ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

আবিদ রহমান

রোমাঞ্চকর স্বপ্নপুরী দারুচিনি দ্বীপ

প্রকাশিত: ১২:৩৯, ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২০

রোমাঞ্চকর স্বপ্নপুরী দারুচিনি দ্বীপ

গত বছরেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম এ বছর যে করেই হোক দারুচিনি দ্বীপে (সেন্ট মার্টিন) বেড়াতে যাব। যদিও আজ থেকে সাত বছর আগে বন্ধুদের সঙ্গে সেন্ট মার্টিনে বেড়িয়ে এসেছি। যাহোক, অফিস থেকে ছুটি নিয়ে ২৬ জানুয়ারি সৌদিয়া পরিবহনের সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার বাসে সস্ত্রীক টেকনাফের উদ্দেশে আমাদের রওনা দেয়ার কথা। যাত্রার স্থান- সায়েদাবাদ। হাতে পর্যাপ্ত সময় নিয়ে রওনাও হই। কিন্তু সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় বেরসিক যানজট। যানজটের মাত্রা এতটাই প্রকট হয় যে সন্ধ্যা ৭টায় আমরা মাত্র পুরানা পল্টনে। রিকশা বা গাড়ি এক চুলও নড়ছে না। এ অবস্থায় হেঁটে যাওয়ারও উপক্রম নেই। উপায়ন্তর না দেখে টিকেটের পেছনে লেখা ফোন নম্বর দেখে কাউন্টারে ফোন দিয়ে তাদের আমাদের অবস্থানের কথা জানাই আর কিছুক্ষণ আমাদের জন্য অপেক্ষা করতে বলি। তারা জানায় সর্বোচ্চ ১০ মিনিট অপেক্ষা করবে আমাদের জন্য। সন্ধ্যা ৭টা ২৫ মিনিটে আমরা মাত্র মতিঝিল শাপলা চত্বরে। কি করব বুঝে উঠতে পারছিলাম না। সর্বশেষ বাস থেকে নেমে একটা রিক্সা নিলাম। রিক্সাচালককে বললাম, যত দ্রুত পারেন সায়েদাবাদ চলেন। ভাড়া যা চাইবেন তাই পাবেন। রিক্সাচালক রাজপথে মোটামুটি একটা ঝড় তুলল। মাত্র দশ মিনিটেই সে সৌদিয়া পরিবহনের কাউন্টারে পৌঁছাল। কাউন্টার ম্যানেজার পারলে আমাদের ওপর তেড়ে আসে এমন অবস্থা। বুঝলাম আসলেই দেরি হয়ে গেছে, কারণ কাউন্টারের সামনে বাসটি শুধু আমাদের জন্যই অপেক্ষা করছে। বাাসে উঠতেই বুঝতে পারলাম শুধু ড্রাইভার নয়, যাত্রীরাও আমাদের ওপর বিরক্ত। আমরা চুপচাপ আমাদের নির্ধারিত স্থানে বসে পড়লাম। আমাদের কারণে বাস ছাড়ল নির্ধারিত সময়ের ১৫ মিনিট পর অর্থাৎ ৭টা ৪৫ মিনিটে। রাত ১০টায় আমাদের বাস কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে মিনিট বিশেকের ডিনার ব্রেক দেয়। তারপর আবার যাত্রা শুরু। সকাল সাড়ে পাঁচটার দিকে আমরা টেকনাফে নামি। টেকনাফের সঙ্গেই দমদমিয়া জাহাজঘাট। চারদিকে অন্ধকার হলেও পথের ধারের হোটেলগুলোতে আলো জ্বলছিল। আমরা হোটেলে আমাদের লাগেজপত্র রেখে ভোরের আলোর অপেক্ষায় থাকি। রাস্তার পাশেই সেন্ট মার্টিনগামী লঞ্চগুলোর কাউন্টার। কাউন্টার খুলল সকাল সাতটায়। লঞ্চের টিকেট মোটামুটি দুই ধরনের। ডেকের ভাড়া ৬৫০ টাকা আর দোতলায় ৭৫০ টাকা। বলা বাহুল্য, টিকেটগুলো রাউন্ড ট্রিপের। অর্থাৎ যে লঞ্চগুলো সেন্ট মার্টিন পৌঁছবে সেগুলো আবার আজই দুপুর ৩টায় সেন্ট মার্টিন থেকে টেকনাফে ফিরে আসবে। তাই যেকেউ চাইলে যতদিন খুশি সেন্ট মার্টিন থেকে একই লঞ্চে করে ফিরতে পারবেন। আমরা টিকেট কিনে নাস্তা সেরে ঘাটে পৌঁছাই সকাল ৯টায়। কারণ সকাল সাড়ে নয়টায় সব লঞ্চ একযোগে সেন্ট মার্টিনের উদ্দেশে ছেড়ে যাবে। হলোও তাই। আমরা নাফ নদীর বুক চিরে এগিয়ে চললাম। আমাদের বাম পাশে মিয়ানমার আর ডানে বাংলাদেশ। টেকনাফের সুুউচ্চ পাহাড়গুলোর সৌন্দর্য বর্ণনাতীত। যেদিকে চোখ যায় সবুজ আর সবুজ। কোন কোলাহল নেই, নেই কোন শহুরে আবহ। নিজেকে মুক্ত পাখি মনে হচ্ছিল এই পরিবেশে। আগেরবার যখন এসেছিলাম তখন নাফ নদী থেকেই গাঙচিল আমাদের পিছু নিয়েছিল। এবার তেমনটা দেখতে পেলাম না। তবে আমাদের লঞ্চ যখন নদী থেকে সমুদ্রে নামলো তখন হঠাৎ কোথা থেকে যেন গাঙচিলগুলো আমাদের লঞ্চ অনুসরণ করা শুরু করলো। লঞ্চের যাত্রীদের অনেকেই ১০ টাকার চিপস্ ২০ টাকায় কিনে গাঙচিলের দিকে ছুড়ে মারছে আর তারাও উড়ন্ত অবস্থাতেই নিপুণ ঠোটে চিপস্গুলোকে গলাধকরণ করছে। দেখার মতো দৃশ্য। যারা সরাসরি দেখেনি তারা এই দৃশ্যের মজাটা বুঝতে পারবে না। গাঙচিলগুলো লঞ্চগুলোকে প্রায় সেন্ট মার্টিন পর্যন্ত অনুসরণ করেছিল। যাহোক প্রায় ঘণ্টা তিনেক পর আমরা প্রবাল দ্বীপ সেন্ট মার্টিনের দেখা পাই। ঘড়ির কাটা তখন ১২টা ২০ মিনিট। আমরা ঘাটে নেমেই হোটেলের খোঁজে বের হই। ঘাটের দু’ধারে নানা ধরনের দোকান আর খাবার হোটেল। সেন্ট মার্টিনে কোন রিকশা নেই। যা আছে তা হলো ভ্যান। একসঙ্গে ৪ জন চড়তে পারে এগুলোতে। যারা বুকিং দিয়ে সেন্ট মার্টিন এসেছেন তারা মালপত্রসহ ভ্যানে চড়ে নির্দিষ্ট হোটেলে চলে যাচ্ছেন। যেহেতু আমরা কোন হোটেল বুকিং দেইনি, সুতরাং হন্টনই শ্রেয়। ঘাট থেকে দু’তিন মিনিট হাঁটলেই হোটেলের দেখা পাই। অনেক হোটেল। বিভিন্ন মান ও বাজেটের হোটেল। হোটেল ছাড়াও এখানে রয়েছে কটেজ। কয়েকটি হোটেলে আমরা রুম খুঁজে যা বুঝলাম তা হলো কাপল রুম ২,০০০-২,৫০০ টাকার নিচে পাওয়া যাবে না, কারণ এখন পিক সিজন। তাই আমরা কটেজমুখী হলাম। একটা কটেজ আমাদের পছন্দ হলো- তাই নিয়ে নিলাম। সর্বক্ষণিক বিদ্যুত-পানি ও পর্যাপ্ত নিরাপত্তা সুবিধা আছে। ডাবল বেড রয়েছে দুটি। ভাড়া ১ হাজার ২০০ টাকা। বিচ থেকে মাত্র মিনিট পাঁচেকের হাঁটা পথ। আমরা দ্রুত ফ্রেস হয়ে দুপুরের খাবারের জন্য বের হই। ঘড়িতে তখন দুপুর ২টা বাজে। ক্ষুধায় পেট চো-চো করছে। সেন্ট মার্টিনের হোটেলগুলোতে দুইভাবে খাবার অর্ডার করা যায়। প্রতি আইটেমের আলাদা আলাদা দাম দিয়ে খাওয়া যায় আর এক পদ্ধতি হলো প্যাকেজ সিন্টেমে। আমরা এই দ্বীপে দুই পদ্ধতিতেই খেয়ে দেখেছি। প্যাকেজ সিস্টেমটাই আমার কাছে তুলনামূলকভাবে ভাল লেগেছে। খাবার খেয়ে আমরা বিচে যাই। রোদের প্রখরতা কম থাকায় আবহাওয়া ছিল চমৎকার। সেন্ট মার্টিনে সমুদ্রের পানির সঙ্গে কক্সবাজার বা কুয়াকাটার সমুদ্রের পানির অনেক পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। কক্সবাজারের পানি হালকা ঘোলা আর নোনতা, কুয়াকাটার পানি অনেকটাই ঘোলা কিন্তু লবণাক্ত নয় মোটেও। আর সেন্ট মার্টিনের পানির রং সম্পূর্ণ নীলাভ। মনে হয় কোন সুবিশাল জাহাজ নীল নিয়ে কোন দেশে এই দ্বীপের পাশ দিয়ে যাচ্ছিল আর দুর্ভাগ্যবশত জাহাজটি এখানে তলিয়ে যায়। নইলে এত নীল হবে কেন পানি? সৌন্দর্যের একটা সীমা আছে, সেন্ট মার্টিন সেই সীমাও লঙ্ঘন করেছে। বিচে হাজার হাজার পর্যটক। যে যার মতো এই অপার্থিব সৌন্দর্যের দারুচিনি দ্বীপে আনন্দে মেতে উঠেছে। দেখলে প্রাণটা জুড়িয়ে যায়। কেউ ঘুড়ি উড়াচ্ছে, কেউ ড্রোন উড়াচ্ছে, অনেকে সৈকতে ফুটবল খেলায় মেতেছে আবার কেউ সাইক্লিং করছে। সাইকেলে চড়া হয় না অনেকদিন। তাই একটা সাইকেল ভাড়া করলাম ৬০ টাকা ঘণ্টা হিসেবে। যিনি সাইকেল ভাড়া দেন তাকে হুমায়ূন আহমেদের বাড়ি ‘সমুদ্র বিলাস’-এর পথটা জিজ্ঞেস করতেই সে জানাল, সাইকেলে সৈকত ধরে উত্তর দিকে মিনিট তিনেক এগুলেই ‘সমুদ্র বিলাস’-এর দেখা পাওয়া যাবে। আমরা তাই করলাম এবং পেয়েও গেলাম। সমুদ্র বিলাসের সামনে শুঁটকির দোকান আছে। আসলে পুরো দ্বীপেই কম-বেশি শুঁটকির দোকান আছে। যাহোক, সমুদ্র বিলাসে গেলেও ভেতরে ঢুকতে পারলাম না, কারণ দর্শনার্থীদের প্রবেশ সম্ভবত এখন নিষেধ। যাহোক আমরা সাইকেলে ঘণ্টাখানের মধ্যেই পুরো দ্বীপটা ঘুরে ফেললাম। সাইকেল জমা দিয়ে নারকেল জিঞ্জিরার বিখ্যাত ডাব খেয়ে আবারও বিচে। দ্বীপে প্রচুর প্রবাল রয়েছে। উচ্চতা ছোট থেকে শুরু করে প্রায় ৪/৫ ফুট। আর থাকবেই না কেন? এটাইতো বাংলাদেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ। সৈকতে একপাশে দেখলাম প্রায় ৮/১০ জন তাগড়া লোক জাল টেনে মাছ ধরছে। জালটি হয়তো গতকালই সৈকতের অগভীর পানিতে জেলেরা বিছিয়েছিল। কি মাছ উঠবে তা দেখতে সেখানে প্রায় ত্রিশ/চল্লিশ জন পর্যটক জড়ো হয়েছে। আমিও তাদের সাথে যুক্ত হলাম। প্রায় আধঘণ্টা সময় নিয়ে পুরো জালটি টেনে তীরে তোলা হলো। ছুরি, লবস্টার, রূপচাঁদা, লইট্টা, জেলি ফিস, কাঁকড়াসহ বিভিন্ন প্রজাতির ছোট-বড় মাছ জালে ধরা পড়েছে। সময়ের সাথে সূর্য্যি মামাও পশ্চিমে ঢলে পড়ছে। দেখলাম আর অভিভূত হলাম। সূর্যাস্তের পর আমরা হোটেলে এসে ফ্রেস হয়ে কিছুক্ষণ বিশ্্রাম নিয়ে কেনাকাটার জন্য বের হলাম। বিচের কাছের দোকানগুলোতে বার্মিজ বিভিন্ন জিনিসের পসরা। বার্মিজ আচার, জুতা, খেলনা কি নেই সেখানে? আর শুটকির প্রচুর দোকান তো রয়েছেই। আমরা প্রায় রাত ৯টা পর্যন্ত কেনাকাটা করি তারপর একটি হোটেলে গিয়ে ডিনার সেরে রুমে এসে ক্লান্ত শরীরে ঘুমিয়ে পড়ি, কারণ পরদিন সকালে আমরা ছেড়া দ্বীপ যাব। সকাল ৭টায় ঘুম থেকে উঠে ফ্রেস হয়ে আমরা বেরিয়ে পড়ি। প্রথমেই হোটেলে গিয়ে নাস্তা সেরে ঘাটে যাই। গিয়েই দেখলাম প্রথম ট্রলারটি ছেড়া দ্বীপের উদ্দেশে ছেড়ে যাচ্ছে। ভাড়া যাওয়া-আসাসহ জনপ্রতি ২০০ টাকা। লাইফ জ্যাকেট গায়ে চাপিয়ে আমরা ট্রলারে গিয়ে বসলাম। মাত্র ৩৫ মিনিটেই আমরা ছেড়াদ্বীপে পৌঁছলাম। এই ট্রলারগুলি এখানে ১ ঘণ্টা অপেক্ষা করবে তারপর আমাদের আবার সেন্ট মার্টিনে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে। ছেড়া দ্বীপের পানির রং সেন্ট মার্টিন থেকেও বেশি নীল। বলে রাখা ভাল ছেড়া দ্বীপে কোন খাবার হোটেল নেই, থাকার ব্যবস্থা, অনেক দূরের কথা। যাহোক, কেউ যদি ট্রলারে না আসতে চান, তাহলে হেঁটেও আসতে পারেন। সেক্ষেত্রে খুব ভোরে রওনা দিতে হবে এবং জোয়ার আসার আগেই সেন্ট মার্টিন ফিরতে হবে। নইলে কোমর পানি ডিঙিয়ে ফিরতে হবে। তাইতো এই দ্বীপের নাম ছেড়া দ্বীপ। সমগ্র সেন্ট মার্টিনজুড়ে যেমন কেয়া গাছের আধিক্য রয়েছে, ছেড়া দ্বীপও তার ব্যতিক্রম নয়। তবে এবার আমি ছেড়া দ্বীপে এসেছি কেবলমাত্র ‘বাংলাদেশের দক্ষিণতম বিন্দু’ অংশটা দেখতে। কারণ এরপর বাংলাদেশের ভূখ- নেই। ছেড়া দ্বীপ থেকে মাত্র ৫ মিনিটের হাঁটাপথ। সেখানে সম্পূর্ণটা সময় কাটিয়ে আর ছবি তুলে আবার ট্রলারে ফিরলাম। আধাঘণ্টার মধ্যে আবার সেন্ট মার্টিন। আমাদের হোটেল চেক আউটের সময় ছিল সকাল ১১:০০টা। তাই আমরা হোটেলে গিয়ে লাগেজ গুছিয়ে বের হয়ে গেলাম। কিছুক্ষণ এদিক-সেদিক ঘোরাফেরা করে তারপর সুবিধামতো একটা রেস্তোরায় গিয়ে লাঞ্চ সারলাম। তারপর দুপুর ৩টার কিছু আগে চড়ে বসলাম আমাদের লঞ্চে। সঠিক সময়েই আমাদের লঞ্চ সেন্ট মার্টিন দ্বীপ ছেড়ে গেল। আমরা বিদায় জানালাম অপরূপ সৌন্দর্যের লীলাভূমি সেন্ট মার্টিনকে আর মনে মনে বললাম, ‘যেতে নাহি দিব। হায়, তবু যেতে দিতে হয়, তবু চলে যায়।’
×