ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

‘মুভি মোগল’ জাহাঙ্গীর খান আর নেই

প্রকাশিত: ০৭:২৭, ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২০

 ‘মুভি মোগল’ জাহাঙ্গীর খান আর নেই

সংস্কৃতি ডেস্ক ॥ বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাসে ‘মুভি মোগল’ খ্যাত কিংবদন্তি প্রযোজক, পরিচালক, পরিবেশক জাহাঙ্গীর খান আর নেই। গতকাল শনিবার বেলা পৌনে ১২টায় রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। মৃত্যুকালে বয়স হয়েছিল ৮১ বছর। কিংবদন্তি এই চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্বের মৃত্যুতে শোক জানিয়েছেন চলচ্চিত্র অঙ্গনের মানুষরা। তারা মরহুমের বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করেন এবং শোক সন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি সমবেদনা জানান। জাহাঙ্গীর খানের মেয়ে সঙ্গীতশিল্পী ঝুমু খান জানান, মূলত বার্ধক্যজনিত সমস্যায় ভুগছিলেন তার বাবা। অক্টোবর থেকেই অসুস্থতা শুরু হয়। তবে বড় কোন রোগ ছিল না। গত কয়েকদিন শারীরিক অবস্থা ক্রমে খারাপ হতে থাকে। অবশেষ শনিবার সকালে চলে গেলেন তিনি। গতকাল মাগরিবের নামাজের পর গুলশানের ভোলা মসজিদে প্রথম জানাজা হয়। এরপর এশার নামাজের পর মুগদাপাড়ায় স্থানীয় মসজিদে জানাজা শেষে সেখানকার পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়। ‘নয়নমণি’, ‘শুভদা’, ‘কি যে করি’, ‘সওদাগর’, ‘সূর্যকন্যা’, ‘সীমানা পেরিয়ে’, ‘আলিঙ্গন’, ‘তুফান’, ‘রঙিন রূপবান’, ‘আলী বাবা ৪০ চোর’সহ আরও অনেক জনপ্রিয় ও ব্যবসাসফল চলচ্চিত্রের প্রযোজক এ কে এম জাহাঙ্গীর খান ১৯৩৯ সালের ২১ এপ্রিল কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম চিওড়া কাজীবাড়ি মাতুলালয়ে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। পুরো নাম আবুল খায়ের মোঃ জাহাঙ্গীর খান। শৈশবে বেশ দুরন্ত স্বভাবের ছিলেন তিনি। মাত্র ছয় বছর বয়স থেকে চলচ্চিত্র দেখা শুরু করেন। চলচ্চিত্র দেখা তার কাছে একটি আদর্শের বিষয় মনে হতো। কানন দেবীর চলচ্চিত্রের ভক্ত ছিলেন তিনি। শরৎচন্দ্রের ‘মেজদিদি’র চলচ্চিত্রায়ন দেখে চলচ্চিত্রের প্রতি অনুপ্রাণিত হন। সত্যজিৎ রায়ের চলচ্চিত্র তাকে চলচ্চিত্র জগতে আসতে উৎসাহিত করে। ১৯৫৮ সালে ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস, ১৯৬০ সালে জগন্নাথ কলেজ থেকে আইএসসি ও ১৯৬২ সালে বিএসসি পাস করেন। ১৯৬৩ সালে জাপানে ফুজি কোম্পানিতে ইঞ্জিনিয়ারিং সেক্টরে যোগ দেন। ঢাকাই চলচ্চিত্রের প্রথম সবাক চলচ্চিত্র ‘মুখ ও মুখোশ’-এর নির্মাতা আবদুল জব্বার খানের দেশীয় সংস্কৃতির প্রতি হৃদয়ের টান জাহাঙ্গীর খানকে মুগ্ধ করেছিল বলেই চলচ্চিত্রে নিজেকে যুক্ত করাটা তারপক্ষে সহজ হয়েছিল বলে এক সাক্ষাতকারে জানান তিনি। জাহাঙ্গীর খানের সর্বশেষ নির্মাণ ছিল ১৯৯৮ সালে তার প্রযোজিত ‘রঙিন নয়নমণি’ চলচ্চিত্রটি। মাঝে দীর্ঘদিন চলচ্চিত্র প্রযোজনা থেকে দূরে ছিলেন। প্রায় ২০ বছর পর আবার একসঙ্গে তিনটি চলচ্চিত্র নির্মাণের ঘোষণা দিয়ে ফেরেন তিনি। ‘স্বাধীনতা’, ‘ডাক দিয়াছেন দয়াল আমারে’ ও ‘রাধারমণ’ চলচ্চিত্র তিনটির মহরত হয়েছিল গেল অক্টোবরে। স্বাধীনতার পর যে কজন দাপুটে প্রযোজক বাংলাদেশে চলচ্চিত্র শিল্পকে এগিয়ে নিতে কাজ করেছেন তাদের মধ্যে অন্যতম এ কে এম জাহাঙ্গীর খান। ১৯৭৮ সালে ‘চিত্রালী’ সম্পাদক প্রয়াত আহমদ জামান চৌধুরী তাকে ‘মুভি মোগল’ খেতাব দেন। তখন থেকে তিন যুগেরও বেশি সময় ধরে তিনি ঢাকার চলচ্চিত্র জগতে এ নামেই পরিচিত হয়ে আসছেন। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে জাহাঙ্গীর খানের অবদান অনেক। তিনি চলচ্চিত্র প্রযোজনায় এসেছিলেন ১৯৭৩ সালে তার বাবা মারা যাওয়ার পর। তবে তারও আগে থেকে চলচ্চিত্রের পরিবেশক ছিলেন। বাবুল চৌধুরীর ‘সেতু’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে ডিস্ট্রিবিউশন শুরু করেন তিনি। মূলত ‘মা’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে তার প্রযোজনা শুরু হয়। ১৯৮৬ সালে তার প্রযোজিত ও চাষী নজরুল ইসলাম পরিচালিত ‘শুভদা’ চলচ্চিত্রটি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে ১৩টি সম্মাননা অর্জন করে অনন্য রেকর্ড গড়ে। ১৯৭৬ সালে তিনি প্রথম ‘নয়নমণি’ চলচ্চিত্রটি প্রযোজনা করেন। এর আগে ১৯৭৩ সালে তার প্রথম পরিবেশিত চলচ্চিত্র ছিল ‘যাহা বলিব সত্য বলিব’। ৪৩টি চলচ্চিত্রের প্রযোজক ও পরিবেশক তিনি। এ মুভি মোগল প্রযোজিত চলচ্চিত্র টানা ২৫ সপ্তাহ, ৮১ সপ্তাহ, এমনকি ১০৩ সপ্তাহ ধরে প্রদর্শিত হয়েছে। অর্থাৎ রজতজয়ন্তী, সুবর্ণজয়ন্তী, হীরকজয়ন্তী ছুঁয়ে সগৌরবে চলেছে। বাংলাদেশে আমজাদ হোসেন পরিচালিত ‘নয়নমণি’ চলচ্চিত্রটি প্রথম টানা ১০৩ সপ্তাহ চলার রেকর্ড গড়েছিল। তৎকালীন সময় ১৬ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মিত এ চলচ্চিত্রটি এক কোটি টাকার ব্যবসা করে। আর এ চলচ্চিত্রের প্রযোজক হলেন জাহাঙ্গীর খান। ২০১৬ সালে এ কে এম জাহাঙ্গীর খান তার প্রযোজনা সংস্থা আলমগীর পিকচার্সের ব্যানারে নির্মিত ৪৩টি চলচ্চিত্রের প্রিন্ট, পোস্টার, ফটোসেট, এ্যালবাম বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভকে প্রদান করেন।
×