ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

তুহিন আহমদ পায়েল

অপার সৌন্দর্যের লীলাভূমি মালয়েশিয়া

প্রকাশিত: ১২:৪০, ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২০

অপার সৌন্দর্যের লীলাভূমি মালয়েশিয়া

(পূর্ব প্রকাশের পর) লিটল ইন্ডিয়া : সুলতান আব্দুল সামাদ বিল্ডিং মাত্র থেকে কয়েক মিনিটের দূরত্বে অবস্থিত। পুরো চত্বর সুদৃশ্য নকশাখচিত ল্যাম্পপোস্ট এবং ঝর্ণায় শোভিত। পর্যটকদের জন্য এ স্থানটি বিশেষভাবে আকর্ষণীয়। কারণ, এখানে নানা ধরনের উপহার সামগ্রী এবং ভারতীয় খাবারের বৈচিত্র্য উপভোগ করা সম্ভব। কুয়ালালামপুর সিটি হল এবং ডিবিকেএল বিনামূল্যে এখানে হেঁটে ভ্রমণের আয়োজন করে থাকে। শুধু স্থাপনা নয়, কুয়ালালামপুরের বিশালকার মার্কেটগুলোও পর্যটকদের ঘুম কেড়ে নেয়ার মতো। ন্যাশনাল মনুমেন্ট : অনেক সুন্দর গোছাল এ জায়গটি। মালয়েশিয়ার সবচেয়ে বিখ্যাত ভাস্কর্য হলো এই ন্যাশনাল মনুমেন্ট। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে শহীদ বীরদের স্মরণে এ ভাস্কর্যটি করা হয়। প্রতীকীভাবে সাতজন বীরের প্রতিমূর্তির মাধ্যমে বিশ্বস্ততা, আত্মত্যাগ আর বন্ধুত্বের বিষয়টি এ ভাস্কর্যের মাধ্যমে বোঝানো হয়েছে। মালয়েশিয়ার ভাস্কর্য শিল্প সনাতন ও আধুনিক ধারার এক স্বতন্ত্র মেলবন্ধন। জাতীয় মনুমেন্টের কাছাকাছি রয়েছে সিনোটাফ। জাতীয় স্মৃতিসৌধের পূর্বসূরি একটি অন্তর্বর্তী, এটি মূলত উপনিবেশিক ১০ মিটার সমতল ঘাসের আচ্ছাদিত মাটিতে একটি বৃত্তাকার চৌম্বক অংশ। যারা যুদ্ধে নিহত হয়েছিলেন তাদের সম্মানে, সিনাট্যাফের শিলালিপিতে উৎসর্গীকৃত অঙ্গীকারের প্রতীক হিসেবে সেনোটাফের প্লেটগুলোতে খোদাই করে লেখা রয়েছে। মনুমেন্টের বাইরে রয়েছে বিশাল খোলা জায়গা। বসে সময় কাটানোর জন্য রয়েছে পার্কের মতো জায়গা। সব মিলে এটি পর্যটকের জন্য বিশেষ এক আর্কষণীয় স্থান। সেখান থেকে বের হয়ে দেখি কোথায় ট্যাক্সি নেই! কি আর করা, মেইন রোডে আসার পরও দাঁড়িয়ে আছি ট্যাক্সি নাই। এদিকে সন্ধ্যা হয়ে গেছে। তাই চিন্তা করলাম হেঁটেই চলে যাবো। হেঁটে আসার পথে মালয়েশিয়া ন্যাশনাল প্রেসক্লাবও দেখে নেয়া হলো। সাইনবোর্ডে লেখা না দেখলে বুঝতে পারতাম না যে এটি জাতীয় প্রেসক্লাব। অনেক পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। হাঁটতে হাঁটতে চলে আসি সেন্ট্রাল মার্কেটের সামনে। হাতে ছিল মোবাইল আর তার সহযোগী গুগল ম্যাপ। তাই কোন সমস্যায় পড়তে হয়নি। কেএল টাওয়ার : চতুর্থ দিন প্রথমে শুরু করি কেএল টাওয়ার দিয়ে সেদিনের ঘোরাঘুরি। কুয়ালালামপুরের একটি অন্যতম আকর্ষণ কেএল টাওয়ার। যার পুরো নামÑ মিনারা কুয়ালামপুর। কুয়ালালামপুরের অরণ্য সংরক্ষণজুড়ে চমৎকারভাবে উদীয়মান কেএল টাওয়ার বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু টেলিকম টাওয়ারের মধ্যে অন্যতম বলে মর্যাদা লাভ করেছে। কেএল টাওয়ারকে মালয়েশিয়ার টেলিযোগাযোগ টাওয়ারও বলা হয়। এটিকে মালেশিয়ার জাতীয় প্রতীকও ধরা হয়। আসলে এটি একটি কমিউনিকেশন টাওয়ার। কুয়ালালামপুরের দুটি দর্শনীয় আকাশচুম্বী স্থাপনার মধ্যে এটি একটি। এর মেইন লবি কাঁচের কারুকার্যখচিত গম্বুজের মতো, যার নকশা ইরানের ইস্পাহানের কারিগরের হাতে বানানো। টাওয়ারটি নির্মিত হয়েছে মালয়েশিয়া সরকারের অর্থায়নে। টাওয়ারের ছাদে একটি এন্টেনা আছে, যার উচ্চতা ৪২১ মিটার এবং ছাদ পর্যন্ত উচ্চতা ৩৩৫ মিটার। কেএল টাওয়ারের চূড়ায় আছে খাবার হোটেল ও একটি পর্যবেক্ষণ ডেক। হোটেলের যে কোন আসনে বসেই দেখতে পাওয়া যায় পুরো কুয়ালালামপুর শহর। হোটেলগুলো ঘূর্ণায়মান। উচ্চতার দিক থেকে কেএল টাওয়ার প্রায় পেট্রোনাস টাওয়ারের কাছাকাছি। বিশ্বে কেএল টাওয়ারের অবস্থান ছয় নম্বরে। টাওয়ারের চূড়ায় উঠতে হয় লিফটে করে। এ জন্য গুনতে হয় ৮০ রিঙ্গিত (কম্বো প্যাকেজ নিয়েছিলাম স্ক্যাই ডেক)। সাধারণ টিকেটও রয়েছে, সেজন্য অবশ্য খরচ পড়তে বেশ একটু বেশিই, প্রাপ্তবয়স্ক ৩৩ রিঙ্গিত ও শিশু ২৩ রিঙ্গিত (জনপ্রতি)। বিভিন্ন দেশ থেকে আগত অসংখ্য পর্যটক প্রতিদিন কেএল টাওয়ার দেখতে আসে। নিচ থেকে মাথা উঁচু করে কেএল টাওয়ারের চূড়ায় তাকালে মনে হয় এত উপরে গেলে ভয় লাগবে, কিন্তু না চূড়ায় ওঠার পর বুঝতে পারি কেএল টাওয়ার কেন সবার এত প্রিয়! জাতীয় মসজিদ : মসজিদের ভেতর ঢুকতেই চোখ জ্বলজ্বল করে উঠল! এত সুন্দর মসজিদ! শুধু সুন্দর বললেই হবে না, এর অপূর্ব সুন্দর কারুকাজ যেন মুগ্ধতায় ভরে তুলবে যে কারও মন। কুয়ালালামপুর জাতীয় মসজিদ মালয়েশিয়ার স্বাধীনতা অর্জনের পরপরই এ মসজিদ নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়। মসজিদের মূল কক্ষে প্রবেশ পথের সামনে মালয়, ইংরেজী ও আরবী ভাষায় রচিত পুস্তক রাখা আছে তাকে। ইংরেজীতে লেখা ধর্মীয় বাণী সংবলিত বিভিন্ন লিফলেটও রাখা আছে বিনামূল্যে বিতরণের জন্য। এখন এটা কুয়ালালামপুরের গর্ব। ১৩ একর জায়গাজুড়ে বিস্তৃত এ মসজিদ কমপ্লেক্সে একসঙ্গে ১৫ হাজার মুসল্লি নামাজ আদায় করতে পারেন। মূল প্রার্থনা ঘরের ছাদটিকে দেখে মনে হয় যেন মেলে থাকা এক অতিকায় ছাতা। সেই ছাদ থেকে ঝুলে থাকা ঝাড় বাতির বর্ণিল আলোর প্রতিফলন পড়ে মেঝের গালিচায়। চারপাশের দেওয়ালগুলো কার্যত কাঁচের। মূল প্রার্থনা ঘরকে ঘিরে থাকা বারান্দাগুলোতেও নামাজ আদায়ের ব্যবস্থা রয়েছে। মসজিদ ঘিরে থাকা উন্মুক্ত চত্বরে নানা আয়তনের পানির ফোয়ারা। নয়নাভিরাম বাগানও আছে মসজিদ কমপ্লেক্সে। মসজিদের গম্বুজে তারার নকশা কাটা। আধুনিক মসৃণ নগরে এক টুকরো ইতিহাস। এ মসজিদের সীমানা ঘেঁষেই ইসলামিক আর্ট মিউজিয়াম ও ইসলামিক আর্ট সেন্টার। কিন্তু আমার হাতে সময় কম, তাই আমি ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও সেখানে যেতে পারিনি। সবাই এই মসজিদ পরিদর্শন করতে পারেন। বাতু ক্যাভস : বাতু ক্যাভস মূলত হিন্দুদের ধর্মীয় স্থান। পাহাড়ের সামনে দাঁড়িয়ে আছে বিশাল আকৃতির, প্রায় পাহাড়সম, সোনালি রঙের এক মূর্তি। পাশ দিয়ে উঠে গেছে সিঁড়ি পথ। শত শত সিঁড়ি পেরিয়ে শেষ মাথায় গুহামুখ। বাতু ক্যাভসের এ ছবিটাই সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ে। বাতু ক্যাভসের সীমানায় ঢোকার দেখা যায় অধিকাংশই বিশাল আকৃতির পাহাড়! তাও মাটির পাহাড় নয়, পাথরের পাহাড়। বাইরে থেকে পাহাড়টা যত বিশাল বলে মনে হয়, ভেতরে গুহাটা কিন্তু ততটা বড় নয়। পুরো এলাকাটিতে তামিলদের আধিপত্য। মূল গুহামুখে ওঠার জন্য আমাকে ২৭২টি সিঁড়ি পার হতে হয়। গুহার মধ্যে যেতে ভেতরে আবার সিঁড়ি ভেঙে নিচের দিকে নামতে হয়। চারদিকে দেব-দেবীর ছোট ছোট অসংখ্য মূর্তি রহস্যময়ভাবে বসিয়ে রাখা হয়েছে। গুহার ভেতর থেকে ওপর দিকে তাকালে ছোট ফোঁকর দিয়ে আকাশ দেখা যায়। সিঁড়ি দিয়ে ওঠার পথে বানরের দল! সিঁড়ি দিয়ে ওঠা-নামার সময় মানুষের ওপর দিয়েই ঝাঁপাঝাঁপি করে। সোনালি রঙের ১৪০ ফুট উঁচু মুরুগান মূর্তিটি চুনাপাথর দিয়ে তৈরি করা হয়। শোনা যায়, মূর্তিটিকে সোনালি রং করতে স্বর্ণ থেকে তৈরি তিনশ’ লিটার স্বর্ণালি রং থাইল্যান্ড থেকে আনা হয়েছিল। মালয়েশিয়ান মুসলমান মেয়েরা প্রায় সবাই মাথায় স্কার্ফ পরা। আর চাইনিজ, জাপানিজ, থাই, ফিলিপিন্সের মেয়েদের প্রায় সবাইকে শর্টস, মাক্রো-মিনিতে দেখা যায়। কিন্তু বাতু ক্যাভসে ঢুকতে হলে উপযুক্ত কাপড় পড়ে ঢুকতে হয়। কারণ সেখানে সাইন বোর্ডে লেখা আছে, এটি একটি ধর্মীয় উপাসনালয়। পুত্রজায়া : আমার ফ্লাইট ছিল রাতে। আগে থেকেই প্লান করে রেখেছি, যাবার আগে পুত্রজায়া দেখে যাবো। কারণ বিমানবন্দর যাবার পথেই পুত্রজায়া পড়ে। তাই সময়, খরচ সব মিলিয়ে ভাল হয়। সকাল ঘুম থেকে উঠে হোটেল চেক আউট দিয়ে লাগেজ নিয়ে বের হয়ে যাই। গাড়ি ভাড়া করি। সারাদিন পুত্রজায়া ঘুরাবে এবং বিকেলে আমাকে বিমানবন্দর পৌঁছে দেবে। কুয়ালালামপুর শহর থেকে প্রায় ৪৫ কিলোমিটার দূরের পথ। যানজটমুক্ত, সুপরিকল্পিত ও সাজানো-গোছানো শহর। পৃথিবীর অন্যতম প্রধান আধুনিক ও শৈল্পিক-স্থাপত্যশিল্পের পরিপাটি নগরী। শহরটি তথ্যপ্রযুক্তির প্রাণকেন্দ্র হিসেবে খ্যাত। পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে গড়ে তোলা হয়েছে এ শহরটি। প্রধানমন্ত্রীর সরকারী বাসভবনের সঙ্গেই লেকবেষ্টিত দৃষ্টিনন্দিত পুত্রা মসজিদ দৃষ্টি কাড়ে পর্যটকদের সবকিছু শেষ করে বিমানে উঠলাম। ঢাকার আকাশে বিমান যখন নিচের দিকে তাকিয়ে রাতের ঢাকা দেখার চেষ্টা করি। লাইটের আলো বিন্দু বিন্দু মালার মতো লাগছিল। পরিশেষে বিমান ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করল। বিমান যখন রানওয়েতে অনেক স্পিড কমে আসছে অনেক বাংলাদেশি সিট বেল্ট খুলে ব্যাগ নিয়ে দাঁড়িয়ে গেছে। বিমানবালারা সবাইকে বসার জন্য বলে। কিন্তু বাঙালী তো, কে কার আগে যাবে সেটা নিয়ে ব্যস্ত! আমার মনে হলো এ বিষয়ে আমাদের নৈতিক শিক্ষার অভাব। বিদেশে যাবার আগে এসব বিষয় নিয়ে একটি প্রশিক্ষণ দেয়া উচিত বাংলাদেশী শ্রমিকদের। সর্বশেষ বিমান থেকে নেমে বাসে করে সোজা চলে যাই বাংলাদেশ ইমিগ্রেশন কাউন্টারে। ইমিগ্রেশন শেষ করে বেল্ট থেকে ব্যাগেজ নিয়ে বের হই। ফোন করতেই গাড়ি চলে আসে টার্মিনাল-২-এ। ভালই ছিল ভ্রমণ। সময় সুযোগ করে আবার নতুন কোন এক দেশে পাড়ি জমাব সহসাই! (সমাপ্ত)
×