ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

অজয় দাশগুপ্ত

সিডনির মেলব্যাগ ॥ মেলার গৌরব বহমান

প্রকাশিত: ০৯:০৬, ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২০

সিডনির মেলব্যাগ ॥ মেলার গৌরব বহমান

মেয়র ইলেকশন শেষ। এবার মানুষের আশা দুই মেয়র ঢাকাকে নিরাপদ করবেন। একজন তো অভিজ্ঞতাপুষ্ট। আরেকজন রাজনীতি নিয়ে বড় হওয়া। বাবা-মা হারানো একজন ব্যক্তি আজ ঢাকার নগরপিতা। একেই বলে প্রকৃতির খেলা। ঢাকা এখন চায় রোগ, আগুন, ডেঙ্গু এসব থেকে মুক্তি। রাজনীতির বাইরে যে সংস্কৃতিও জীবন ঢাকায় তার বড় প্রমাণ বইমেলা। এখন এই ফেব্রুয়ারি মাসে এর ভেতর দিয়েই শুরু হয়েছে ঢাকার উৎসব। বইমেলা আমাদের গৌরব। ঢাকা কবেই সবাইকে ছাড়িয়ে বড় হয়ে গেছে এ বিষয়ে। তার ব্যপ্তি, তার আয়তন, তার পরিধি এখন বিস্ময়ের। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন যে এতবড় হয়ে উঠবে সময় তা জানত। কারণ এমন ঘটনা দুনিয়ায় খুব বেশি নেই। যদিও আমাদের আশপাশের দেশ ভারতের দক্ষিণে ভাষার জন্য আত্মাহুতির ঘটনা আছে। তাদের রক্তপাত সম্মান বাঁচালেও চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করতে পারেনি। আমাদের ইতিহাস ভিন্ন। একুশে একটি রাজনৈতিক সংগ্রাম হলেও তা আর এখন রাজনীতিতে সীমাবদ্ধ নেই। তার যে কি জ্যোতি, কি আলো তা বিদেশে না এলে টের পাওয়া কঠিন। পৃথিবী স্বীকৃত মাতৃভাষা দিবস কোথায় পালন করা হয় সেটা বড় ব্যাপার নয়। বড় কথা এর আন্তর্জাতিক জয়জয়কার। যে বাঙালী ভাষাভিত্তিক আন্দোলনের পর মুক্তিযুদ্ধে উদ্বুদ্ধ হয়ে উঠেছিল, তার প্রেরণা ও ভূমিকাই এখন পর্যন্ত সর্বজনস্বীকৃত। মুক্তিযুদ্ধ ও দেশবিরোধী অপশক্তি ছাড়া আর সবার কাছে তা সমান গ্রহণযোগ্য। এই ভাষা দিবস দেশের বাইরেও এখন তার প্রভাব ফেলছে। সিডনির কথাই বলি। কুড়ি বছরেরও আগে যখন এদেশে আসি ভেবেছিলাম দেশ থেকে বই আনা-নেয়া ছাড়া কোন পথ নেই বইয়ের কাছে যাওয়ার। সে বিষয় এখন অতীত। এখন একদিকে আকাশ সংস্কৃতি, আরেকদিকে সহজ যোগাযোগ। চাইলে যে কোন বই, যে কোন গ্রন্থ, যে কোন মিডিয়া আপনি ঘরে নিয়ে আসতে পারেন। আমাদের বাংলা ভাষাপ্রেমকে যা দিয়েছে আরও গতি। সিডনিতে যে মাতৃভাষা স্মৃতিসৌধ তাও এক ইতিহাস। একুশে একাডেমির নেতৃত্বে প্রবাসী বাংলাদেশীদের সার্বিক সহযোগিতায় অসাধ্য সাধন হয়েছে আগেই। এখন একে ঘিরে জমে উঠেছে বইমেলা। দেশের সাড়া জাগানো যে কোন বই আপনি পাবেন অনায়াসে। যোগ হয়েছে প্রবাসে বসবাসরত লেখকদের স্বতঃস্ফূর্ততা। প্রতিবছর বাড়ছে অংশগ্রহণ। কোন দেশই এখন দূরের কিছু না। দেশ থেকে বা অন্য দেশ থেকে জমকালো প্রচ্ছদ আর চমৎকার বাঁধাইয়ে চকচক করা বইয়ের অনেকগুলোই বিষয় আর মানে অসাধারণ। বইয়ের এসব লেখক ক্রমেই দেশের সঙ্গে প্রবাসের দূরত্ব কমিয়ে আনছেন। পাশাপাশি নতুন প্রবাসী লেখকের দল প্রমাণ করে দিচ্ছেন আমরা কতটা ভাষা আর দেশ অনুগামী। ভাবুন দীর্ঘকালের অভিবাসন আর আসা-যাওয়ার দেশ আমেরিকার কথা! সেখানে দেশের সঙ্গে পাল্লা দেয়া টপকে যাওয়ার মতো কাজ হচ্ছে অহরহ। বিশাল পাঠকগোষ্ঠীও গড়ে উঠেছে এই ফাঁকে। আমি বলব দেশের মানুষ দেশে যত বাংলা বই পড়েন আনুপাতিক হারে প্রবাসী বাঙালীর ভেতর পড়ুয়াদের সংখ্যা তার চেয়ে অধিক। কারণ তারা আদর্শের প্রেম আর না পাওয়ার ভালবাসায় সর্বদা মুখিয়ে আছে। যে কারণে দেশের বইমেলার মান ও বইয়ের মান এখন বড় বিষয়। কেবল মেলার জন্য মেলা হওয়ার দিন নেই আর। সে সময় পেরিয়ে গেছে। যে বিষয়টা খেয়াল করি বইয়ের মধ্যে কবিতা, গল্প বা চটুল বিষয়ের বইয়ের সংখ্যা যেন অনেক বেশি। কবিতাপ্রেমী বাঙালীর সহজাত প্রবণতা এক বয়সে কবি হওয়া। কিন্তু এভাবে গ্রন্থ প্রকাশের সুযোগ ছিল না তখন। নিজের বই নিজে বের করার কথা আমরা ভাবতেও পারিনি। আমাদের ধারণা ছিল লেখক তখনই লেখক যখন কোন প্রকাশক তার কাছে পা-ুলিপি চায়। আর না চাইলেইবা কি? এমন অনেক প্রথিতযশা মেধাবী লেখক আছেন আমাদের যার মর্যাদা, গুরুত্ব ও অবদান হাজার হাজার কপি বিক্রি হওয়া বা ছোট এক জীবনে অগণিত বইয়ের জনক-জননী হওয়া লেখকের চেয়ে অনেক বেশি। তারা কালজয়ী, অমরও বটে। আমি এই বই বের করার প্রবণতার বিরুদ্ধে নই। এর ভাল দিক নবীনদের আত্মপ্রকাশ। তাদের মেধা ও শ্রমের স্বীকৃতি। কিন্তু এর খারাপ দিকটা হচ্ছে নিজের পা-ুলিপি নিজে ছাপানোর কারণে কোন সম্পাদনা বা অভিভাবকত্ব না থাকা। চেক দেশের এক অধ্যাপকের কথা আগেও বলেছি। তিনি আমাদের দেশের ভাষা আন্দোলন বইমেলা নিয়ে পড়াশোনা করেছেন। জানেন। ভালও বাসেন। তার প্রশ্ন, তাদের ছোট্ট দেশে ভাষার জন্য কেউ প্রাণ দেয়নি। জনসংখ্যা অনেক কম হওয়ার পরও তারা যদি নিজের ভাষায় সব ধরনের বই লিখতে পারে বা পেতে পারে, বাংলাদেশ পারবে না কেন? মৌলিক প্রশ্ন বটে। আকাশ বিজ্ঞান, মহাশূন্য, চিকিৎসা শাস্ত্র বা আইন বিষয়ে কি আমাদের এমন কিছু আছে? আছে ভ্রমণ বা অনুবাদে? সে কারণে বইমেলার কাছে প্রত্যাশা এ জাতীয় প্রকাশনাগুলোকে গতিশীল করা হোক। উৎসাহিত করা হোক। বাংলা একাডেমিও এ বিষয়ে ভূমিকা রাখতে পারে। আরও একটা বিষয় হলো দেশ। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে আবেগঘন অনেক বইপত্র থাকলেও ইতিহাস ও দেশের অগ্রগতির বিষয়ে তেমন প্রকাশনা নেই। আজকের বাংলাদেশ যেভাবে এগিয়ে চলেছে তাতে চমৎকৃত বাকি দুনিয়া শুধু তার আর্থিক প্রগতি দেখছে। কিন্তু তথ্য ও প্রমাণে তার যে দলিল চাই সে কাজ এখনও প্রায় অধরা। যাকে আমরা বলি প্রেরণা। সে প্রেরণা ও আশা জাগানিয়া বইগুলো কবে বের হবে? বড় কথা এই, আমরা প্রমাণ করেছি কোন আধুনিকতা বা বায়বীয় উৎপাত আমাদের মুদ্রণ শিল্প ও গ্রন্থ শিল্পকে ধ্বংস করতে পারেনি। পারবেও না। আজ ঢাকা কলকাতা থেকে লন্ডন সিডনি প্যারিস হয়ে আমেরিকা ও সাত সমুদ্রে ঢেউ তুলছে। বইমেলা আমাদের জাতীয় ঐক্য ও সংস্কৃতির প্রতীক। হলপ করে বলতে পারি নানা জ্যোতিতে বাংলাদেশ এখন পূর্বের আলো ফেলছে পশ্চিমে। বহুলভাবে হলেও আস্তে আস্তে পিছিয়ে পড়ছে পশ্চিম। কমে আসছে তাদের দাপট। আর তাই আমাদের দায়িত্ব এখন অধিক। আমাদের দেশের ধুলোময় বইমেলা বিদেশের সুন্দর মনোমুগ্ধকর ফুলময় বইমেলাগুলোর চাইতে অনেক শক্তিশালী। আমরা হয়ত এখনও বুঝে উঠতে পারিনি তা। সময় কড়া নাড়ছে দরজায়। বইমেলা হয়ে উঠুক আন্তর্জাতিক মেলবন্ধনে আরেক বাংলাদেশ। [email protected]
×