ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো...

প্রকাশিত: ১১:১৪, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২০

আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো...

ফিরোজ মান্না ॥ কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ ‘কোন এক মাকে’ কবিতায় লিখেছেন, ‘কুমড়ো ফুলে ফুলে/নুয়ে পড়েছে লতাটা/সজনে ডাঁটায়/আর, আমি ডালের বড়ি/শুকিয়ে রেখেছি/ খোকা, তুই কবে আসবি/কবে ছুটি? চিঠিটা তার পকেটে ছিল/ ছেঁড়া আর রক্তে ভেজা।’ একুশের আবেগ বাংলার মানুষের ঘরে ঘরে পৌঁছে দিতে দেশের বুদ্ধিজীবী, শিল্পী, সাহিত্যিকরা ছিলেন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। ভাষা অন্দোলনের পটভূমি, ঘটনাপঞ্জি ও বাঙালীর চেতনা নিয়ে রচিত হয়েছে দেশাত্মবোধক গান, নাটক, গল্প, কবিতা, উপন্যাস ও চলচ্চিত্র। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী রচিত ও আলতাফ মাহমুদ সুরারোপিত আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো গানটি। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের পর থেকেই বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে ভাষা আন্দোলনের প্রভাব সূচিত হয়ে আসছে। রচনাগুলোর মধ্যে শহীদ বুদ্ধিজীবী মুনীর চৌধুরীর নাটক কবর, কবি শামসুর রাহমানের কবিতা বর্ণমালা, আমার দুঃখিনী বর্ণমালা ও ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯, জহির রায়হানের উপন্যাস একুশে ফেব্রুয়ারি, কথাসাহিত্যিক শওকত ওসমান রচিত আর্তনাদ উল্লেখযোগ্য। এছাড়া ভাষা আন্দোলন উপজীব্য করে নির্মিত হয়েছে জহির রায়হানের সাড়া জাগানো জীবনধর্মী চলচ্চিত্র ‘জীবন থেকে নেয়া’। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের অনেক বাঙালী মনে করেন, বাংলাভাষা আন্দোলন হয়েছিল জাতীয়তাবাদের ওপর ভিত্তি করে। এ আন্দোলনের মাধ্যমে পাকিস্তানের দুই অংশের সংস্কৃতির পার্থক্যগুলো সুস্পষ্টভাবে পরিলক্ষিত হয়েছে। পশ্চিম পাকিস্তানে আন্দোলনটি পাকিস্তানী জাতীয় স্বার্থের বিরুদ্ধে বিভাগীয় উত্থান বলে মনে করা হয়। দ্বিজাতিতত্ত্বের পাকিস্তান রাষ্ট্রে ‘একমাত্র উর্দু’ নীতি প্রত্যাখ্যান করাকে মুসলমানদের পারসিক-আরবী সংস্কৃতি ও পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার মূল মতাদর্শের গুরুতর লঙ্ঘন হিসেবে দেখা হয়। পূর্ব পাকিস্তানের কয়েকজন শক্তিশালী রাজনীতিক মনে করেন, ‘উর্দু’ হলো ভারতীয় ইসলামী সংস্কৃতির অংশ, আর বাংলাকে তারা হিন্দু সংস্কৃতির সংমিশ্রণে তৈরি বাংলা সংস্কৃতি হিসেবে বিবেচনা করতেন। যারা অধিকাংশই ‘একমাত্র উর্দু’ নীতির পক্ষে ছিলেন। তারা মনে করতেন, উর্দু কেবল পাকিস্তান দেশের ভাষা হিসেবেই নয়, বরং গোটা জাতির ভাষা হিসেবে উর্দুকে প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন। এ ধরনের চিন্তা-ভাবনাও উর্দু নীতির বিপক্ষে অবস্থান নেয়ার অন্যতম কারণ হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল। কেননা, পাকিস্তানে তখন আরও কিছু ভাষাগত পার্থক্যের সম্প্রদায় ছিল। বদরুদ্দীন উমর তার ‘পূর্ববাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি-১’ গ্রন্থে উল্লেখ করেন, মোহম্মদ আলী জিন্নাহ, প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান ও মুসলিম লীগের অন্যান্য সদস্যের ভূমিকা পাকিস্তানের রাজনৈতিক অবস্থার সমালোচনা ও পর্যালোচনা প্রসঙ্গে ‘অমৃতবাজার’ পত্রিকা ফেব্রুয়ারিতে যে সুদীর্ঘ সম্পাদকীয় প্রকাশ করেন সেটিও অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য। ওই প্রবন্ধে বলা হয়, পাকিস্তানের বিধান পরিষদে লিয়াকত আলী খানের উক্তিতে বাংলাদেশ ও তার বাইরে অনেকে আঘাত পেতে পারেন। কিন্ত আমরা যে বিরাট কোন আঘাত পাইনি একথা স্বীকার করি। নিজের মনের কথা প্রকাশকালে এত চৎকার অকপটতার পরিচয় দানের জন্য আমরা তাকে ধন্যবাদ জানাই। অমুসলমানরা এখন নিশ্চিতভাবে বুঝে নেবে তাদের আসল অবস্থা কি। ভবিষ্যতে পাকিস্তানে কি অবস্থার সৃষ্টি হবে এ সম্পর্কে মুসলমানরাও চিন্তা শুরু করবে। লিয়াকত আলী খানের বক্তব্যের কোন অপরিচ্ছন্নতা, দ্বিধা অথবা দ্ব্যর্থতা নেই। আমরা ধরে নিচ্ছি এক্ষেত্রে তিনি লীগ নেতৃত্বের সুবিবেচিত নীতিই অনুসরণ করেছেন। পাকিস্তান বিধান পরিষদে কার্যনির্বাহ সংক্রান্ত আইনের খসড়া নিয়ে বিতর্ক চলছিল। সরকারের পক্ষ থেকে প্রস্তাব করা হয়, প্রত্যেক সদস্যকে হয় উর্দু নয় ইংরেজীতে পরিষদকে সম্বোধন করতে হবে। বিরোধী কংগ্রেস দল এই প্রস্তাব সংশোধনের জন্য একটি পাল্টা প্রস্তাবে উর্দু ও ইংরেজীর সঙ্গে বাংলাকেও পরিষদে সরকারী ভাষা হিসেবে গ্রহণ করার অনুরোধ জানানো হয়। প্রস্তাবটি প্রাদেশিকতার ভিত্তিতে করা হয়নি। করা হয়েছিল পাকিস্তানের বিরাট জনসংখ্যার ভাষা বাংলা বলে। এজন্য বাংলাকে যথাযোগ্য স্বীকৃতি দেয়াই কর্তব্য। লিয়াকত আলী খান তার আসন থেকে উঠে দাঁড়িয়ে সংশোধনী প্রস্তাবটির বিরোধিতা করেন। তিনি বলেন, পাকিস্তান একটি মুসলিম রাষ্ট্র, প্রত্যেক মুসলিম রাষ্ট্রের একটি মুসলিম ভাষা থাকা দরকার। বাংলাদেশের মুসলমানরা এই বিস্ময়কর বক্তব্য মনে মনে কিভাবে গ্রহণ করেছেন আমরা জানি না। কিন্তু যাই হোক, সংশোধনী প্রস্তাবটি বাতিল হয়ে যায়। দীর্ঘ এই প্রবন্ধে ভাষা নিয়ে আরও অনেক গুরুত্ব প্রশ্ন তোলা হয়েছে পাকি শাসকগোষ্ঠীর ভূমিকা নিয়ে। বিশেষ করে লিয়াকত আলী খানের বক্তব্য সেদিনই প্রত্যাখ্যান করে বাঙালীরা। লিয়াকত আলী খানের বক্তব্যের অর্থ এই দাঁড়ায়, তারা যদি ইসলামী প্রভুত্ত্ব ও তার আনুষঙ্গিক সবকিছুর সঙ্গে নিজেদেরকে খাপ খাইয়ে নিতে পারে, তাহলে তাদের স্থান হবে রাষ্ট্রের বাইরে। কায়েদ-ই-আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, মুসলিম লীগের সর্বোচ্চ কাউন্সিল ও পাকিস্তান সুবায় জিন্নাহ ভারপ্রাপ্ত প্রতিনিধি এই কি আসল অভিপ্রায়Ñ আমরা একথা জানতে চাই। দেশের অবস্থা আজ কোথায় দাঁড়িয়েছে তা নিয়ে বাংলাদেশের হিন্দু-মুসলমানরা নিশ্চয়ই একইভাবে চিন্তা করছেন।
×