ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় দালালমুক্ত করার উদ্যোগ কাজে আসছে না

প্রকাশিত: ০৯:১৫, ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২০

প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় দালালমুক্ত করার  উদ্যোগ কাজে আসছে না

ফিরোজ মান্না ॥ বিদেশে চাকরি নিয়ে যেতে কর্মীদের শুরুতেই দালালের হাতে পড়তে হচ্ছে। নারী-পুরুষ যারাই বিদেশ যাবেন তারাই দালালের হাত ধরে ঢাকায় আসছেন। প্রথম ধাপ ‘ফিঙ্গার প্রিন্ট’ বা রেজিস্ট্রেশন করা থেকে শুরু করে বেশ কয়েকটি ধাপ পার করতে হচ্ছে দালালের মাধ্যমে। দালাল ছাড়া কোন কর্মী ফিঙ্গার প্রিন্ট করতে পারছেন না। এই ধাপ পার করলেই শেষ না। পুরো প্রক্রিয়া শেষ করতে যে কয়েকটি ধাপ রয়েছে প্রতিটি ধাপেই টাকা গুনতে হচ্ছে বিদেশগামী কর্মীকে। কয়েক মাস ঘোরার পর চূড়ান্ত পর্যায় এলে বিদেশ যেতে পারেন একজন কর্মী। প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের দালাল মুক্ত করার কোন উদ্যোগই এখানে কাজে লাগছে না। র‌্যাব, পুলিশ দিয়েও দালাল তাড়ানো সম্ভব হয়নি। এমন কি মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করেও দালাল চক্রের কার্যক্রম বন্ধ করতে পারেনি মন্ত্রণালয়। সম্প্রতি প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সামনে দাঁড়িয়ে দেখা গেছে দালালদের কার্যক্রম। মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইর থেকে রোকেয়া বেগম (৩০) (ছদ্ম নাম) খুব ভোরে গ্রামের দালালের সঙ্গে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ে আসেন। গ্রামের দালাল তাকে তুলে দিলেন ঢাকায় মন্ত্রণালয়ের সামনে থাকা আরেক দালালের কাছে। তার সঙ্গে গ্রামের দালাল দর কষাকষি করছেন কত টাকায় ‘ফ্রিঙ্গার প্রিন্ট’ করে দিতে পারবেন। দরদাম শেষে ঠিক হলো ২ হাজার টাকা লাগবে। এবার রোকেয়াকে রাজি করার পালা। এক পর্যায়ে রোকেয়া তার হাত ব্যাগ খুলে ২ হাজার টাকা দিলেন ঢাকার দালালের হাতে। এখন অপেক্ষার পালা কখন রোকেয়া বেগমের ফিঙ্গার প্রিন্ট নেবে মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট বিভাগ। এর আগে তার একটি ফরম পূরণ করতে হলো। সেই ফরম পূরণের জন্য দালাল আবার ২শ’ টাকা নিলেন। সকাল থেকে দুপুর গড়িয়ে যাচ্ছে দালাল তাকে অপেক্ষায় রেখেছে বলে জানালেন রোকেয়া। কিন্তু তার আর ডাক পড়ছে না। কখন ডাক পড়বে তাও সে জানে না। এমন হাজারো রোকেয়া বেগম ও দেলোয়ার হোসেন প্রতিদিন দালালের মাধ্যমে প্রতারিত হচ্ছেন। মন্ত্রণালয়ের সামনে একটি চায়ের দোকানে রোকেয়া ও জোৎ¯œা বেগমের সঙ্গে কথা হলো। তারা কাতার যাওয়ার জন্য ফিঙ্গার প্রিন্ট ও স্মার্ট কার্ড নিতে এসেছেন। সব কাজই তারা দালালের মাধ্যমে করতে দিয়েছেন। তারা একা নন তার মতো হাজারও বিদেশ যেতে ইচ্ছুক কর্মীরাও দালালের মাধ্যমে ফিঙ্গার প্রিন্ট করতে দিয়েছেন দালাল ধরেই। এখানে দালাল ছাড়া নিজে কিছু করার কোন উপায় নাই। যদিও মাঝে মধ্যে ভেতর থেকে ঘোষণা করা হচ্ছে আপনারা কেউ কোন দালালের হাতে টাকা দেবেন না। নিজের কাজ নিজে করে নিবেন। কিন্তু এই ঘোষণা কেবল ঘোষণার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়ে যাচ্ছে। মন্ত্রণালয়ের সামনে চায়ের দোকানদারও দালাল গিরি করেন। তাছাড়া পেশাদার কয়েক শ’ দালাল এখানে তো আছেই। এ কাজে সহযোগিতা করেন আনসার ও মন্ত্রণালয়ের কিছু কর্মচারী। কয়েক জন আনসার ও মন্ত্রণালয়ের কর্মচারীদের সঙ্গে আলাপ হলো (যাদের নাম প্রকাশ করা যাচ্ছে না) তারা জানালেন, যে টাকা নেয়া হয় তা অনেক ভাগে ভাগ হয়। আমাদের অল্প কিছু থাকে। বড় টাকা চলে যায় বড় জায়গায়। প্রতিদিন কয়েক হাজার বিদেশ যেতে ইচ্ছুক কর্মীর ফিঙ্গার প্রিন্ট নেয়া হয়। একই সঙ্গে হাজার হাজার স্মার্ট কার্ডও ডেলিভারি দেয়া হচ্ছে। দুই জায়গায়ই কর্মীদের টাকা দিতে হচ্ছে। দালালরা যার কাছ থেকে যত টাকাই নিচ্ছে তার বেশিরভাগই অন্য জায়গায় চলে যাচ্ছে। কর্মীদের এই টাকা দিতেও হচ্ছে। কারণ এই কার্ড হাতে না থাকলে কোন কর্মী বিদেশে চাকরি নিয়ে যেতে পারবেন না। কর্মী নিয়োগকারী দেশগুলো স্মার্ট কার্ড বাধ্যতামূলক করে দিয়েছেন। কর্মী প্রেরণকারী দেশ ও কর্মী নিয়োগকারী দেশের মধ্যে একটি কমন সাভার রয়েছে। এয়ারপোর্টে ইমিগ্রেশন ওই কার্ড থেকেই কর্মীর সব তথ্য পাওয়া যাবে। এ কারণেই নিজের সব তথ্য দিয়ে একটি ফরম পূরণ করতে হয়। ওই ফরম জমা দেয়ার পর ফিঙ্গার প্রিন্ট দিতে হয় একজন বিদেশগামী কর্মীকে। এরপরই পাওয়া যায় স্মার্ট কার্ড। বিদেশে চাকরি নিয়ে যাওয়ার খরচ এখান থেকেই বাড়তে শুরু করে। জনশক্তি রফতানিকারকের কাছে আসতে একজন কর্মীর কাছ থেকে নানা ছলে বলে টাকা নিয়েই যাচ্ছে। এরপর জনশক্তি রফতানিকারকরা তো আছেই। দালালের বিষয় নিয়ে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, দালাল তো বন্ধ করা হয়েছিল। আবার তারা বসেছে নাকি। দু’একদিনের বিরুদ্ধে দালালদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে দালাল তাড়ানো হবে। কোন দালাল এখানে থাকতে পারবে না। চায়ের দোকানদারও দালালের কাজ করছেন, এমন কথা শোনার পর ওই কর্মকর্তা বলেন, চায়ের দোকানও রাখা হবে না। বিদেশে ইচ্ছুক কর্মীদের জন্য সহজ ফরম করা হয়েছে। এটা পূরণ করে জমা দিলেই তারা ফিঙ্গার প্রিন্ট দিতে পারেন। কয়েক ঘণ্টা পরেই স্মার্ট কার্ড পেয়ে যেতে পারে। খুব দেরি হলে পরের দিন কর্মীরা স্মার্ট কার্ড পাবেন। এখানে দালালের কোন কাজ নেই। বিষয়টি মনে করিয়ে দিয়ে ভাল করেছেন। অবশ্যই এখান থেকে দালাল তাড়ানো হবে। তাছাড়া অনেক জেলা শহরেও ফিঙ্গার প্রিন্টের কাজ করা হয়। প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সামনে দালালদের একই রকম কাজ কর্ম দেখা গেছে। সেখানে কোন রকমের পরিবর্তন ঘটেনি। উপস্থিত বিদেশগামী কর্মীদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, এখানে কোন অভিযান পরিচালনা করা হয়নি। ফলে আগে যা ছিল এখনও তাই রয়েছে। দেলোয়ার হোসেন নামের এক বিদেশগামী কর্মী জনকণ্ঠলেন, বিনামূল্যের ফরম ১০ থেকে ১০০ টাকা, ফরম পূরণ করা ৫০ থেকে ১০০ টাকা, ব্যাংকের ২০০ টাকার ফি ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা আর ফরম জমা দেয়ার সিরিয়ালও পাওয়া যায় ১০০ থেকে ৩০০ টাকায়।
×