ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

এখনও সবার হৃদয়ে বসবাস মোনেম মুন্নার

প্রকাশিত: ১১:৫০, ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২০

এখনও সবার হৃদয়ে বসবাস মোনেম মুন্নার

জাহিদুল আলম জয় ॥ বাংলাদেশের ফুটবলের উজ্জ্বল নক্ষত্র মোনেম মুন্না। ‘কিং ব্যাক’ খ্যাত সাবেক এই কিংবদন্তির ১৫তম মৃত্যুবার্ষিকী ছিল বুধবার। সুদর্শন এই ফুটবলারের মৃত্যুবার্ষিকীতে তাকে স্মরণ করেছেন বিভিন্ন সংগঠন, সাবেক ও বর্তমান ফুটবলাররা। বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন (বাফুফে) আগের দুই বছর মুন্নাকে স্মরণ না করলেও এবার ভুলটি করেনি। প্রয়াত সেন্ট্রাল ডিফেন্ডার মুন্নাকে স্মরণ করে বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে দেশের ফুটবলের অভিভাবক সংস্থা। এক বার্তায় বাফুফে সভাপতি কাজী মোঃ সালাউদ্দিন, সাধারণ সম্পাদক আবু নাইম সোহাগসহ নির্বাহী কমিটির সবাই পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়েছেন। মুন্নার মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে তার নিজ জেলার নারায়ণগঞ্জ সোনালি অতীত ক্লাব ও মুন্না স্মৃতি সংসদের পক্ষ থেকে কবরে ফুল দেয়া হয়। নারায়ণগঞ্জ সোনালি অতীত ক্লাবে মিলাদ মাহফিলেরও আয়োজন করা হয়। এছাড়া মুন্নার বাসভবন ও বন্দরে মুন্না স্মৃতি সংসদে মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করা হয়। ২০০৫ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি মাত্র ৩৯ বছর বয়সে কিংবদন্তি মুন্না সবাইকে অশ্রুজলে ভাসিয়ে চলে যান না-ফেরার দেশে। এত অল্পবয়সে তার চিরবিদায়ে ক্রীড়াঙ্গনে নেমে এসেছিল বিষাদের ছায়া। ২০০০ সালের প্রারম্ভে হঠাৎ করেই কিডনি ফেল করলে ডাক্তাররা দ্রুত কিডনি প্রতিস্থাপনের পরামর্শ দেন। ওই বছরের মার্চে ভারতের ব্যাঙ্গালোর থেকে কিডনি প্রতিস্থাপন করা হয় তার শরীরে। মুন্নার বড় বোন শামসুননাহার আইভী তাকে একটি কিডনি দান করেন। এরপর টানা পাঁচ বছর ভাল থাকলেও ২০০৫ সালে মুন্না আবারও গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। অবশেষে চিরকালের জন্য তিনি বিদায় নেন। ফুটবলামোদীদের কাছে মুন্না নামটি এখনও অন্যরকম এক চমকের ব্যাপার। তিনি শুধু বাংলাদেশ নয়, ছিলেন দক্ষিণ এশিয়ারই অন্যতম সেরা ফুটবলার। স্টপার পজিশনে খেলেও যিনি সর্বসাধারণের মাঝে তুমুল জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন। মাঠে শুধু চোখ ধাঁধানো নৈপুণ্য নয়, দক্ষ নেতৃত্ব এবং ফুটবলে দুর্দান্ত পেশাদারিত্ব প্রদর্শন করে রীতিমতো ‘ফুটবল আইকনে’ পরিণত হয়েছিলেন। আর এ কারণেই ‘কিং ব্যাক’ উপাধি তার জন্য ছিল অবধারিত। ঢাকার মাঠের সবচেয়ে দামী ফুটবলারও ছিলেন তিনি। ১৯৮০-৮১ সালে পাইওনিয়ার লীগে নাম লেখানোর মধ্য দিয়ে প্রতিযোগিতামূলক ফুটবলে অভিষেক ঘটেছিল মুন্নার। এরপর খেলেছেন শান্তিনগর, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, ব্রাদার্স ইউনিয়ন ও আবাহনী ক্রীড়া চক্রে। আবাহনীর হয়েই ক্যারিয়ার শেষ করেন। ফুটবল খেলা ছাড়লেও আবাহনীর কর্মকর্তা-ম্যানেজার হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন আমৃত্যু। আবাহনী মাঠেই তার শেষ জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। কলকাতা ফুটবল লীগে ইস্ট বেঙ্গলেও ১৯৯১-৯৩ পর্যন্ত খেলে সমান দারুণভাবে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন মুন্না। এই ক্লাবে মুন্না লিবারেল পজিশনে খেলে দারুণ আলোড়ন তোলেন। জাতীয় দলের হয়ে মুন্না ১৯৮৬- ’৯৭ সাল পর্যন্ত খেলেন। ’৯৫ সালে তারই নেতৃত্বে মিয়ানমারে অনুষ্ঠিত চার জাতি কাপ ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন হয়ে দেশের বাইরে প্রথম কোন ট্রফি জেতে বাংলাদেশ। “ঐব ধিং সরংঃধশবহষু নড়ৎহ রহ ইধহমষধফবংয “ Ñমোনেম মুন্নার প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে কথাটি বলেছিলেন বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলের সাবেক জার্মান কোচ অটো ফিস্টার। ভাললাগার ফুটবল ভালবাসায় রূপ নিয়েছিল নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলার সিরাজুল্লাহ মাঠ থেকে। সেই মাঠ আজও আছে কিন্তু নেই সেই সোনালি দিন আর মুন্না। যে মুন্নার নেতৃত্বে ১৯৯৫ সালে আন্তর্জাতিক ফুটবলে প্রথম সাফল্য ধরা দিয়েছিল। কিন্তু তাকে আজ ক’জনে মনে রেখেছে? এমনকি কালের বিবর্তনে ধানমন্ডি ৮ নম্বরের ব্রিজটির নাম-ফলকও মুছে গেছে। মোনেম মুন্না শুধু বাংলাদেশ নন, তিনি ছিলেন দক্ষিণ এশিয়ার সেরা ফুটবলার। ক্যারিয়ারের মাঝামাঝিতে খেলেছেন কলকাতার ক্লাব ইস্ট বেঙ্গলের হয়ে। এখনও কাটাতারের ওপারের মানুষগুলোর কাছে মুন্নার জনপ্রিয়তা আকাশচুম্বী। বাংলাদেশ ফুটবলের কথা উঠলেই তারা স্মরণ করে মুন্নাকে। সাধারণত ফুটবলে যেটা হয় ডিফেন্ডারদের দিকে খুব একটা আলো পড়ে না। কিন্তু ১৯৬৬ সালের ৯ জুন জন্ম নেয়া মুন্নার বেলায় মুদ্রার উল্টোপিঠ। স্টপার পজিশনে খেলেও সমস্ত আলো নিজের দিকে কেড়ে নিয়েছিলেন। দলের নেতৃত্ব আর দুর্দান্ত পেশাদারিত্ব দেখিয়ে তিনি রীতিমতো ফুটবল আইকনে পরিণত হয়েছিলেন। আশির দশকের শেষ ভাগ আর নব্বই দশকজুড়ে দেশের ফুটবল ছিল মুন্নাময়। ১৯৯১ সালে ঢাকা আবাহনী থেকে মুন্না পারিশ্রমিক পেয়েছিলেন ২০ লাখ টাকা। যেটা ওই সময় কেবল বাংলাদেশের কোন ফুটবলারের রেকর্ড পারিশ্রমিক নয়; উপমহাদেশে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। এখনকার ফুটবলাররা তার রেকর্ড ভাঙ্গলেও সেই ২০ লাখের আবেদন এখনও রয়ে গেছে।
×