ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

গ্রন্থমেলার নির্বাচিত বই

৬ দফা : স্বাধীনতার অভিযাত্রায় বঙ্গবন্ধু

প্রকাশিত: ১০:৫৩, ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২০

  ৬ দফা :  স্বাধীনতার অভিযাত্রায় বঙ্গবন্ধু

মোরসালিন মিজান ॥ ঐতিহাসিক ছয় দফার ওপর, জেনে অনেকেই অবাক হবেন, পূর্ণাঙ্গ কোন বই নেই। নেই মানে, যথেষ্ট অনুসন্ধিৎসু হওয়ার পরও এ সংক্রান্ত কোন বইয়ের খোঁজ পাওয়া যায়নি। হ্যাঁ, বাঙালীর মুক্তির সনদ হিসেবে ৬ দফার যে তাৎপর্য, তা ইতিহাস বা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বইয়ে আলাদা গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরা হয়েছে। সভা সেমিনারগুলোতে এ সংক্রান্ত নানা বিশ্লেষণ উঠে আসছে প্রতিনিয়ত। আর মেঠো বক্তৃতা? সে তো চলমান। তাই ৬ দফা নিয়ে চর্চার যত সুযোগ ছিল, বাস্তবে অতটা হয়নি। গবেষণার উপাদানও একেবারে কম ছিল না। কিন্তু কুড়িয়ে একত্রিত করবেন কে? এক ধরনের শূন্যতা বিরাজ করছিল। শূন্যতার জায়গাটুকু আবিষ্কার এবং তা পূর্ণ করার সচেতন প্রয়াস গ্রহণ করেছেন মুনতাসীর মামুন। লিখেছেন ‘৬ দফা: স্বাধীনতার অভিযাত্রায় বঙ্গবন্ধু।’ সদ্য প্রকাশিত বইটি প্রথম দিন থেকেই অমর একুশে গ্রন্থমেলায় পাওয়া যাচ্ছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে উৎসর্গ করা মেলায় এ ধরনের প্রকাশনা অনেক বেশি আশা করা হয়েছিল। কিছু এসেছেও। তবে এ বইটি স্বতন্ত্র আলোচনার দাবি রাখে বলেই আমাদের মনে হয়েছে। জাতিরাষ্ট্র বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার প্রথম এবং অত্যন্ত কার্যকর পদক্ষেপ হিসেবে ৬ দফা দাবি উত্থাপন করেছিলেন বাঙালীর নেতা শেখ মুজিবুর রহমান। লক্ষ্য অর্জনে তিনি যেমন কৌশলী অবস্থান নিয়েছিলেন, তেমনি দেখিয়েছিলেন দুঃসাহস। বাঙালী নেতার ৬ দফা, দাবি আদায়ের আন্দোলন, এর বিকাশ এবং পরিণতি সম্পর্কে মোটামুটি ধারাবাহিক আলোচনা করা হয়েছে বইতে। সে সময়ের পত্রপত্রিকার অনুলিপি, বিভিন্ন সময়ে সংশ্লিষ্টদের লেখা বই, পুস্তিকা, স্মৃতিকথা ইত্যাদিকে সূত্র হিসেবে গ্রহণ করেছেন লেখক। তার কাজটিকে আরও সহজ করেছে শেখ মুজিবুর রহমানের লেখা ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ ও ‘কারাগারের রোজনামচা’র মতো তথ্যবহুল দুটি বই। মুনতাসীর মামুনের ভাষায়: ‘৩৬ বছরে নিজের লেখায় কর্মকা-ের যে বিবরণ তিনি (বঙ্গবন্ধু) দিয়েছেন তাতে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস পূর্ণভাবে লেখার একটি ভিত্তি তৈরি হয়েছে।’ সে ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে, সংগৃহীত তথ্য উপাত্তের আলোকে বইটি রচনা করা হয়েছে। পরিশ্রমী মুনতাসীর মামুন বইয়ে ৬ দফা ও এর আগে পরের ঘটনাবলীর যে বিশ্লেষণ করেছেন, তাকেও হয়তো পূর্ণাঙ্গ বলা যাবে না। তবে বইটি পাঠে পূর্বাপর সময়, ইতিহাস এবং বাঙালীর মুক্তির সংগ্রামের গুরুত্বপূর্ণ একটি অধ্যায়কে নানা ব্যঞ্জনায় আবিষ্কার করতে সক্ষম হবেন পাঠক। ‘৬ দফা : স্বাধীনতার অভিযাত্রায় বঙ্গবন্ধু’ বইয়ের দুটি ভাগ। প্রথমভাগে মূল আলোচনা। মৌলিক বিষয়গুলোর অবতারণা করা হয়েছে এ অংশে। ঠিক কবে থেকে মুজিবের চিন্তায় জায়গা করে নেয় ৬ দফা? এমন প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে পশ্চিমবঙ্গের বিখ্যাত কবি অন্নদাশঙ্কর রায়ের লেখা থেকে উদ্ধৃত করেন মুনতাসীর মামুন। যেখানে বঙ্গবন্ধু বলছেন, ‘সেই ১৯৪৭ সালে, আমি সুহরাবর্দী (সোহরাওয়ার্দী) সাহেবের দলে। তিনি ও শরৎচন্দ্র বসু চান যুক্তবঙ্গ। আমিও চাই সব বাঙালীর এক দেশ। ...দিল্লী থেকে খালি হাতে ফিরে এলেন সুহরাবর্দী ও শরৎ বোস। কংগ্রেস বা মুসলিম লীগ কেউ রাজি নয় তাদের প্রস্তাবে। তারা হাল ছেড়ে দেন। আমিও দেখি যে আর কোন উপায় নেই। ঢাকায় চলে এসে নতুন করে আরম্ভ করি। তখনকার মতো পাকিস্তান মেনে নেই। কিন্তু আমার স্বপ্ন সোনার বাংলা। সে স্বপ্ন কেমন করে পূর্ণ হবে এই আমার চিন্তা।’ এবং অতঃপর ইতিহাসের বন্ধুর পথ পাড়ি দিয়ে ৬ দফায় স্থির হন শেখ মুজিব। বইটি থেকে জানা যাচ্ছে, নেতার চিন্তাগুলো কাগজ-কলমে স্পষ্ট করার দায়িত্ব পান রুহুল কুদ্দুস, আহমদ ফজলুর রহমান ও শামসুর রহমান। এর আগেও নানা খসড়া হয়েছে। অন্তিমে কাজটি এ তিনজনই করেন। পরে ১৯৬৬ সালে লাহোরে ৬ দফা দাবি উত্থাপন করেন শেখ মুজিবুর রহমান। পেছনের বিস্তারিত বইতে তুলে ধরেছেন লেখক। মুনতাসীর মামুন উল্লেখ করেছেন, তার আগে ৬ ফেব্রুয়ারি চৌধুরী মোহাম্মদ আলীর বাসভবনে বিরোধী দলগুলোর বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে মুজিব ৬ দফা পাঠ করে তা আলোচনার বিষয় হিসেবে অন্তর্ভুক্তির দাবি তুলেন। কিন্তু বিরোধীরা সবাই তাতে অস্বীকৃতি জানান। এ অবস্থায় মুজিবের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ বৈঠক বর্জন করে। ওই দিনই এক সংবাদ সম্মেলনে ৬ দফা দাবি উত্থাপন করেন তিনি। পরদিন পত্রিকায় দাবিগুলো তুলে ধরা হয়। এর আগে পর্যন্ত আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা ১১ দফা সম্পর্কে জানতেন, ৬ দফা সম্পর্কে জানতেন না বলেই মত লেখকের। তিনি উল্লেখ করেন, ৬ দফা ঘোষণার আগে দলীয় ফোরামে তা আলোচিত হয়নি। ১১ তারিখ ঢাকায় ফিরে ১৩ ফেব্রুয়ারি মুজিব আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির মিটিং ডাকেন। আলোচনার শুরুতে ৬ দফা প্রস্তাব করা হলে সভাপতি তর্কবাগীশ তার কয়েকজন অনুসারীসহ সভা ত্যাগ করেন। সভাপতিত্ব করেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম। কাউন্সিলের অনুমোদন সাপেক্ষে ৬ দফা গৃহীত হয়। বিভিন্ন তথ্য প্রমাণ বলে, মূলধারা বা ক্ষুদ্র রাজনৈতিক দল কেউই সেই সময় ৬ দফা পছন্দ করেনি। ভাসানী থেকে আইউব সবাই ছিলেন বিরোধী। ছাত্র ইউনিয়ন তখন রুশ ও চিনা পন্থিতে বিভক্ত। আইউবের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিল সব ধরনের চীনপন্থীরা। পিকিংপন্থীদের কাছে শেখ মুজিব হয়ে দাঁড়ান সি আইয়ের এজেন্ট, বিচ্ছিন্নতাবাদী। গত বছরের মেলায় রাজনীতির রহস্য পুরুষ হিসেবে পরিচিত সিরাজুল আলম খানের একটি বই প্রকাশিত হয়। বই নিয়ে তখন আলোচনা সমালোচনায় মুখর হন অনেকে। তবে মুনতাসীর মামুন এ বইটিকেও সূত্র হিসেবে গ্রহণ করেছেন। বেশ কিছু বিষয় উদ্ধৃত করেছেন। সেখান থেকে জানা যায়, বুদ্ধিজীবীরাও ৬ দফার পক্ষ নেয়ার সাহস দেখাননি। বঙ্গবন্ধু তাই সিরাজুল আলম খানের এক প্রস্তাবের জবাবে বলেছিলেন, ‘আমাদের এই নপুংসক বুদ্ধিজীবীরা ৬ দফার কী বুঝবে রে?’ সিরাজুল আলম খানকে উদ্ধৃত করেই মুনতাসীর মামুন জানান, শেখ মুজিবুর রহমানের সম্মতিক্রমেই এ কাজের সঙ্গে তাজউদ্দিন আহমদকে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত করা হয়। বইতে শেখ মুজিবুর রহমানের উত্থাপন করা ৬ দফা হুবহু তুলে ধরা হয়েছে। দাবির পক্ষে বক্তব্য রাখতে গিয়ে বাঙালীর নেতা তখন বলেছিলেন, ‘আমার প্রস্তাবিত ৬ দফা দাবিতে যে পূর্ব পাকিস্তানের সাড়ে পাঁচ কোটি শোষিত বঞ্চিত আদম সন্তানের অন্তরের কথাই প্রতিধ্বনি হইয়াছে, তাতে আমার কোন সন্দেহ নাই।’ ৬ দফা নিয়ে ঘরে বাইরে টানাপোড়েন, পক্ষে-বিপক্ষে জনসভা, আন্দোলন, মামলা ইত্যাদি নানা বিষয় এ পর্বে যুক্ত করা হয়েছে। বইয়ের দ্বিতীয় পর্ব প্রথম পর্বটিকে জোর সমর্থন দিয়ে যায়। এ সংক্রান্ত যত পত্রপত্রিকা সব একত্রিত করেছেন লেখক। সঙ্কলিত সংবাদগুলোকে ১৪টি ভাগে ভাগ করে উপস্থাপন করেছেন। বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতা ও পর্যবেক্ষণ, জনসভায় দেয়া কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় নেতাদের ভাষণ, পশ্চিম পাকিস্তানের জনসভায় ৬ দফা, বিরোধিতাকারীদের সভা সমাবেশে ওঠে আসা বক্তৃতা, দফার পক্ষে বিবৃতি, মুজিবের বিরুদ্ধে মামলা, গ্রেফতার, মামলার রায় ইত্যাদি বিষয়ের দালিলিক উপস্থাপনা আছে দ্বিতীয় পর্বে। এর ফলে মূল লেখাটির সঙ্গে পত্রিকা বই ও অন্যান্য সূত্র মিলিয়ে নেয়ার সুযোগ পাবেন পাঠক। পরবর্তী প্রজন্মের গবেষণার জন্যও বইটি বিশেষ কাজে আসতে পারে। ৪৯৬ পৃষ্ঠার বইটি প্রকাশ করেছে মাওলা ব্রাদার্স। মূল্য ৬৫০টাকা।
×