ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বইমেলা এবং প্রজন্মের ভাবনা

প্রকাশিত: ১২:২৩, ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২০

বইমেলা এবং প্রজন্মের ভাবনা

প্রতিটি জাতির আছে কিছু নিজস্বতা কিছু স্বকীয়তা। আর সেই অনন্যতাই একটা জাতিকে অদ্বিতীয় পরিচয় দেয়। বাঙালী জাতির এমনই এক সত্তার নাম একুশে বইমেলা। ভাষা সংগ্রাম থেকে শুরু করে স্বাধীনতা সংগ্রাম বুকে ধারণ করা বাঙালির- বইমেলা যেন একটুকরো সংস্কৃতির প্রতিচ্ছবি। লেখক-পাঠক-প্রকাশক, বইপোকা হোক বা না হোক সবাই যেন একবারের জন্য হলেও ছুটে বইয়ের গন্ধ নিতে এবং প্রাণের স্পন্দন উপলব্ধি করতে। সেই হাজারো মানুষের ভিড়ে তরুণদের সংখ্যাটাই বেশি। বইমেলাকে ঘিরে তরুণ লেখকদের ভাবনা প্রত্যাশা এবং স্বপ্নকে তুলে ধরেছেনÑ সারতাজ আলীম মৌরি মরিয়ম ফেব্রুয়ারি, ভাষার মাস, বইমেলার মাস। অমর একুশে বইমেলা লেখক পাঠকদের সবচেয়ে বড় মিলনমেলা। সারাবছর এই একটি মাসের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করি। এ বছরের বইমেলা শুক্রবার থেকে পুরোদমে জমে উঠেছে। এসেছে অসংখ্য নতুন বই। সবচেয়ে ভাল লাগে যেটা দেখে তা হলো শুধু বই বাড়ছে না, প্রচুর পাঠকও বাড়ছে। আজকাল শুধু বইমেলা ঘুরতে নয়, বই কিনতেই বইমেলায় আসছেন লোকজন। তারা শুধু পুরনো লেখকদের নয় বরং নতুন লেখকদের বইও কিনছেন সমানভাবে। এই ব্যাপারটাও বেশ লক্ষণীয়। এত পাঠকের ভিড়েও এবারের মেলায় হেঁটে চলে স্বস্তি পাওয়া যায় কারণ এবার বেশ ফাঁকা ফাঁকা করে স্টলবিন্যাস করা হয়েছে। স্টল ও প্যাভিলিয়নগুলোর মধ্যে অনেকটা ফাঁকা জায়গা রাখা হয়েছে। আশা করি মেলার দিন যত আগাতে থাকবে বইমেলায় পাঠকের ভিড় ততই বাড়বে। নতুনরা আরও উৎসাহ পাবে বাংলা সাহিত্য ভা-ারকে সমৃদ্ধ করতে। রবিন জামান খান বিগত কয়েক বছর ধরে বাংলা সািহত্যে যে নবজাগরণের সূচনা হয়েছে সাম্প্রতিক সময়ে এসে সেই জাগরণ ভিন্ন এক আঙ্গিক পেয়েছে নবীন লেখকদের হাত ধরে। বর্তমান বাংলা সাহিত্যে নতুন লেখকদের সবচেয়ে বড় অবদান জনরা ভিত্তিক সাহিত্য চর্চা, যেটা বাংলা সাহিত্যকে নতুন এক মাত্রা দিয়েছে সাম্প্রতিক সময়ে। সেই সঙ্গে বই কেনা এবং পড়ার পাশাপাশি অনলাইন প্লাটফর্মগুলো লেখক-পাঠক-সাহিত্য বিশ্লেষক এবং সাহিত্য অনুরাগীদের জন্য নতুন এক ক্ষেত্র হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। সোশাল মিডিয়া থেকে শুরু করে যেসব অনলাইন মাধ্যমের কারণে একসময় মানুষ সাহিত্য বিমুখ হয়ে উঠেছিল সেই অনলাইন পাটফর্মগুলোই আবার মানুষকে বই পড়ার ব্যাপারে আগ্রহী করে তুলছে বই নিয়ে আলোচনাবিষয়ক বিভিন্ন গ্রুপের সাহিত্য চর্চার নানা কর্মসূচীর মাধ্যমে। বরাবরের মতোই এই সব আয়োজনের প্রধান প্রতিভূ হয়ে বাংলা সাহিত্যকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ায় অগ্রগণ্য ভূমিকা রাখছে অমর একুশে গ্রন্থমেলা। (প্রকাশিত উপন্যাস : ২৫ মার্চ, সপ্তরিপু, ব্ল্যাক বুদ্ধা। প্রকাশিতব্য উপন্যাস : শব্দজাল, মগরাজ) জুবায়ের হোসেন মেধাভিত্তিক তরুণ প্রজন্ম গড়তে বইয়ের চেয়ে বড় কোন মাধ্যম নেই। এবারের বইমেলায় গল্প উপন্যাসের পাশাপাশি আত্মউন্নয়নমূলক বইয়ের পাঠক চাহিদা চোখে পড়ার মতো। ‘মোবাইল এ্যাপে ক্যারিয়ার’ আমার লেখা প্রথম বই। প্রযুক্তির সব থেকে সম্ভাবনাময় সেক্টরগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো মোবাইল এ্যাপ। দীর্ঘ ৯ বছরের অভিজ্ঞতার আলোকে বইটি লিখেছি শুধু এই বিষয়ে তরুণদের জানা কতটা জরুরী সেটা ভেবেই। তথ্যপ্রযুক্তি সেক্টরে এ ধরনের গ্রন্থ বইমেলায় খুব বেশি চোখে পড়েনি। তবে যেগুলো রয়েছে সেগুলোর পাঠক চাহিদা বেশ তুঙ্গে। সাহিত্যচর্চার পাশাপাশি তথ্যপ্রযুক্তি নিয়ে আরও অনেক বেশি বই আসা উচিত বলে আমি মনে করি। বই থেকে প্রাপ্ত সম্মানী লেখকরা ঠিকভাবে পান না এমন অভিযোগ রয়েছে অনেক লেখকের। বইমেলায় লেখক-লেখিকার সঙ্গে কথা বলে বিষয়টি সম্পর্কে আরও ভাল ধারণা হয়েছে আমার। অনেক লেখক জানতেই পারেন না যে, তাঁর বই কত কপি বিক্রি হয়েছে। এই ব্যাপারে সরকারের খুব গভীরভাবে দৃষ্টি দিতে হবে। মন্দিপ ঘরাই আজ এমন একটা সময়ে বইমেলা নিয়ে লিখছি, যখন বইয়ের মলাটের ভাঁজ খোলার আবেগের জায়গাটা দখল করে নিয়েছে প্রযুক্তির নানান অনুষঙ্গ। সেটুকু হলেও হয়তো ঠিক ছিল, কিন্তু ডিজিটাল জগত কিংবা সোশ্যাল মিডিয়ার পরিচিতিই অনেককে টেনে এনেছে কাগজ কলমের জগতে। সেসব ক্ষেত্রে যতটা পাঠক বেড়েছে, তার চেয়ে বাড়ছে অনুসারী বা ফলোয়ার। তবে, এই বাস্তবতাকে মেনে নিয়েই মন মেশাতে হবে বইমেলায়, কারণ এই মেল্টিং পটেই মিশে যায় লেখক, পাঠক, তারকা, প্রকাশক এবং ছাপার অক্ষরে বাংলা সংস্কৃতি। ডিজিটাল যুগে এসে শৈশব যখন স্ক্রিনের চারকোণে এসে পথ হারাচ্ছে, সেই শেষ থেকেই শুরু করতে হবে আমাদের। লিখে যেতে হবে পাতার পর পাতা; শৈশব থেকেই বই চেনাতে হবে শিশুদের। আর সেটির বাস্তবিক রূপ দেখতে হলে বইমেলার বিকল্প অন্তত আমার চোখে পড়ে না। আজ যখন বইমেলাতে দেখলাম একটা শিশু বায়না করছে বই কেনার জন্য, সেই মুহূর্তেই মনকে বোঝালাম, এতকিছুর পরেও আমরা ঠিক পথেই আছি। আরিফ খন্দকার বইমেলা মানেই লেখক, প্রকাশক ও পাঠকদের একটা মিলনমেলা। এখানে যেমন লেখকরা তাদের নিশ্বাস নেওয়ার একটা সুযোগ খুঁজে পায় তেমনি প্রকাশকরা ও পাঠকরাও। এই নিশ্বাস শুধু বেঁচে থাকার নিশ্বাসই নয়, এই নিশ্বাস কল্পনাকে বিস্তৃত করারও। তাই লেখকদের যেমন উচিত ভাল মানের বই লেখা ঠিক তেমনই প্রকাশকদেরও দায়িত্ব ভাল মানের বই ছাপানো। যে বইটা দেখে কিনা পাঠক মুহূর্তের মধ্যেই সংগ্রহ করে ফেলবে, পাঠকের নজর কাড়বে বইয়ের সৃজনশীলতায়। এমনই সৃজনশীল বইয়ের লেখক যেমন বাড়ছে, বাড়ছে প্রকাশকও। আর এই লেখক, প্রকাশক বাড়ার উৎস হলো একটাই, বইমেলা। আর পাঠক সেই উৎসের মূল কেন্দ্রবিন্দু। এই কেন্দ্রবিন্দু মানে এই পাঠকের জন্যই একজন লেখক দিনরাত পরিশ্রম করে একটি বই লিখেন। যে বইটি পাঠক পড়ে লেখকের সেই পরিশ্রমটাকে সুন্দর ও পবিত্র করে তুলে। এই জন্যই পাঠকেরও উচিত বইমেলায় আসা, লেখকের প্রতি সম্মান রেখে তার বইটি কিনে পড়া এবং গঠনমূলক আলোচনা করা কিন্তু অগঠনমূলক সমালোচনা নয়। যে সমালোচনায় লেখক বিভ্রান্ত কিংবা বিষণœ হয় এমন সমালোচনা করার চেয়ে যে সমালোচনায় লেখক আরও সমৃদ্ধিশালী হয়ে উঠে এমন সমালোচনাই করা উচিত। আসুন বই পড়ি, বইয়েই ভালবাসি ও শব্দের পৃথিবী গড়ে তুলি। তবেই আমাদের দেশ ও জাতি অজ্ঞানের সমুদ্রে ডুবে না থেকে জ্ঞানের সমুদ্রে ভেসে উঠবে। মালিহা তাবাসসুম তরুণ প্রজন্মের বিরুদ্ধে সাধারণ একটি অভিযোগ-এই প্রজন্মের তরুণরা ভিডিও কেন্দ্রিক জেনারেশন, বই যেন অচ্ছুৎ! বই পড়তেই তাদের যত অনীহা। কিন্তু গত দু’বছরের অভিজ্ঞতায় আমি দেখেছি সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রেক্ষিত। সাহিত্যের শক্তিমত্তার প্রাবল্য যে কতখানি, তা উপলব্ধি করা যায় অমর একুশে বইমেলা এলেই। প্রযুক্তির এই উৎকর্ষের যুগেও মলাটের মাঝে বাঁধা পড়া নিষ্প্রাণ অক্ষরগুলোও যে পাঠকের অন্তরে প্রাণের সঞ্চারণ ঘটায়, একুশে বইমেলাকে কেন্দ্র করে মানুষের উচ্ছ্বাস দেখেই উপলব্ধি করে ফেলা যায়। আমি স্বপ্ন দেখি, একদিন বাংলাদেশ থেকে কোন এক লেখকের হাতে উঠবে নোবেল পুরস্কার। তরুণ প্রজন্মই একদিন প্রমাণ করবে সাহিত্যের শক্তি ধ্রুব, ক্ষয় নেই এই শক্তির। অমর একুশে বইমেলাকে কেন্দ্র করে মাসব্যাপী লেখক-পাঠকের মিলনমেলা আমাকে অসম্ভব আত্মতৃপ্তি দেয়! গোলাম সামদানি ডন একজন করপোরেট ট্রেইনার হিসেবে আমি বুঝি আমাদের জীবনে শেখার গুরুত্ব কত বেশি। এবং এই শিক্ষার অন্যতম আলোকবর্তিকা হচ্ছে বই। বইমেলা সকল জ্ঞানপিপাসুদের মিলন মেলা। গতবারের মতো এবারেও বইমেলার একটি অংশ হতে পেরে আমি নিজেকে ভাগ্যবান মনে করছি। গতানুগতিক ধারার বইয়ের বাইরেও বই মেলায় বিভিন্ন নতুন ধারার বইয়ের প্রকাশ প্রসংশার দাবি রাখে। আত্ম উন্নয়নমূলক বইয়ের প্রচার এবং প্রসারেই সম্ভব তরুণ প্রজন্মের মাঝে নিজের উন্নয়নের বীজ বুনে দেয়া। আমি মনে করি সকল মানুষের অপার সম্ভাবনা আছে, যা বিভিন্ন কারণে বাধাগ্রস্ত হয়। নিজের মানসিক অবস্থা তেমন একটি বিষয়। আমাদের শারীরিক সুস্থতা যেমন প্রয়োজন, মানসিক সুস্থতাও তেমনি প্রয়োজন। এই বিষয়গুলোকে কেন্দ্র করেই বইমেলায় বই প্রকাশের আমার ক্ষুদ্র প্রয়াস। ইকবাল বাহার জাহিদ সব মানুষের জন্য ২৪ ঘণ্টায় একদিন, কেউ সময়কে কাজে লাগিয়ে সফল! কেউ সময় আছে ভেবে ভেবে পিছিয়ে পড়েন। একদিন সময় আর তাকে সময় দেয় না। শিক্ষক সব ছাত্রের জন্য একই লেকচার পড়ান, কেউ ফার্স্ট সেকেন্ড হন, কেউ জিপিএ-৫ পান। আবার এমনও আছে, লাস্ট বেঞ্চে বসা ছাত্রটি একদিন সেইই হয়তো ঐ জিপিএ-৫ পাওয়া ছাত্রকে চাকরি দেয় (এটা ব্যতিক্রম)। আমরা সবাই জানি সত্য বলতে হবে, সৎভাবে চলতে হবে, মানুষকে ঠকানো যাবে না, নারীদের সম্মান করতে হবে, অবৈধ রোজগার করা যাবে না, নিজের যতœ নিতে হবে– কিন্তু কতটা মানি! বৃষ্টি সবার জন্যই পরে তবে ভিজে কেউ কেউ! আর আমাদের চিন্তা চেতনা জ্ঞানের এসব ভাবনা এবং দুয়ার উন্মুক্ত হোক বইয়ের মাধ্যমে। বইমেলা এখন বাঙালী জাতির একটা উৎসব। সারা বছর শুধু বই প্রেমীরাই নয়, পুরো বাংলাদেশ অপেক্ষা করে এই প্রাণের মেলার। এটার কোন বয়স নেই, নেই কোন বার্ধক্য, এটা শুধুই যৌবনের! গত বই মেলায় এসেছিল আমার প্রথম বই ‘নিজের বলার মতো একটা গল্প’ আর এবার ‘বৃষ্টি সবার জন্যই পড়ে তবে ভিজে কেউ কেউ।’
×