ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

শিরোপা নিয়ে কাল ফিরছে যুবারা

আকবরদের হাত ধরে উজ্জ্বল ভবিষ্যতের আশা

প্রকাশিত: ১২:০৪, ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২০

আকবরদের হাত ধরে উজ্জ্বল ভবিষ্যতের আশা

মোঃ মামুন রশীদ ॥ ১৯৯৭ সালে আইসিসি ট্রফি জয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশ ক্রিকেটের নতুন অধ্যায়ের সূত্রপাত হয়েছিল। আকরাম খানের নেতৃত্বে সেই শিরোপা জয় বদলে দেয় বাংলাদেশের ক্রিকেটকে। ওয়ানডে মর্যাদার পর ২০০০ সালে আসে টেস্ট মর্যাদাও। তবে এই দীর্ঘ সময়ে বাংলাদেশ দল আইসিসির আর কোন মহাইভেন্টে শিরোপা জিততে পারেনি। অবশেষে সেই আক্ষেপ ঘুচেছে এবার দক্ষিণ আফ্রিকায় অনুষ্ঠিত অনুর্ধ-১৯ বিশ্বকাপে। চারবারের চ্যাম্পিয়ন ভারত অনুর্ধ-১৯ দলকে প্রথমবার ফাইনালে উঠেই হারিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশ অনুর্ধ-১৯ দল। আকবর আলীর নেতৃত্বে দেশের ক্রিকেটে সবচেয়ে বড় সাফল্য এসেছে। এখন তাই এ যুবাদের হাত ধরেই উজ্জ্বল ভবিষ্যতের আশায় বাংলাদেশের ক্রিকেট। আইসিসির ইভেন্টসহ বড় বড় ক্রিকেট আসরে হয়তো ভবিষ্যতে আসবে জাতীয় দলেরও সাফল্য। আকবরদের এই অবিস্মরণীয় বিশ্ব জয়ের কীর্তি এসেছে দীর্ঘ পরিশ্রমের ফসল হিসেবে। আকরামের হাত ধরে দেশের ক্রিকেট যেভাবে এগিয়েছে, আকবরদের সাফল্যে এবার বড় বড় অর্জনের আশা। এমন সাফল্যের পেছনের কারণ জানিয়েছেন বাংলাদেশ যুবা ক্রিকেট দলের অধিনায়ক আকবর। এবার শিরোপাটি ঘরে আসার পালা। বুধবার সকালেই বাংলাদেশের যুবারা দেশে ফিরবেন। ২৩ বছর আগের ঘটনার সঙ্গে রবিবার দক্ষিণ আফ্রিকার পচেফস্ট্রুমের ঘটনার দারুণ মিল খুঁজে পাওয়া গেল। ১৯৯৭ সালের আইসিসি ট্রফিতে ফাইনালে উঠে প্রথমবার আইসিসি ওয়ানডে বিশ্বকাপে খেলার যোগ্যতা অর্জিত হয়েছিল। আকরামের নেতৃত্বে ফাইনালে কেনিয়ার বিপক্ষে খেলতে নামে বাংলাদেশ শিরোপা লড়াইয়ে। শ্রেষ্ঠত্বের সেই লড়াইয়েও বৃষ্টি নেমেছিল। বৃষ্টি আইনে রান তাড়া করার টার্গেট হয়ে গিয়েছিল কঠিন। সেবার সেমি নিশ্চিতের ম্যাচে হল্যান্ডের সঙ্গে বৃষ্টিভেজা ম্যাচে ২০ রানের কমে ৪ উইকেট হারিয়ে অথৈ জলে হাবডুবু খাচ্ছিল বাংলাদেশ। সেই সঙ্কটে, বিপদে আর প্রয়োজনে শক্ত হাতে হাল ধরেছিলেন তখনকার অধিনায়ক আকরাম। মিনহাজুল আবেদিন নান্নুর সঙ্গে কিছুটা লড়াইয়ের পরবর্তীতে প্রায় একাই সংগ্রাম চালিয়ে ম্যাচজয়ী ফিফটি উপহার দেন আকরাম। হল্যান্ডকে হারিয়ে সেমিতে উঠতেই বিশ্বকাপ খেলা নিশ্চিত হয়। পরে ফাইনালে বৃষ্টি বিঘিœত ম্যাচে দলগতভাবে খেলেই কেনিয়াকে পরাস্ত করে চ্যাম্পিয়ন হয় বাংলাদেশ দল। পূর্বসূরি আকরামের মতো এবার দলের বিপদে ত্রাণকর্তার ভূমিকায় দাঁড়িয়ে একাই লড়ে বাংলাদেশ যুবাদের বিশ্বকাপ জিতিয়েছেন আকবর। একটি ট্রফির জন্য হাহাকার ছিল দীর্ঘদিনের। ১৯৯৭ সালের পর বিশ্ব ক্রিকেটে একটি অবস্থান তৈরি করলেও শিরোপা আসছিল না। সবখানেই যেন বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল ভারতীয় ক্রিকেট দল। জাতীয় দলের মতো অনুর্ধ-১৯ দলও বারবার এই ভারতের কাছেই হেরে যাচ্ছিল গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচগুলোয়। বহুজাতিক টুর্নামেন্টের ট্রফি ধরাছোঁয়ার বাইরেই ছিল। গত বছর ওয়ানডে বিশ্বকাপের আগে মাশরাফি বিন মর্তুজার নেতৃত্বে শুধু ত্রিদেশীয় ওয়ানডে সিরিজের ট্রফি জিতে খরা কিছুটা কেটে যায়। কিন্তু আইসিসির কোন ইভেন্টে শিরোপা আসেনি। জাতীয় দল বা অনুর্ধ-১৯ দল, কেউ পারেনি শিরোপাখরা ঘোচাতে। শুধু বাংলাদেশের মহিলা ক্রিকেটারদের হাত ধরে এসেছে এশিয়া কাপ। বাংলাদেশের যুবারাও বারবার কাছে গিয়ে ট্রফি ধরতে পারেনি। ২০১৮ এশিয়া কাপের সেমিফাইনালে ভারতের কাছে মাত্র ২ রানে হেরে যায় বাংলাদেশের যুবারা। মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে ভারতকে ১৭২ রানে আটকে দিলেও থেমে যায় ১৭০ রানে। গত আগস্টে ইংল্যান্ডের মাটিতে ত্রিদেশীয় সিরিজের ফাইনালেও হার এড়ানো যায়নি। ২৬১ রান করে ভারতের কাছে ৬ উইকেটে হেরেছে। পরের মাসেই এশিয়া কাপের ফাইনালে ভারতকে ১০৬ রানে অলআউট করেও জিততে পারেনি। ১০১ রানে অলআউট হয়ে ৫ রানে পরাজয়ের হতাশা নিয়ে মাঠ ছাড়তে হয় আকবরের দলকে। রবিবার আর হতাশা সঙ্গী হয়নি। ভারতকে হারিয়েই দেশের ক্রিকেটে সর্বোচ্চ সাফল্য এনে দিয়েছে বাংলাদেশের যুবা ক্রিকেটাররা। তবে এই ম্যাচের বৃষ্টি আশীর্বাদ হয়েছে। শেষ ৩ উইকেটে যখন জয়-পরাজয়ের শঙ্কায় যখন দল সে সময় বৃষ্টিতে শেষ ৩০ বলে মাত্র ৭ রানের প্রয়োজন পড়ে বাংলাদেশ যুবাদের। অনেক কষ্ট করে এই পর্যায়ে আসা। অনেক পরিশ্রমের পর একটা দল হিসেবে গড়ে ওঠা। বিশ্বকাপে যাওয়ার আগে ৩০টি যুব ওয়ানডে খেলেছে দলটি একসঙ্গে। এর অধিকাংশ ম্যাচই দেশের বাইরে খেলেও জয় তুলে নিয়েছে বাংলাদেশের যুবারা। আকবর এ বিষয়ে বলেন, ‘এটি অনেকটা স্বপ্ন বাস্তব হওয়ার মতো। আমরা সুযোগের অপেক্ষায় ছিলাম। এটা গত দেড়-দুই বছরে আমাদের কঠোর পরিশ্রমের ফল। আমাদের স্বপ্ন সত্যি হয়েছে। দলের কোচ, সাপোর্টিং স্টাফ এবং নির্বাচকরা আমাদের যে সমর্থন দিয়েছেন মাঠে এবং মাঠের বাইরে, তাদের ধন্যবাদ দেয়ার ভাষা নেই।’ অথচ আকবর দক্ষিণ আফ্রিকায় গিয়েই মনের ভেতরে চরম দুঃখ আর কষ্ট পেয়েছেন। জিম্বাবুইয়ে ও স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে সহজ জয়ের পর দেশ থেকে আসে দুঃসংবাদ। ২২ জানুয়ারি তার একমাত্র বোন খাদিজা খাতুন যমজ সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে না ফেরার দেশে চলে যান। অতি আপন স্বজন হারানোর ব্যথায় মুষড়ে পড়াটা স্বাভাবিকই ছিল আকবরের জন্য। কিন্তু আকবর ভেঙ্গে পড়লেন না। ইস্পাত-দৃঢ় মনোবল দেখিয়েছেন, শোককে শক্তিতে পরিণত করে দারুণ নেতৃত্ব দিয়েছেন দলকে। আর ফাইনালে অপরাজিত ৪৩ রানের ইনিংস খেলে দলকে শিরোপা এনে দিয়েছেন। দেশ ছাড়ার আগেই তিনি বলেছিলেন, ‘শুধু আমি একা না, দলের সব খেলোয়াড় বিশ্বাস করে যে আমরা শিরোপা জিততে পারব। আর সেখানে শিরোপা জেতার জন্যই যাব আমরা। তারপরও আমাদের ফোকাস থাকবে ম্যাচ বাই ম্যাচ ভাল খেলা। সবার আগে কোয়ার্টার ফাইনাল নিশ্চিত করতে চাই। এরপর সামনের দিক নিয়ে চিন্তা করতে চাই। পুরো দলের ভাবনাই এমন।’ শেষ পর্যন্ত সেই কথাকে বাস্তবে রূপ দিয়েছেন আকবর। শিরোপা নিয়েই বুধবার ফিরবেন তারা। খুব বড় ইনিংস না খেললেও ট্রফি এনে দেয়া এই ৪৩ রানের সংখ্যাটি দেশের ক্রিকেট ইতিহাসে পেয়ে গেল অমরত্ব। ইনিংসটি নিয়ে আকবর বলেন, ‘আমি ব্যাটসম্যানদের এটাই বলছিলাম উইকেট না হারিয়ে যেন জুটি গড়তে পারি। জানতাম ভারত সহজে হার মানবে না। তারা চ্যালেঞ্জিং দল। বুঝতে পেরেছিলাম রান তাড়া করা কঠিন হবে। আমি সবকিছু চাপমুক্ত রাখার চেষ্টা করেছি। টুর্নামেন্টের প্রথম দিকে আমি ব্যাট করার সুযোগ খুব একটা পাইনি এবং আজ আমি সেটাকে স্মরণীয় করে রাখতে চেয়েছিলাম।’ ২০১৬ সালের ফাইনালের পর বিশ্বকাপে এটিই ছিল ভারতের প্রথম হার। টানা দ্বিতীয়বার চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পথে ফেবারিট হয়েই মাঠে নেমেছিল তারা। কিন্তু পরাক্রমশালী ভারতকে জয় করেছেন আকবররা, জিতেছেন শিরোপা। এই সাফল্য দিয়ে দেশের ক্রিকেটকে নতুন করেই স্বপ্ন দেখাতে শুরু করল অনুর্ধ-১৯ দল। আকবর সে কথাটাই বললেন ম্যাচ শেষে, ‘আশা করছি এই জয় আমাদের ক্রিকেটকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সহায়ক হবে।’ দেশের ওয়ানডে দলের সফলতম অধিনায়ক মাশরাফি বিন মর্তুজাও বলেছেন, ‘ছেলেদের বলছি, অনেক অনেকদূর যেতে হবে তোমাদের। আশাকরি ভবিষ্যতে তোমরা আরও অনেক বেশি কিছু নিয়ে আসবে। এই মুহূর্তটা উপভোগ কর।’ আকবরদের নিয়ে এখন আরও অনেক অর্জনের আশা জেগে উঠেছে সমর্থকদের মনে। দক্ষিণ আফ্রিকায়ও বিপুল দর্শক তাদের মাঠে থেকেই উৎসাহ জুগিয়েছেন। ফাইনালে পতাকা নিয়ে গ্যালারিতে মিছিল, স্লোগান দেখা গেছে দিনজুড়েই। দক্ষিণ আফ্রিকায় সর্বশেষ সফরে সিনিয়রদের দল হেরেছে সব ম্যাচ। সেখানে এবার যুবারা সমর্থকদের এনে দিলেন উৎসবে মেতে উঠার উপলক্ষ। সে জন্য তাদেরও ধন্যবাদ জানিয়ে পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে আকবর বাংলায় বলেন, ‘এখানে যারা উপস্থিত হয়েছেন তারা আজকে ছিলেন আমাদের দ্বাদশ খেলোয়াড়।’ বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষ এই দ্বাদশ খেলোয়াড়। এখন তাদেরই চোখে স্বপ্ন আকবরদের হাত ধরেই ভবিষ্যতে বড় বড় শিরোপা জয়ের।
×