বলেন, যেহেতু ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে আমাদের কার্যক্রম শুরু, তাই শিক্ষার্থীদের পাঠদানে আগ্রহ ও প্রতিষ্ঠানের প্রতি ভালোবাসা বাড়াতে এ উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। এর বাইরে উভয় প্রতিষ্ঠানের দরিদ্র ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের বোর্ড পরীক্ষার ফরমপূরণের টাকাও প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে দেওয়া হয়। এ কারণে শিক্ষার্থীরাও পরীক্ষায় বেশ ভালো ফলাফল করছে। জুবায়ের হায়দার বলেন, এ সবকিছুই সদইচ্ছার কারণে হয়েছে। যেমন বিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতনসহ আনুসাঙ্গিক মাসে দেড় লাখ টাকা খরচ রয়েছে। যা সম্পূর্ণ প্রতিষ্ঠাতাদের পক্ষ থেকে বহন করা হয়। তিনি বলেন, আমাদের দুই ভাইয়ের ঢাকায় একটি প্যাকেজিং কারখানা রয়েছে। যেখানকার আয় থেকে এ দেড়লাখ টাকা দেওয়া হয়। এছাড়া প্রতিষ্ঠানের জমি ও ভবনের পরিধি দিন দিন বাড়ানো হচ্ছে, তার ব্যয়ও আমরা নিজেরা বহন করছি। তবে জমির ক্ষেত্রে ক্রয়ের থেকে বদল করে নেওয়া হয়েছে বেশি। স্কুলের পাশে থাকা অন্যের জমি আমরা নিচ্ছি। তাদের আমরা অন্যত্র থেকে জমি দিয়ে দিচ্ছি। প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের দেওয়া তথ্যানুযায়ী, অষ্টম শ্রেণির জেএসসি পরীক্ষায় কাঞ্চন শিকদার বিদ্যানিকেতন নিন্ম মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে অংশগ্রহণকারী পরীক্ষার্থীরা প্রতিবছর যেমন শতভাগ পাস করছে, তেমনি জিপিএ-৫ প্রাপ্তির সংখ্যাও আশানুরূপ। অপরদিকে এসএসসি ও এইচএসসির পরিসংখ্যানে বিলকিস জাহান টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড বিএম কলেজ থেকে অংশগ্রহণকারী পরীক্ষার্থীদের পাসের হার প্রতিবছর শতকরা ৯৫ থেকে ৯৮ শতাংশের মধ্যে থাকছে। শিক্ষক মিহির কর্মকার বলেন, ২০১৯ সালে এসএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারী ৯১ জন শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৮৮জন পাস করেছে। এরমধ্যে জিপিএ-৫ পেয়েছে ৩১ জন। অপরদিকে এইচএসসিতে অংশগ্রহণকারী ৭৩ জন পরীক্ষার্থীদের মধ্যে ৬৪ জন পাস করেছে, যারমধ্যে জিপিএ-৫ পেয়েছে ২৭ জন পরীক্ষার্থী। তিনি বলেন, শিক্ষার্থীদের আধুনিক পাঠদানের লক্ষ্যে দুটি প্রতিষ্ঠানের জন্য ডিজিটাল ল্যাব রয়েছে। পাশাপাশি রয়েছে সু-বিশাল খেলার মাঠ ও নানা উপসর্গ। এছাড়া প্রতিটি ক্লাসরুম সিসি ক্যামেরার আওতাভুক্ত। ফলে শিক্ষক থেকে শুরু করে কারও কোন প্রকার ফাঁকি দেওয়ার সুযোগ নেই। বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী লামিয়া আক্তার, মুক্তা আক্তার, নয়ন সিকদার, আরিফুর রহমান, রুমানা খানম জানান, আশপাশের বিদ্যালয়গুলোর থেকে এখানে পড়ালেখা করার নিয়মটা আলাদা। শিক্ষকরা যেমন প্রতিনিয়ত খেয়াল রাখছেন, তেমনি বিপদে-আপদে গোটা বিদ্যালয়ের কর্মকর্তারা আমাদের পাশে থাকে। বিনামূল্যে স্কুলড্রেস, বাইসাইকেল দেওয়াসহ নানা সুযোগ-সুবিধার কারণে এ বিদ্যালয়ে দিন দিন শিক্ষার্থীর সংখ্যাও বৃদ্ধি পাচ্ছে।
×