ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

গ্রন্থমেলা প্রতিদিন

কর্মজীবী পাঠকের আনাগোনায় সরব সন্ধ্যা

প্রকাশিত: ১১:০৬, ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২০

কর্মজীবী পাঠকের আনাগোনায় সরব সন্ধ্যা

মনোয়ার হোসেন ॥ ছুটির দিন বাদে প্রতিদিন দুপুর তিনটায় খুলে যায় গ্রন্থমেলার দুয়ার। এরপর রাত নয়টা অবধি চলে অমর একুশে গ্রন্থমেলা। ছয় ঘণ্টার এই গ্রন্থরাজ্যে মেলার চিত্র থাকে তিন রকম। দুপুর বেলায় পাঠকের আনাগোনা থাকে একেবারেই স্বল্প। মূলত বিকেল থেকে বাড়তে থাকে বইপ্রেমীর সংখ্যা। বিকেল গড়ানো সন্ধ্যায় দৃশ্যটি হয় আরেক রকম। ঝলমলে আলোয় রঙিন রূপ পায় নান্দনিক বিন্যাসের গ্রন্থমেলা। আর সন্ধ্যা থেকে রাতের সময়টিতে ভিড় নামে কর্মজীবী পাঠকের। বইয়ের টানে অফিস ছুটির পর মেলায় আসেন নানা পেশার মানুষ। তাদের পদচারণায় মেলাজুড়ে বিরাজ করে সরবতা। শীতের শেষ মাস মাঘের অন্তিমকালে সোমবার মেলায় ঘুরছিলেন আসিফ রহমান। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের বিভিন্ন প্যাভিলিয়ন ও স্টল ঘুরে সংগ্রহ করছিলেন আপন মননের উপযোগী গ্রন্থ। হাতে ঝুলছিল কয়েকটি বইয়ের ব্যাগ। সেগুলোর মধ্যে ছিল অবসর থেকে আসা হরিশংকর জলদাসের সাতটি গল্পে সজ্জিত বই ‘গল্পের গল্প’ এবং গোলাম মুরশিদের লেখা ‘রবীন্দ্রনাথের নারী-ভাবনা’। জনকণ্ঠের সঙ্গে কথা হয় একটি বেসরকারী এই কর্মকর্তার সঙ্গে। আলাপচারিতায় বলেন, একসময় মেলা চলত রাত আটটা পর্যন্ত। তাই চাইলেও বিকেল পাঁচটায় অফিস শেষ করে বনানী থেকে মেলায় আসা সম্ভব হতো না। যানজট পেরিয়ে মেলায় পৌঁছতে পৌঁছতে ঘড়ির কাঁটা চলে যেত সাতটায়। এত ঝক্কির পর এক ঘণ্টার মধ্যে আর চাইলেও মেলা ঘুরে বই সংগ্রহ করা কঠিন হতো। এখন রাত নয়টা পর্যন্ত মেলা চলায় পর্যাপ্ত সময় পাওয়া যায়। তাই সুযোগ পেলেই আসা হয় বইমেলায়। এদিন সন্ধ্যা ছয়টায় দেখা মেলে আরেক বেসরকারী কর্মজীবী আজমল হোসেনের সঙ্গে। অফিস ছুটির পর মতিঝিল থেকে সরাসরি চলে এসেছেন বইয়ের ভুবনে। পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স থেকে সংগ্রহ করছিলেন ধ্রুব এষ রচিত অতিপ্রাকৃত কাহিনী ‘পরেশের বউ’। আর কী বই জানতে চাইলে বললেন, রবীন্দ্রনাথের অনুরাগী। তাই শোভা প্রকাশ থেকে সংগ্রহ করেছি সন্জীদা খাতুনের লেখা ‘রবীন্দ্রকবিতার গহনে’ শিরোনামের বইটি। এছাড়া কিনেছি আবুল আহসান চৌধুরী রচিত ‘মুক্তজ্ঞানের প্রবাদপুরুষ : কাজী মোতাহার হোসেন’। পুরনো অথচ আগে পড়া হয়নি এমন কিছু বইয়ের তালিকাও নিয়ে এসেছি। রাত নয়টা পর্যন্ত মেলা খোলা থাকায় হাতে পর্যাপ্ত সময় আছে। এখন ঘুরে ঘুরে সেগুলো সংগ্রহ করব। পাশাপাশি মুঠোফোনে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের দুই বন্ধুর সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে। তারাও চলে এসেছে মেলার কাছাকাছি। বই কিনতে কিনতেই আড্ডা হবে জমিয়ে। প্রকাশনা সংস্থা ঐতিহ্যের ব্যবস্থাপক আমজাদ হোসেন কাজল বলেন, দুপুর বা বিকেলের চেয়ে সন্ধ্যাতেই জমে ওঠে বইমেলা। বইয়ের বিকিকিনিটাও বেশি হয়। ‘পুষ্টি সচেতনতা ও সুস্থ জীবন’ বইয়ের মোড়ক উন্মোচন প্রতিটি মানুষই চায় একটি সুস্থ জীবন। সেই সূত্রে খাদ্য, পুষ্টি ও পথ্যÑএই তিন বিষয়ে রয়েছে মানুষের অদম্য কৌতূহল। সেই কৌতূহল এবং প্রয়োজনীয়তা মেটাতে সিদ্দিকা কবীর রিসার্চ ফাউন্ডেশন প্রকাশ করেছে ‘খাদ্যে পুষ্টি সচেতনতা ও সুস্থ জীবন’ শীর্ষক গ্রন্থ। সোমবার গ্রন্থমেলার লেখক বলছি মঞ্চে বইটির মোড়ক উন্মোচিত হয়। মোড়ক উন্মোচন করেন জাতীয় মহিলা সংস্থার চেয়ারম্যান এবং সিদ্দিকা কবীর রিসার্চ ফাউন্ডেশনের উপদেষ্টা অধ্যাপিকা মমতাজ বেগম। বইটিতে দৈনন্দিন নানা স্বাস্থ্য সমস্যা যেমন ডায়াবেটিস, বাত, হৃদরোগ, কিডনি রোগ, থাইরয়েড, ওজনাধিক্য, আইবিএস, রক্তস্বল্পতা ইত্যাদির পাশাপাশি গর্ভবতী মা ও শিশু স্বাস্থ্যবিষয়ক খাদ্য এবং পথ্য সম্পর্কিত নানা পরামর্শ বর্ণিত হয়েছে প্রাঞ্জল ভাষায়। নতুন বইয়ের খবর বাংলা একাডেমির জনসংযোগ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, সোমবার গ্রন্থমেলার নবম দিনে নতুন বই এসেছে ১৭৯টি। উল্লেখযোগ্য বইয়ের মধ্যে রয়েছে বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত দিব্যদ্যূতি সরকারের বঙ্গবন্ধুবিষয়ক বই ‘বঙ্গবন্ধুর কারা জীবন’। ইত্যাদি গ্রন্থাপ্রকাশ থেকে এসেছে হাসান আজিজুল হকের প্রবন্ধগ্রন্থ ‘আমার রবীত্ব যাপন’। অনন্যা থেকে বেরিয়েছে মহাদেব সাহার কাব্যগ্রন্থ ‘চোখ বুজে পাহাড় দেখেছি’। সাহিত্যদেশ প্রকাশনী থেকে এসেছে আলী আজগর আলী ভূঁইয়ার কাব্যগ্রন্থ ‘মা মাটি দেশ’। অবসর থেকে এসেছে আবদুল মান্নান সৈয়দের প্রবন্ধ ‘করতলে মহাদেশ’। অন্যধারা থেকে বেরিয়েছে সেলিনা হোসেনের উপন্যাস ‘কাঁটাতারে প্রজাপতি’। অনন্যা থেকে এসেছে মনি হায়দারের গল্পগ্রন্থ ‘ফ্যান্টাসি’ ও মহাদেব সাহার কাব্যগ্রন্থ ‘চোখ বুজে পাহাড় দেখেছি’। ‘বঙ্গবন্ধুর কারাজীবন’ বইয়ের আলোচনা সোমবার বিকেলে গ্রন্থমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় দিব্যদ্যুতি সরকার রচিত ‘বঙ্গবন্ধুর কারাজীবন’ বইবিষয়ক আলোচনা। প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য রাশিদ আসকারী। আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন এ্যাডভোকেট সাহিদা বেগম ও ড. আশফাক হোসেন। লেখকের বক্তব্য প্রদান করেন দিব্যদ্যুতি সরকার। সভাপতিত্ব করেন আবুল মোমেন। প্রাবন্ধিক বলেন, গণমানুষের মুক্তি-আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে নেতৃত্ব দেয়ার কারণে পৃথিবীতে যে ক’জন হাতেগোনা মানুষ কায়েমি শোষকদের অধীনে দীর্ঘ কারাভোগ করেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাদের মধ্যে অন্যতম। পাথরের দেয়াল এবং লোহার গরাদ অতিক্রম করে তিনি একটি স্বাধীন দেশ স্থাপন করেছেন পৃথিবীর মানচিত্রে। লেখক দিব্যদ্যুতি সরকার বঙ্গবন্ধুর কারাজীবন গ্রন্থে বঙ্গবন্ধুর দীর্ঘ কারাজীবনের মধ্য দিয়ে প্রকাশিত বহুমাত্রিক জ্যোতির্ময় বঙ্গবন্ধুর নানাবিধ সত্তা, যেমন, মানুষ বঙ্গবন্ধু, রাজনীতিবিদ বঙ্গবন্ধু, লেখক বঙ্গবন্ধু ইত্যাদি বিষয় আবিষ্কারের প্রয়াস পেয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর বৈচিত্র্যময় কন্টকাকীর্ণ জীবনের এক দুর্যোগপূর্ণ অধ্যায় তার কারাজীবন, সমকালীন ইতিহাসের আলোয় তার বয়ান এবং অন্তর্বয়ান আলোচ্য গ্রন্থকে মুজিব জন্মশতবর্ষের এই সময়ে খুবই প্রাসঙ্গিক। আলোচকবৃন্দ বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার জীবনের এক তৃতীয়াংশ সময়ই কারাগারে কাটিয়েছেন। আত্মত্যাগী এই মহান নেতার আপোসহীন সংগ্রামের কারণেই বাঙালী আত্মপরিচয়ের সঙ্কটকে কাটিয়ে বিশ্বের বুকে একটি স্বাধীন জাতি হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে। লেখক দিব্যদ্যুতি সরকার তাঁর রচিত বঙ্গবন্ধুর কারাজীবন গ্রন্থে বঙ্গবন্ধুর দীর্ঘ বৈচিত্র্যময় কারাজীবনের অভিজ্ঞতাকে উপস্থাপন করেছেন। গ্রন্থের লেখক বলেন, বঙ্গবন্ধুর দীর্ঘ কারাজীবন নিয়ে বিস্তারিত গবেষণা ও তাত্ত্বিক বিচার-বিশ্লেষণের যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। সংলাপনির্ভর সাধারণ ভাষায় লিখিত এ গ্রন্থের উদ্দেশ্য বঙ্গবন্ধুর কারাজীবন সম্পর্কে নতুন কোন তথ্য উপস্থাপন করা নয় বরং মানুষের কাছে বঙ্গবন্ধুর কারাজীবনের অভিজ্ঞতাকে তুলে ধরা হয়েছে। আবুল মোমেন বলেন, বঙ্গবন্ধুর জীবন ইতিহাস পর্যালোচনা করতে হলে তাঁর জেল জীবনের প্রেক্ষাপট ও অভিজ্ঞতাও আমাদের বিবেচনায় আনতে হবে। বারবার কারাবরণ ও আপোসহীন সংগ্রামের মাধ্যমেই বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনের উত্তরণ ঘটে এবং তিনি গণমানুষের আশা-ভরসার প্রতীকে পরিণত হন। বঙ্গবন্ধুর কারাজীবনের পটভূমিতে রচিত দিব্যদ্যুতি সরকার-এর বঙ্গবন্ধুর কারাজীবন গ্রন্থটিতে জাতির পিতার জীবন ও ভাবনার অনেক গুরুত্বপূর্ণ দিক উঠে এসেছে। আজকের মেলা আজ মঙ্গলবার মেলার দশম দিন। মেলা চলবে বেলা ৩টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত। বিকেল চারটায় গ্রন্থমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হবে মোহাম্মদ আলী খান রচিত ডাকটিকেট ও মুদ্রায় বঙ্গবন্ধু শীর্ষক আলোচনা। প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন আতাউর রহমান।
×