ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

সাবিহা রহমান

বাঙালীর উৎসব বইমেলা ও বসন্ত

প্রকাশিত: ০৬:২৬, ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২০

বাঙালীর উৎসব বইমেলা ও বসন্ত

সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যান থেকে ভেসে আসছে পাখির ডাক। চারদিকে শুকনো পাতার ওড়াউড়ি। প্রকৃতিতে বসন্তের আবাহন। এসেছে বসন্ত। সেই শিহরণ প্রকৃতিজুড়ে। শুরু হয়েছে ফাল্গুন, ঋতুরাজ বসন্ত এখন প্রকৃতিতে। সেই আনন্দের রং লেগেছে মেলায়। বাসন্তী শাড়ি পরে, খোঁপায় ফুল গুঁজে মেয়েদের ঘুরে বেড়ানো মেলায় উৎসবের রং বুলিয়ে দেয়। ঝিরঝিরে পাতা ঝরার শব্দের মতো দলে দলে মানুষ এসেছে মেলায়। তরুণীদের পোশাকে ছিল বসন্তের ছোঁয়া। সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানে, বাংলা একাডেমির গাছে গাছে কোকিলের কুহু কুহু ডাক মেলায় আগতদের জানান দিচ্ছিল বসন্ত এসে গেছে। এবারের বইমেলা সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানের অনেকটা অংশজুড়ে বাড়ানো হয়েছে। পরিসর বাড়ায় প্রাণভরে বইমেলা উপভোগ করছে সবাই মেলা। আমি বইমেলার নিয়মিত একজন অংশগ্রহণকারী। অভ্যাসটা হয়ে গিয়েছিল ২০০৭ সালের দিক থেকে। মেলা চলাচলে প্রতিদিন বিকেলবেলা মেলা চত্বরে ঘণ্টাখানেক ঘুরে বেড়াতে আমার ভাল লাগত। নতুন নতুন বই দেখা, কবি-সাহিত্যিকদের চোখের সামনে ঘুরে বেড়ানো, বই কিনে তাঁদের সই নেয়া এসবে পুলক বোধ করতাম। দিনে দিনে তা কমে আসতে থাকে। জনসংখ্যার সঙ্গে বাড়তে থাকে লেখক-প্রকাশকের সংখ্যা। দর্শক-ক্রেতায় টইটম্বুর হয়ে যায় মেলা প্রাঙ্গণ। বাংলা একাডেমি এই বইমেলার আয়োজক। তারা এই মেলার পরিসরকে নিয়ে দুই দশক ধরে নানা রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছে। নানা অস্বস্তিকর পরিস্থিতির শিকার দর্শককুলের গঞ্জনা উপভোগ করে পরের বছর একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটিয়েছে। বাঙালী উৎসবপ্রিয় জাতি। আর ঢাকা এমনই এক দুর্বিষহ শহরে পরিণত হয়েছে, যেখানে হেঁটে একটু বেড়ানোর মতো জায়গার বড় অভাব। সে কারণে উপলক্ষ পেলেই ঢাকার মানুষ ঘর থেকে বেরিয়ে শাহবাগমুখী হয়। ওখানে নানা রকমের মানুষ আসে, প্রাণ খুলে কথা বলা যায়, হাঁটা যায়, ঘুরে বেড়ানো যায়। তার সঙ্গে যদি থাকে বইয়ের অনুষঙ্গ, যেখানে বেশ কিছু লেখকেরও সমাগম হয়, তাহলে নতুন বই দেখা, পছন্দ হলে দু-চারটে কেনা কিংবা প্রিয় কোন লেখকের সঙ্গে দেখা হয়ে যাওয়া সে তো বাড়তি পাওনা। সুতরাং এ ধরনের একটি মেলার আয়োজন যারা করবে, তাদের সবচেয়ে আগে বিবেচনা করতে হবে সংখ্যাগরিষ্ঠ এই দলটির কথা। এ কেবল বইয়ের মেলা নয়, এটি বাঙালীর প্রাণের মেলা। একুশের চেতনাদীপ্ত প্রতিষ্ঠান বাংলা একাডেমি আয়োজিত অমর একুশে বইমেলা শুরু হয় ১ ফেব্রুয়ারি থেকে। চলে সারা ফেব্রুয়ারি মাসজুড়ে। ভাষা আন্দোলনের মাসে আয়োজিত এ মেলাকে কেন্দ্র করে বাঙালীর সংস্কৃতিচর্চা ঋদ্ধ হয়। সময়ের পরিক্রমায় একুশে বইমেলা আমাদের বৃহত্তর সাংস্কৃতিক মেলায় পরিণত হয়েছে। এর মাধ্যমে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের চর্চা সমৃদ্ধ হচ্ছে। এই মেলার সঙ্গে জড়িয়ে আছে ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি। ভাষার জন্য সেদিন যারা প্রাণ দিয়েছিলেন, তাদের স্মৃতি অম্লান রাখতেই এই মেলার নামকরণ ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা।’ মাত্র ৩২টি বই নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল এই বইমেলা। ১৯৭২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি মুক্তধারার প্রকাশক চিত্তরঞ্জন সাহা একক উদ্যোগে বইমেলা শুরু করেন। ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত তিনি একাই মেলা চালিয়ে গেছেন। পরে ক্রমান্বয়ে আরও প্রকাশনা ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠান এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। ১৯৭৮ সালে বাংলা একাডেমি বইমেলার সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়। তবে তখনও মেলার পরিসর ছিল ভিন্ন। বর্তমানে যে পরিসরে একুশে বইমেলার আয়োজন করা হচ্ছে তা শুরু হয় ১৯৮৪ সাল থেকে। শুরুতে ফেব্রুয়ারি জুড়ে বইমেলা চলত না, কিন্তু বর্তমানে পুরো ফেব্রুয়ারিই বইমেলার মাস। লাখ লাখ মানুষের সমাগম ঘটে মেলায়। এখানে বাণিজ্যিক দিকটির চেয়ে বড় হয়ে ওঠে সাংস্কৃতিক মেলবন্ধনের দিকটি। হলদে সাজে, বাঙালীর বসন্ত বরণ উৎসব পালনের ইতিহাস খুব বেশি পুরনো নয়। প্রাচীন বাংলায় সব ধর্মের মানুষের মধ্যে বসন্তকে বরণ করে নিতে কোন আয়োজন ছিল বলে জানা যায় না। তবে, সনাতন ধর্মাবলম্বীরা প্রাচীনকাল থেকেই বসন্ত বরণ করছে উৎসব আমেজে। বৈষ্ণব মত অনুসারীরা এ উৎসব পালন করত বেশ ঘটা করে। আমরা দোল উৎসব বা হোলি খেলা সম্পর্কে জানেন। এই দোল বা হোলি উৎসবই হিন্দুদের বসন্ত উৎসব। যা পালিত হয়ে আসছে শ্রীকৃষ্ণের সময় থেকে। হিন্দু ধর্ম অনুসারীরা বিশ্বাস করে , ফাগুনের পূর্ণিমা তিথিতে, শ্রীকৃষ্ণ বৃন্দাবনে রাঁধাকে আবির বা রং মাখিয়ে দিয়েছিলেন। বাঙালীর হলুদ বরণে বসন্ত পালন শুরু হয় কবিগুরু রবি ঠাকুরের সময় থেকে। রাবীন্দ্রিক সাজে, নাচে-গানে বসন্তকে বরণ করে নেয়া হতো শান্তিনিকেতনে। সেই থেকে শুরু বাঙালীর হলদে- সোনালি বসন্ত বরণ। এ তো গেল ওপার বাংলায়। এপারে মানে বাংলাদেশে বসন্ত বরণ উৎসব চালু হয় ১৪০১ বঙ্গাব্দ থেকে। বসন্ত উদযাপন পরিষদ প্রতি বছর পহেলা ফাল্গুনে আয়োজন করে আসছে বসন্ত বরণ উৎসব।
×