ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

হায়দার মোহাম্মদ জিতু

বাংলা অনুবাদ সাহিত্যের দুর্বলতা

প্রকাশিত: ০৮:০৩, ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২০

  বাংলা অনুবাদ সাহিত্যের দুর্বলতা

বাংলা সাহিত্যের ‘আকাশ জানালায়’ কোকিল ডাকে না বহুকাল। চারদিকে মেদ-চর্বিযুক্ত ফেনা তোলা পক্ষপাতমূলক আচরণ। আর এটাই এখন হয়ে উঠেছে এখনকার সামষ্টিক ব্যাকরণ। ঘুণে ধরা প্রথার বাইরে গিয়েও যে ভাবা যায়, চর্চা করা যায় এবং লেখা যায়; সেই সঙ্কট অনুভব করছে না বর্তমান সমাজ সভ্যতা। প্রণোদনা প্যাকেজের মুনাফা লোভে একক প্রবাহিত ধারার পক্ষে লেখকদের কলম-কালি। কিন্তু হালের সামাজিক সঙ্কট এবং ভবিষ্যত দর্শন নিয়ে পাঠক মহলে তোলপাড় ঘটাতে পারে কিংবা মরিচা জমা চিন্তার জানালা খুলে যেতে পারে সেরকম দর্শন বা চিন্তা প্রায় নিরুদ্দেশ। আর এর কারণ আমাদের সাংস্কৃতিক বিনিময় সঙ্কট এবং চর্চার ক্ষেত্রে দীর্ঘ শূন্যতা। দীর্ঘ শোষণের ফলস্বরূপ উপমহাদেশীয় সমাজচিন্তা আজও ঔপনিবেশিক মগজ-মজ্জা থেকে বেরোতে পারেনি। আজও তারা মনে করে বিশ্ব বলতে শুধু পাশ্চাত্য, আর বৈশ্বিক মানুষ বলতে শুধু ইংরেজী জানা মানুষ। সাহিত্য বলতে ইংরেজীতে লেখা প্রবন্ধ, উপন্যাস, গল্প, কবিতা। কিন্তু বর্তমান বিশ্ব যে এই একতরফা ইংরেজীর ‘বলয় ছায়া’ থেকে বেরিয়ে এসেছে এবং বিশ্ব সাহিত্য ও চিন্তার বাজার যে ইংরেজীকে ছাড়িয়ে অন্য ভাষাভাষী মানুষের মাঝেও বিকশিত হয়ে উঠছে সেই খবরটাই রাখে না এই অঞ্চলের জনগণ। অথচ এই মহাজগতের প্রায় ৭০০ কোটি মানুষের মাঝে এক চীনারাই আছেন ১৩০ কোটি, যাদের ভাষা মান্দারিন। আর এই এক হিসেবেই ইংরেজী চলে যায় দ্বিতীয় স্থানে। অপরদিকে জনসংখ্যার হিসেবে ভাষাভাষীতে তৃতীয় এবং চতুর্থ স্থানে হিন্দী, স্প্যানিশ। যে ভাষায় কথা বলে যথাক্রমে প্রায় ৫০ ও ৪০ কোটি মানুষ। আর পঞ্চম স্থানে থাকা বাংলায় কথা বলে প্রায় ৩৮ কোটি মানুষ। এরপর আছে রুশ, আরবী, পর্তুগিজ, মালয়, ফ্রেঞ্চসহ নানান ভাষা। ধারণা করা হয় সম্পদের প্রাচুর্য থাকলে, এককথায় পেটে খাবার থাকলে মানুষ শিল্প-সাহিত্যের রস আস্বাদনে আগ্রহী হয়ে ওঠে। যদিও সেক্ষেত্রে নৃতাত্ত্বিকভাবে তার রক্তেও সেই আগ্রহ থাকাটা জরুরী। কিন্তু ইতিহাস মতে, প্রত্যেক জাতিই সৃষ্টি হয়েছে তার শিল্প-সাহিত্য এবং সংস্কৃতির ওপর ভর করে। সে হিসেবে বাংলার জীবন ইতিহাস রসের ইতিহাস। কিন্তু সে হিসেবে এর কোন বাজারজাতকরণ নেই। এ প্রসঙ্গ ব্যাখ্যায় ভারতীয় লেখক একক অরুন্ধতী রায়ই যথেষ্ট। দেখা যায় তিনি তার প্রথম উপন্যাস ‘দ্য গড অব স্মল থিংস’ দিয়েই লেখক খাতি অর্জন করে ফেলেছেন। নিজের লেখনী শক্তি তো আছেই কিন্তু তার পাশেও এর একটি অন্যতম কারণ এই উপন্যাসের ইংরেজী ভাষায় লেখনী। বাংলার সংস্কৃতি প্রতিনিয়ত বহমান। এখানে প্রতিনিয়ত গল্প গড়ে, গল্প ভাঙ্গে। সে হিসেবে এই বাংলার শিল্প-সাহিত্যের মনন মানচিত্রে যে অফুরন্ত রস লুক্কায়িত তাকে যথাযথভাবে বাজারজাতকরণ করতে পারলেই বিশ্ব সাহিত্যের বাজার হবে এই বাংলার। আর এজন্য প্রয়োজন সঠিক অনুবাদক দল; যারা বাংলা সাহিত্য কিছুটা হলেও জানেন এবং পড়েছেন। কারণ এই বিষয়ে খানিক জানা থাকলে নিজের এবং অন্যের সাহিত্য অনুবাদে সাহিত্যের সীমানা পাওয়া যাবে। প্রবাদ আছেÑ আগে ঘর পরে পর। অর্থাৎ নিজেরটা আগে জানা দরকার। নইলে এসব অনুবাদ বনে যাবে নিছক চরকা কাটা বাক্যমাত্র। তবে বিশেষ জরুরী এই বাংলার সাহিত্য ভাণ্ডারকে ভিনদেশী ভাষায় অনুবাদ করে ছড়িয়ে দেয়া। আর এক্ষেত্রে একপাক্ষিক ইংরেজী ভাষাকে একক প্রবেশদ্বার না বানিয়ে বৃহৎ বাজারকে চিহ্নিত করে বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদের পরিধি বাড়ানো প্রয়োজন। তাছাড়া চাহিদার সঙ্গে যোগানের সামঞ্জস্য নেই বলেই আজও বিশ্ব পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যায়নি। পারস্পরিক এই নির্ভরশীলতায় বিশ্ব ব্যবস্থা টিকে আছে । তবে এই পারস্পরিক নির্ভরতা যত শিল্প-সাহিত্যনির্ভর হবে ততই বিশ্ব হবে আরও সহনশীল ও বৈশ্বিক। আর এই সুযোগটা বাংলা সাহিত্য নিতে পারে। সেক্ষেত্রে রাষ্ট্র কর্তৃক বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদের সংখ্যা বাড়িয়ে বাংলার সহজিয়া সংস্কৃতি-সাহিত্যকে বিশ্বব্যাপী শাসনের সুযোগ করে দেবার সুযোগ আছে। এক্ষেত্রে এই খাতে ভর্তুকি বাড়িয়ে ঐ রাষ্ট্রগুলোতে প্রায় নামমাত্র মূল্যে বাংলার সাহিত্যকে পৌঁছে দেয়া জরুরী। অর্থাৎ, বৈশ্বিক বাজারে বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করতে হবে বৈশ্বিক কূটনৈতিক রীতিতেই। ভিন্নভাবে বললে সমৃদ্ধ বাংলা সাহিত্যকে বৈশ্বিক বাজারে ছড়িয়ে দিতে প্রয়োজনে ব্রিটিশ চা-সিগারেট নীতি গ্রহণ করা যেতে পারে। অর্থাৎ, প্রথমে বিনামূল্যে সরবরাহ করে পরে অভ্যাস হয়ে গেলে বাজার বুঝে দাম। বৈশ্বিক রাজনীতিতে শুধু অর্থনৈতিক বাজার দখলের প্রতিযোগিতা বেশিদিন সুবিধা করতে পারে না। তাই এর পাশাপাশি নিজের দেশের মনন-মগজকেও টেনে নিতে হয়। তাছাড়া যে কোন রাষ্ট্রের ইতিহাস, ঐতিহ্য, গৌরব, গরিমা প্রকাশ পায় তার সাহিত্যের ওপর ভর করেই। একে মেনেই এই অঞ্চলের রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, রামমোহন রায় ইংরেজী ভাষাতে কিছু কিছু সাহিত্য রচনা করে গেছেন। বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে খানিক হলেও বৈশ্বিক করার চেষ্টা করেছেন। বাংলা ভাষা এবং সাহিত্যের গভীরতা ব্যাপক। যার প্রমাণ বর্তমান বিশ্বের চার মহাদেশের ত্রিশটি দেশের একশ’ বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি নিয়ে গবেষণা ও চর্চা হচ্ছে। এক যুক্তরাষ্ট্রেরই কমপক্ষে দশটি বিশ্ববিদ্যালয় ও এশীয় গবেষণা কেন্দ্রে বাংলা ভাষার গবেষণা কার্যক্রম চলছে। সেখানকার মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষার অর্থ প্রকাশে মনস্তত্ত্বের ভূমিকা নিয়ে কাজ করছেন জাস্টিন আলফান্সো চাকোন। নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ে মারিয়া হেলেন বেরো কাজ করছেন নজরুল সাহিত্য নিয়ে এবং ক্লিনটন বি সিলি জীবনানন্দ দাশ ও তার কবিতা নিয়ে কাজ করছেন। জার্মানির হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ এশিয়া বিভাগের হান্স হারডার গবেষণা করছেন চট্টগ্রামের মাইজভান্ডার নিয়ে। পাশ্চাত্যের সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর রাজনৈতিক ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়Ñ কোন রাষ্ট্রকে কব্জা করতে প্রথমেই তারা ঐ অঞ্চলের নৃতাত্ত্বিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং সাহিত্যের ধারণা নেন। যার ওপর ভর করেই তারা চালাত বৈশ্বিক শাসন-শোষণ। আধুনিক জামানায় শাসনের ধরন বদলে গেছে। এখন এক দেশ আরেক দেশকে অর্থনীতি, সংস্কৃতি, সাহিত্য দিয়ে প্রভাবিত করে। বাংলাদেশের দার্শনিক-সাহিত্যিক লালন, হাছনরাজা, বাউল শাহ আবদুল করিম, আরজ আলী মাতুব্বর প্রমুখের কর্মপরিধি সম্পর্কে বিশ্ব ব্যাপক অর্থে কিছুই জানে না। অথচ এই দর্শন বিশারদদের চিন্তাগুলোকে ইংরেজী, স্প্যানিশ, মান্দারিন কিংবা অন্য কোন ভাষায় অনুবাদ করে বিশ্বব্যাপী এই অঞ্চলের দর্শন-চিন্তা সম্পর্কে জানানোর একটা সুযোগ ছিল। আবার যদিও এদের নিয়ে কিছু কিছু অনুবাদ হয়েছে তাও মজুরি দেয়া অনুবাদ। ফলে ক্ষেত্রবিশেষে একেবারে বিকৃতি ঘটে যাচ্ছে লেখকের চিন্তা বা দর্শনের। এই অঞ্চলের বাংলা সাহিত্যের ট্র্যাডিশনাল ট্র্যাজেডি হলো এখানকার লেখক এবং বৈশ্বিক পাঠকের মাঝে দোভাষী এবং সাহিত্যামোদী অনুবাদকের অপ্রতুলতা। আর যা আছে তা দুই মেরুর সুর-লয় বুঝতে প্রায় অক্ষম। কাজেই বৈশ্বিক বাজারে নিজেদের শিল্প-সংস্কৃতি এবং সাহিত্যকে আরও মেলে ধরতে এই সঙ্কটকে চ্যালেঞ্জ জানাতে হবে। পাশাপাশি বিশ্ববাজারে বাংলার যে স্বকীয় ট্র্যাডিশন এবং আইডেন্টিটি সেটা প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে রাষ্ট্র এবং লেখক ফোরামকে আরও যতœশীল হওয়া জরুরী। কারণ, এর মাধ্যমেই বিশ্বব্যাপী বাংলা ও বাঙালী হয়ে উঠবে দীপ্তিমান। লেখক : ছাত্রনেতা [email protected]
×