ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

অবস্থা অব্যাহত থাকলে বিপদ বাড়বে

ঝুঁকিতে $ ২ বিলিয়ন ॥ করোনাভাইরাসে বাংলাদেশের বাণিজ্য

প্রকাশিত: ১০:৫৫, ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২০

ঝুঁকিতে $ ২ বিলিয়ন ॥ করোনাভাইরাসে বাংলাদেশের বাণিজ্য

রহিম শেখ ॥ ‘করোনাভাইরাস’। চীনের এই ভাইরাস জ্বরে কাঁপছে গোটা বিশ্বের অর্থনীতি। বাংলাদেশেও এর প্রভাব পড়ছে। ইতোমধ্যে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের আমদানি-রফতানিসহ সব ধরনের বাণিজ্যিক কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। বন্ধ আছে নতুন এলসিও (ঋণপত্র)। এদিকে চীন থেকে কাঁচামাল আর যন্ত্রাংশ আমদানি করতে না পারায় শিল্পকারখানা বন্ধ হওয়ার আশঙ্কা করছেন উদ্যোক্তারা। কেবল শিল্পই নয়, পদ্মা সেতু প্রকল্পসহ পদ্মা রেল সেতু নির্মাণ প্রকল্প, কর্ণফুলী টানেল নির্মাণ, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেললাইন নির্মাণ প্রকল্পসহ দেশের গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণ প্রকল্প, বিদ্যুতকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ থমকে যাচ্ছে। কারণ প্রকল্পগুলোর বিভিন্ন কারিগরি ও ব্যবস্থাপনার কাজ করা চীনা নাগরিকরা তাদের নববর্ষে ছুটিতে গিয়ে আটকে পড়েছেন। বাংলাদেশ-চায়না চেম্বার অব কমার্স এ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের (বিসিসিসিআই) হিসাবে ইতোমধ্যে ঝুঁকিতে পড়েছে ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বাণিজ্য। স্থানীয় মুদ্রায় যা প্রায় ১৭ হাজার কোটি টাকা (প্রতি ডলার ৮৫ টাকা হিসাবে)। চলতি ফেব্রুয়ারি মাস এ অচলাবস্থা অব্যাহত থাকলে এ পরিমাণ ক্ষতি হবে। চীনের সঙ্গে সরাসরি ব্যবসা করছেনÑ এমন কয়েকজন ব্যবসায়ী জানান, বর্তমানে যে অবস্থা চলছে, বাংলাদেশকে তার অনেক বেশি মূল্য দিতে হবে। বিশেষ করে কাঁচামালের অভাবে শীঘ্র অনেক ফ্যাক্টরি বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে। এদিকে সোমবার সচিবালয়ে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, চীনে করোনাভাইরাস সমস্যাটি দীর্ঘমেয়াদী হলে এর প্রভাব দেশের বাজারেও পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। তাই এ পরিস্থিতি মোকাবেলায় নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে বিকল্প বাজারে নজর রেখেছে সরকার। জানা গেছে, নববর্ষ উপলক্ষে ২৪ থেকে ৩০ জানুয়ারি ছুটি ঘোষণা করেছিল চীনের স্টেট কাউন্সিল। করোনাভাইরাসের কারণে প্রথমে ছুটি ২ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বাড়ানো হয়। তা শেষ হওয়ার আগেই আরেক নোটিসে বেশিরভাগ প্রদেশে ছুটি ৯ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বাড়ানো হয়। যেসব প্রদেশে ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ঘটেছে, সেখানে ফেব্রুয়ারির তৃতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত ছুটি বাড়ানো হয়। যেমন উহানে ১০ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত, হুবেই প্রদেশে ১৩ ফেব্রুয়ারি, ঝিঝিয়ান প্রদেশে ১৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ছুটি ঘোষণা করা হয়। চীনা ব্যবসায়ীরা বাংলাদেশী ব্যবসায়ীদের সোমবার পর্যন্ত জানান যে, এ ছুটি আরও বাড়বে। চীনা ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন করোনাভাইরাসের প্রকোপ কমে আসলে মার্চ নাগাদ আমদানি-রফতানি স্বাভাবিক হতে পারে। বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা বলছেন, চীন থেকে পণ্য আমদানিতে ১৪ থেকে ২২ দিন সময় লাগে। ফলে পণ্য জাহাজীকরণ পিছিয়ে গেলে বাংলাদেশে তার প্রভাব পড়তে শুরু করবে এ মাসের শেষে। এরপর পণ্য জাহাজীকরণ যত বেশি বিলম্বিত হবে, বাংলাদেশের শিল্প-বাণিজ্য ও অবকাঠামো খাতসহ সার্বিক অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ততই বাড়বে। ভোগ্যপণ্যের মধ্যে চীন থেকে রসুন, আদা ও বিভিন্ন মসলা আমদানি করা হয়। এখন পেঁয়াজও আমদানি করা হচ্ছে। এসব পণ্য বিকল্প বাজার থেকে আমদানি সম্ভব হলেও শিল্পের কাঁচামাল ও উপকরণ এবং সরকারী-বেসরকারী বিভিন্ন প্রকল্পের যন্ত্র ও যন্ত্রাংশ আমদানি করতে বিকল্প দেশ খুঁজে পাওয়া কঠিন বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। জানা যায়, চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য মূলত আমদানিনির্ভর। বাংলাদেশ চীন থেকে সবচেয়ে বেশি পণ্য আমদানি করে। গত অর্থবছর চীন থেকে বাংলাদেশ আমদানি করেছে ১ হাজার ৩৮৫ কোটি ডলারের পণ্য। ওই সময়ে রফতানি করেছে ৮৩ কোটি ডলারের পণ্য। তবে চীন থেকে বাংলাদেশের আমদানি করা কাঁচামাল দিয়ে উৎপাদিত তৈরি পোশাকসহ বিভিন্ন পণ্য ইউরোপ-আমেরিকাসহ বিশ্বজুড়ে রফতানি হয়। ফলে চীন থেকে আমদানি বন্ধ থাকলে বাংলাদেশের রফতানিও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। চীনের সঙ্গে নিয়মিত ব্যবসা করেন এমন কয়েকজন জনকণ্ঠকে জানিয়েছেন, আশা করেছিলাম, মধ্য ফেব্রুয়ারির মধ্যে আমদানি-রফতানি চালু হবে। তবে চীনা ব্যবসায়ীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে তারা আরও আশাহত হচ্ছেন। চীনা ব্যবসায়ীরা বাংলাদেশী ব্যবসায়ীদের বলছেন, চলতি ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যে আমদানি-রফতানি চালু হওয়ার সম্ভাবনা কম। এ মাসের মাঝামাঝি থেকে করোনার বিস্তার কমবে বলে আশা করছে চীন। আর মার্চের প্রথম সপ্তাহ থেকে চীন আমদানি-রফতানি চালু করবে। বাংলাদেশ-চীন চেম্বার অব কমার্স এ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (বিসিসিসিআই) সভাপতি গাজী গোলাম মর্তুজা জনকণ্ঠকে বলেন, আমরা দুই দেশের বাণিজ্য তথ্য পর্যালোচনা করে দেখেছি যে, ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আমদানি-রফতানি বন্ধ থাকলে বাংলাদেশের ২ বিলিয়ন ডলার ক্ষতি হবে। করোনাভাইরাস দীর্ঘায়িত হলে ক্ষতির পরিমাণও বাড়বে। তিনি বলেন, প্রতিদিনই চীনা ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আমাদের কথা হচ্ছে। তারা আমাদের বলেছেন, এখন যে অবস্থা তাতে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আমদানি-রফতানি সম্ভব হবে না। করোনার প্রভাব কমলে মার্চ থেকে চালু হবে। আর ভাইরাসের আক্রমণ ছড়িয়ে পড়লে চীনের সঙ্গে বাণিজ্য আরও দীর্ঘদিন বন্ধ থাকবে। তখন বাংলাদেশে বড় সঙ্কট দেখা দেবে। মহাসঙ্কটে পোশাক খাত তৈরি পোশাক মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর তথ্য মতে, দেশে গড়ে ওঠা ৪ হাজার ৫৬০টি গার্মেন্টস প্রতিষ্ঠানের যাবতীয় কাঁচামাল এককভাবে চীন থেকে আমদানি হয়ে আসে। বিশে^র ৫ শতাধিক বায়ারের (ক্রেতা) নির্দেশনা অনুযায়ী এসব কাঁচামাল চীন থেকে আমদানি করে থাকে গার্মেন্টস শিল্পের মালিকরা। করোনাভাইরাসের কারণে চীন থেকে এসব পণ্য আসা ইতোমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে। ২০ দিন ধরে চীন থেকে গার্মেন্টসসহ বাণিজ্যিক পণ্যবাহী কোন জাহাজ বাংলাদেশে আসেনি। ইতোপূর্বে এলসির মাধ্যমে গার্মেন্টসের চীন থেকে যেসব কাঁচামাল এসে গেছে সেসব দিয়ে চলতি ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত চলার সম্ভাবনা রয়েছে। এর পরের মাস অর্থাৎ মার্চ মাস থেকে কি অবস্থা হয় তা নিয়ে শঙ্কিত গার্মেন্টস সেক্টর। এলসি হয়েছে, কিন্তু চীন থেকে সব ধরনের পণ্যের শিপমেন্ট বন্ধ হয়ে গেছে করোনাভাইরাসের কারণে। জানতে চাইলে গিভেন্সি গ্রুপের কর্ণধার ও বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী পারভেজ জনকণ্ঠকে বলেন, বাংলাদেশের ওভেনের ৬৫ ভাগ ফেব্রিক চীন থেকে আমদানি করা হয়। অর্থাৎ আমাদের ওভেন পোশাক রফতানির ৬৫ ভাগ চীনের ওপর নির্ভরশীল। গত অর্থবছর বাংলাদেশ ওভেন রফতানি করেছে ১ হাজার ২৪৪ কোটি ডলারের। অর্থাৎ প্রতি মাসে রফতানি হয় ১০৩ কোটি ডলার। এর ৬৫ ভাগ হলো ৬৭ কোটি ডলার। অর্থাৎ এক মাসে চীন থেকে ফেব্রিক আমদানি না করতে পেরে রফতানি করতে না পারলে এই পরিমাণ ক্ষতি হবে, টাকার অঙ্কে যা প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকা। তিনি বলেন, আমার সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান থেকে জানিয়েছে যে, চীনে চলমান নববর্ষের ছুটি আরও সপ্তাহখানেক বাড়বে। তাতে নববর্ষের পর যেসব ফেব্রিক আমাকে পাঠানো কথা ছিল, সেগুলো সময়মতো পাব না। এতে আমাদের বড় ক্ষতি হবে। ক্ল্যাসিক গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোঃ শহিদউল্লাহ আজিম জানান, চীনে আমাদের প্রতিষ্ঠানের কাপড়ের সাত-আটটি কনসাইনমেন্ট আছে। এগুলোর মধ্যে কিছু উৎপাদন স্তরে এবং কিছু জাহাজীকরণের পর্যায়ে রয়েছে। আমরা খুবই শঙ্কার মধ্যে আছি। কারণ সময়মতো কাপড় না এলে কারখানায় উৎপাদন হবে না। পণ্য জাহাজীকরণে বিলম্ব হবে। তখন ক্রেতাকে মূল্যছাড় দিতে হবে। তৈরি পোশাক খাত মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, এই ভাইরাসের কারণে চীনে হলিডে (ছুটির দিন) বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশের ওভেন পোশাকের সিংহভাগ ফেব্রিকই আমদানি করা হয় চীন থেকে। দেশটিতে অর্ডার করা পণ্যগুলো কখন এসে পৌঁছবে তা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। ফলে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতে বড় ধরনের একটা ধাক্কা পড়বেই। তিনি বলেন, শুধু আমদানি নয়, চীনে রফতানির ক্ষেত্রেও কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হবে বাংলাদেশ। চীনের ব্র্যান্ডগুলো এ দেশ থেকে পণ্য নিয়ে থাকে। সেক্ষেত্রে তারা যেহেতু আসতে পারছে না তাই পণ্যও আমদানি করছে না। আবার অর্ডার করা পণ্য নিচ্ছেও না। তিনি বলেন, এখন থেকেই কাঁচামাল আমদানি ও প্রস্তুত পণ্য রফতানির বিকল্প বাজার তৈরির কথা ভাবতে হবে। পোশাক খাতের মতো বিপাকে রয়েছেন চামড়া খাতের ব্যবসায়ীরাও। সাভারের হেমায়েতপুরে চামড়াশিল্প নগরে কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধনাগার (সিইটিপি) চালু না হওয়ায় ইউরোপের ক্রেতারা সরাসরি বাংলাদেশ থেকে চামড়া কেনে না। বর্তমানে দেশের ৭০ শতাংশ চামড়ার ক্রেতাই হচ্ছে চীনারা। গত বছর ১৬ কোটি ডলারের চামড়া রফতানি হয়েছিল। এক মাস চীনে রফতানি করতে না পারলে তাদের রফতানি কমবে ১১৫ কোটি টাকার। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম জনকণ্ঠকে বলেন, বৈদেশিক বাণিজ্যে কিছুটা নেতিবাচক প্রভাব পড়তেও শুরু করেছে। কারণ বাংলাদেশের অনেক শিল্পের কাঁচামাল ও ব্যবসা-বাণিজ্যের উপকরণ চীন থেকে আসে। এখন এসব বন্ধ রয়েছে। ফলে প্রভাব তো পড়বেই। অন্যদিকে প্রকল্প বাস্তবায়নে ক্ষেত্রে অনেক সমস্যা হবে। কারণ যারা গেছে তারা যদি না আসে, তাহলে বিকল্প খুঁজতে সময় লাগবে। তখন প্রকল্প বাস্তবায়ন পিছিয়ে যেতে পারে। পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, বাণিজ্যের জন্য বিকল্প ভাবতে হবে। আর প্রকল্প বাস্তবায়নের গতি যেন না থামে সেদিকে মনোযোগী হতে হবে। মেগা প্রকল্পগুলোর অগ্রগতিতে বাধার মুখে পড়ার আশঙ্কা বাংলাদেশে চীনা অর্থায়ন ও কারিগরি সহায়তায় মেগা প্রকল্পগুলোর অগ্রগতিতে বাধার মুখে পড়ার আশঙ্কা আছে। কাক্সিক্ষত সময়ে কাজ না এগোলে বাড়তে পারে প্রকল্প ব্যয়ও। বাংলাদেশে কর্মরত অনেক চীনা সে দেশে আটকা পড়েছেন। আর সময়মতো কাজ না এগোলে প্রকল্প ব্যয় বাড়বে বা বাড়ানোর অজুহাত তোলা হতে পারে। কর্ণফুলী টানেলসহ কয়েকটি প্রকল্পে কর্মরত চীনের শতাধিক কর্মকর্তা তাদের ছুটি আরও বাড়িয়েছেন। শুধু পদ্মা সেতুতেই চীনের ১১০০ নাগরিক কাজ করছেন। তাদের মধ্যে ছুটিতে দেশে গিয়েছিলেন ২৫০ জন। এছাড়া পদ্মা সেতুতে রেল সংযোগ, পায়রা ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট তাপবিদ্যুত কেন্দ্র, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার-রেল সংযোগ, কর্ণফুলী টানেল, ঢাকা বাইপাস সড়ক উন্নয়ন প্রকল্পে চীনের নাগরিকরা বিভিন্ন পর্যায়ে যুক্ত আছেন। এসব প্রকল্পে দেড় হাজার চীনা নাগরিক কাজ করছেন। তার বাইরে আরও কিছু প্রকল্পে ৫০০ চীনা নাগরিক সহায়তা করছেন। এরই মধ্যে পদ্মা সেতু প্রকল্পে যুক্ত ৩৫ চীনা কর্মকর্তা-কর্মচারীকে পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে। ঢাকা বাইপাস সড়ক উন্নয়ন প্রকল্পে যুক্ত চীনের অর্ধশতাধিক কর্মকর্তা ছুটি নিয়ে দেশে গেছেন। তাদের ফেরা অনিশ্চিত। বাংলাদেশের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য, ঋণ, অনুদান, বিনিয়োগ এবং বড় প্রকল্পগুলোয় ক্রমেই সম্পৃক্ত হচ্ছে চীন। পাশাপাশি বেসরকারী পর্যায়ে সম্পৃক্ততা বাড়ছে। বর্তমানে প্রায় ৪শ’ চীনা কোম্পানি বাংলাদেশে কাজ করছে। বতর্মানে বাংলাদেশের ১২টি প্রকল্পে আর্থিক সহায়তা দিচ্ছে চীন। এসব প্রকল্পে দেশটির মোট সহায়তার পরিমাণ ১ হাজার ১১৫ কোটি ডলার। স্থানীয় মুদ্রায় যা প্রায় ৯০ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে রোড ট্রান্সপোর্ট এ্যান্ড হাইওয়ের ১৬০ কোটি ডলার, তথ্যপ্রযুক্তি খাতের উন্নয়নে ১৫ কোটি ডলার, কর্ণফুলী টানেলে ৭০ কোটি, রাজশাহী ওয়াসায় ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টে ৫০ কোটি ডলার, বিদ্যুত খাতের ডিপিসিতে পাওয়ার সিস্টেম নেটওয়ার্কে ৫০ কোটি, পদ্মা সেতু রেল সংযোগের দুই প্রকল্পে ২৫৮ কোটি ডলার, ঢাকা-আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসে ১৪০ কোটি ডলার, পাওয়ার গ্রিডে ১৩২ কোটি ডলার এবং টেলিকমিউনিকেশন আধুনিকায়নে ২০ কোটি ডলার সহায়তা করছে চীন। এছাড়া আরও ৯টি প্রকল্প প্রক্রিয়াধীন। এসব প্রকল্পে সহায়তার পরিমাণ ৮০৮ কোটি ডলার। বিকল্প বাজারে নজর সরকারের বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি জানিয়েছেন, চীনে করোনাভাইরাস সমস্যাটি দীর্ঘমেয়াদী হলে এর প্রভাব দেশের বাজারেও পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। তাই এ পরিস্থিতি মোকাবেলায় নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে বিকল্প বাজারে নজর রেখেছে সরকার। সোমবার বিকেলে বাংলাদেশ-কানাডা বাণিজ্য সম্পর্কিত বিষয়ে মতবিনিময় সভা শেষে বাণিজ্যমন্ত্রী এ কথা জানান। বাংলাদেশে সফররত কানাডার সাচকাচোয়ান প্রদেশের কৃষিমন্ত্রী এইচ ই ডাভিড মারিটের নেতৃত্বে প্রতিনিধিদলের সঙ্গে মতবিনিময় করেন মন্ত্রী। বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, বর্তমানে যে পরিমাণ পেঁয়াজ আমদানি হয়, এতে করে চায়না থেকে পেঁয়াজ আমদানি বন্ধ হয়ে গেলেও সমস্যা হবে না। তবে আদা-রসুনসহ অন্যান্য পণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখতে চায়নার বিকল্প বাজারে নজর রাখছে সরকার। তিনি বলেন, করোনাভাইরাসের কারণে ব্যবসা-বাণিজ্যে কতটুকু প্রভাব পড়েছে সে বিষয়ে ব্যবসায়ীদের নিকট প্রতিবেদন চাওয়া হয়েছে। সে প্রতিবেদন এখনও তারা দিতে পারেনি। প্রতিবেদন পেলেই সে অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। করোনাভাইরাসের প্রভাবে বাণিজ্যে কি পরিমাণ ক্ষতি হবে জানতে চাইলে বণিজ্যমন্ত্রী বলেন, ‘এখনই বলার সময় হয়নি কি পরিমাণ ক্ষতি হতে পারে। আমাদের অনেক আইটেম আছে যেগুলো চায়নার ওপর নির্ভরশীল। বিশেষ করে রেডিমেড গার্মেন্টসের অধিকাংশ ফেব্রিকস চায়না থেকে আসে, এটার ওপর প্রভাব পড়ছে কিনা দেখতে হবে। তবে এখন পর্যন্ত খুব একটা সমস্যার সৃষ্টি হয়নি। কারণ এখন চীনে শুধু একটি প্রদেশেই সমস্যা হচ্ছে। তারপর এখন ওদের বাৎসরিক ছুটিও চলছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘ক্ষতির বিষয়ে ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোর নিকট জানতে চেয়েছি। তাবে তারা এ বিষয়ে জানাতে দুই-তিন দিন সময় চেয়েছে। আশা করছি কালকের মধ্যে তারা হয়তো একটা ধারণা দিতে পারবে, সত্যিকার অর্থে কোন ক্ষতি হবে কিনা।’ চায়না থেকে পেঁয়াজ আমদানি করতে না পারলে সমস্যা হবে না জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এখন পেঁয়াজ আসছে মিয়ানমার, টার্কি, ইজিপট, পাকিস্তান থেকে। চায়নার জন্য পেঁয়াজের বাজারে প্রভাব পড়বে না। তবে রসুন-আদাসহ অন্যান্য মসলার সমস্যা হবে কিনা সেটি দেখছি। তবে সমস্যা হলে আমাদের বিকল্প মার্কেটে আমাদের যেতে হবে। কিন্তু এই মুহূর্তে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়নি। তবে আমরা লক্ষ্য রাখছি যে কি ধরনের সমম্যা আসতে পারে।’ এফবিসিসিআইকে তিনদিন সময় দেয়া হয়েছিল তারা কোন প্রতিবেদন দিয়েছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা গত বৃহস্পতিবার বৈঠক করে সময় দিয়েছিলাম। কিন্তু এরপর শুক্র, শনিবার ছুটির দিন হওয়ায় তারা হয়তো দেরি করছে। গার্মেন্টস সেক্টরের যারা ব্যবসায়ী তারা জানেন যে এ সময়টায় তাদের কোন আমদানি হবে না। কারণ এসময় চায়নায় ছুটি থাকে। তাদের কোন আমদানি হবে না। তাই ১৩ তারিখ সেখানকার ছুটি শেষ হলে বোঝা যাবে প্রভাব পড়বে কিনা।’ রসুনের দাম ১২০ থেকে বেড়ে ২০০ টাকা হয়ে গেছে এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আমরা এ বিষয়ে খুব সিরিয়াসলি নজর রাখছি। পেঁয়াজেও সুযোগ নিয়েছিল এখনও ব্যবসায়ীরা সুযোগ নিচ্ছে। সমস্যা একটু হলেই তারা সুযোগ নেই। মঙ্গলবারও আমরা এ বিষয়টি নিয়ে নিজেরা বসে করণীয় ঠিক করতে চাই। আদা-রসুন নিয়ে কি করা যায় সেটা কালকে আলোচনা করব।’ চায়না কয়েক দফা ছুটি বাড়িয়েছে, তারা ছুটি বাড়ানোর কারণে গার্মেন্টস প্রোডাক্টে গ্যাপ হতে পারে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, তারা আবার ছুটি বাড়ালে গার্মেন্টস সেক্টরে প্রভাব পড়বে। গার্মেন্টস সেক্টরের ব্যবসায়ীরা কি রিপোর্ট দেয় সেটি দেখতে হবে। তবে রাতারাতি এই সেক্টরে বিকল্প মার্কেট পাওয়া যাবে না। উল্লেখ্য, চীনের হুবেই প্রদেশের উহান থেকে ছড়িয়ে পড়া প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসে এখন পর্যন্ত সে দেশেই মৃত্যু হয়েছে ৯০৮ জনের। এছাড়া ফিলিপাইন ও হংকংয়ে মৃত্যু হয়েছে আরও দুজনের। অর্থাৎ সবমিলিয়ে সোমবার পর্যন্ত এই ভাইরাস কেড়ে নিয়েছে ৯১০ জনের প্রাণ। এ ভাইরাসে বিশ্বজুড়ে আক্রান্ত হয়েছেন আরও ৪০ হাজারেরও বেশি মানুষ।
×