ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ঢাকার দিনরাত

প্রকাশিত: ০৯:০০, ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২০

ঢাকার দিনরাত

শুধু কটুবাক্য নয়, নিন্দামন্দ নয়, আমরা প্রশংসা করতেও জানি। গত সপ্তাহে অন্তত তিনটি চাক্ষুষ প্রমাণ পেয়েছি বলেই ধন্যবাদ জানাচ্ছি ঢাকার ট্রাফিক পুলিশ কর্তৃপক্ষকে। বড়ই অহঙ্কারী একটি আধা সরকারী প্রতিষ্ঠানের কর্মী পরিবহনের বাস আটকে দিলেন কর্তব্যরত ট্রাফিক পুলিশ আইন ভঙ্গ করে গাড়ি চালনার কারণে। রিক্সাওয়ালাদেরও দেখছি ক্ষেপে উঠতে (মানে বাধ্য হয়ে ট্রাফিক আইন মানতে)। সোজা হয়ে চলছে তারা। প্রাইভেট কারগুলো তো আগে থেকেই সাইজ। কেননা তাদের মালিকদের ধারণা ট্রাফিক পুলিশ তাদের শুধু শুধু আটকায় টাকা খাওয়ার জন্য। তবে এখনও মোটরসাইকেল চালকেরা বেপরোয়াই রয়ে গেছে। তাদের শায়েস্তার জন্য নিতে হবে বিশেষ এ্যাকশন। হায় গণপরিবহন রাজধানী ঢাকায় বসবাস এক সময় এদেশে অনেকের কাছেই ছিল স্ট্যাটাস সিম্বল। ঢাকার বাইরের স্থায়ী অবস্থাসম্পন্ন মানুষ চাইতেন ঢাকায়ও তাঁর একটি বাড়ি থাক। দেশের সেরা শহর যে ছিল ঢাকা! এখনও বিলক্ষণ ঢাকা সেরাÑ তবে ইতিবাচক বিষয়গুলো পরিবর্তিত হয়ে গেছে নেতিবাচকতায়। এখন সে সেরা দূষণে, সর্বক্ষেত্রেরই দূষণে, সেরা সে বিবিধ বিড়ম্বনায়, বিচিত্র ভোগান্তিতে। শঙ্কা, সমস্যায় ভারাক্রান্ত ঢাকা ক্রমশ হয়ে উঠছে যেন এক অভিশপ্ত নগরী। বসবাসের অযোগ্য, চলাচলের অযোগ্য ঢাকা তবু নিত্যদিন স্বাগত জানিয়ে চলেছে নতুন আগন্তুকদের। গোটা দেশের অভাবতাড়িত মানুষের কাছে ঢাকা হলো জীবন ধারণের শেষ আশ্রয়। এখানে এলে দু’বেলা দু’মুঠো খাওয়ার কোন না কোন ব্যবস্থা হয়েই যাবে- এমনটাই পাকাপোক্ত ধারণা। প্রতিদিন জীবিকার প্রয়োজনে মানুষকে ঘর থেকে বেরুতেই হয়। মধ্যবিত্ত যে ভদ্রলোকটি অফিসে যাওয়ার জন্য রিক্সায় করে যান সিএনজি অটোরিক্সা বা বাসস্ট্যান্ডে, রিক্সা থেকে নেমে ভাড়া মেটাতে গিয়ে দেখেন দু’পাশে হাত পেতে আছে বৃদ্ধ কিংবা বৃদ্ধা। ওরা জীবিকার তাগিদে আগেই চলে এসেছেন তাদের ‘কর্মস্থলে’। মুখে কিছুই হয়ত উচ্চারণ করেন না তারা। শুধু ডান হাতখানি বাড়িয়ে রাখেন, আর চোখ তার ভদ্রলোকটির মানিব্যাগের দিকে। রিক্সাওয়ালাকে প্রাপ্য বুঝিয়ে দেয়ার পর যদি খুচরো কিছু জোটে তাদের। যদি রিক্সারোহী তাদের উপেক্ষা করে চলে যান তবে তারাও এক মুহূর্ত নষ্ট না করে অন্য রিক্সার দিকে ছুটে যান। হাত পাতা এবং হাত বাড়িয়ে ছিনিয়ে নেয়া- দুটো ‘পেশা’ই চলছে এখন পেশাদারিত্বের সঙ্গে। যা হোক, ঢাকার আজকের বড় সমস্যা কি- এমন প্রশ্ন করলে গতকাল এবং গত পরশুর উত্তরেরই পুনরাবৃত্তি করতে হবে। অবধারিকভাবে সমস্যা হলো যানজট। যানজট, নাকি যানের আধিক্য? সঠিকভাবে বলতে গেলে কোন্টার কথা আগে আসবে? আপনি বলবেন যানের আধিক্য বলেই যানজট। আরেকজন বলবেন সড়কের স্বল্পতা বলেই যানজট; আরেকজন নিশ্চয়ই বলতে বাধ্য হবেন ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের ত্রুটির কারণেই যানজট। প্রতিটিই সত্য। একটি একটি করে সমস্যা যোগ হয়ে মহাসমস্যায় পরিণত। সেদিন মতিঝিলে যেতে হয়েছিল বিশেষ কারণে। ফেরার সময় বিআরটিসির এসি বাসে উঠেছিলাম। বিকেল চারটায় বাস ছাড়ে। বাংলামোটর মোড় পর্যন্ত আসতে পাক্কা দু’ঘণ্টা লেগে যায়। এই পথটুকু হেঁটে আসতে কতক্ষণ লাগত? কোনক্রমেই এক ঘণ্টার বেশি নয়। চারদিকে তাকালে নন এসি বাসই বেশি চোখে পড়ে। তার ভেতরে গরমে ধস্ত নাকাল মানুষের সারি। প্রাইভেট গাড়িই বেশি রাস্তায়। আর তার বেশিরভাগই শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। আপনাকে যদি কোন কারণে কোন এসি প্রাইভেট কারের ঠিক পাশ দিয়ে যেতে হয় তাহলে টের পাবেন ওই ঠা-া গাড়িটি কিভাবে উগরে দিচ্ছে তপ্ত বাতাস। হঠাৎ করেই আগুনের হল্কা এসে পড়বে আপনার শরীরে। ঢাকার গণপরিবহনের শতকরা এক ভাগও কিন্তু এসি নয়। মতিঝিল-উত্তরা রুটে গত দশকেও অন্তত তিনটি কোম্পানির এসি বাস চলত। এখন রয়েছে শুধু বিআরটিসি। তাও প্রতি ঘণ্টায় একটি করে চলে কিনা সন্দেহ। ঢাকাকে রাজধানী বলে ডেকে শুধু শুধু আত্মপ্রবঞ্চনা। দিন দিন নাগরিক সুবিধা এখানে কমেই চলেছে। কোন কোন বাসের ভেতরে ছোট ছোট ফ্যান রয়েছে। চালককে সেগুলোর সুইচ অন করতে বলবেন, দেখবেন চালক নিরুত্তর। অভিজ্ঞ কোন সহযাত্রী জানিয়ে দেবেন যে, সব ফ্যানই নষ্ট, কেবল চালকের মাথার ওপরেরটা ছাড়া। এসব যখন ভাবছি অসহ্য ট্রাফিক জ্যামের ভেতর বসে দেখি একটি মাইক্রোবাসের আসনের প্রতিটি সারিতে বসা মহিলা যাত্রীরা হাত পাখা দোলাচ্ছেন। গাড়ি চললে প্রাকৃতিক বাতাসের ভাগ পাওয়া যায়। কিন্তু বেশিরভাগ সময় বন্ধ গাড়ির ভেতরেই নিষ্ক্রিয় স্থবির হয়ে থাকতে হয়। সাবধানীরা একটা করে হাতপাখা বহন করে অন্তত শরীরকে কিছুটা স্বস্তি দেয়ার কাজটি করে থাকেন। গণপরিবহনে, ঢাকার বাস-মিনিবাসে যাত্রীদের কাছ থেকে ভাড়া নিয়ে টিকেট দেয়া হয় না কেন? এই নিয়ম কেন উঠে গেল? অনুসন্ধান করলে বেরিয়ে আসবে শুধুমাত্র যাত্রীদের ঠকানোর জন্যই এই নিয়ম। অর্থাৎ অনিয়ম। কন্ডাক্টর এক যাত্রীর কাছে বার বার ভাড়া চান। ভাড়া দেয়ার পরও ভাড়া চাইতেই থাকেন। কন্ডাক্টরকে দোষ দেব না। সে ৫০-৬০ জন যাত্রীর ক’জনের মুখ মনে রাখবে? কিভাবে মনে রাখবে কে টাকা দিয়েছে আর কে দেয়নি! সে জন্যই টিকিট দেয়া জরুরি। অন্তত কোন চতুর যাত্রী ভাড়া না দিয়ে বলতে পারবে না যে ভাড়া দিয়েছি। কেননা কোনো প্রমাণ তো নেই। বাস মালিকরা ইচ্ছে করে টিকিট দেয়ার চল উঠিয়ে দিয়েছে। এতে তাদের কোন প্রমাণ থাকল না যে কত কিলোমিটারের জন্য কত ভাড়া নিচ্ছে। সিটিংয়ের নামে চিটিংবাজি করেই চলেছে ঢাকার গণপরিবহন। সিটিংয়ের ভাড়া নিলে দাঁড়িয়ে লোক নেবে না এবং যত্রতত্র গাড়ি থামাবে না। যত্রতত্র বলতে যে কোন জায়গায়। হাত ওঠালেই গাড়ি থেমে যায়, স্টপেজের কোন তোয়াক্কা নেই। আর ভাড়া আদায়ের বেলায় মাঝামাঝি কিছু নেই। সর্বশেষ গন্তব্যের ভাড়াই গুনতে হয় যাত্রীকে মাঝপথে তার গন্তব্য হলেও। এই অনিয়মের অবসান জরুরী। যারা বাসে ওঠেন তাদেও বড় অংশ মাস এনে মাস খাওয়া মানুষ। ১০ বা ২০ টাকা অতিরিক্ত ভাড়া দিতে হলে তাদের এটা গায়ে লাগবেই। গণপরিবহনের বিশৃঙ্খলার কথা আমরা বার বার বলে এসেছি। অবস্থার উন্নতি হয়নি। সব কাজ মন্ত্রীকে সরেজমিনে করতে হয় না। সঠিক নির্দেশনা দিলেই হয় এবং তা মনিটর করাতে হয় সৎ লোকের মাধ্যমে। ঢাকায় লাখ লাখ মানুষ পাবলিক বাস-মিনিবাসে যাতায়াত করে। তাদের ভোগান্তিতে ফেলে, পকেট কেটে, বিরক্ত ও ক্ষুব্ধ করে তুলে কর্তৃপক্ষের কোন ফায়দা হয় না। এই দায়িত্ব হয়ত মেয়রের নয়। কিন্তু মেয়র যদি সদিচ্ছবশত নাগরিক বিড়ম্বনা কমাতে কোন ইতিবাচক উদ্যোগ নেন তবে ঢাকাবাসী খুশিই হবেন। নতুন বছরের দেড় মাস চলে গেল। সামনের দিনগুলোতে পরিস্থিতির ইতিবাচক পরিবর্তন আনার চেষ্টা করুন। একবার পদ হারালে কিন্তু অসম্মানের চূড়ান্ত হতে হবে, কর্তা ব্যক্তিরা এই কথা যেন স্মরণে রাখেন। বইমেলা ২০২০ বইমেলার শুরু দিন অল্প সময়ের জন্য গিয়েছিলাম, পরে আরও একবার যাই। সুপরিসর জায়গা নিয়ে নান্দনিক বিন্যাসে বেশ ভাল বইমেলা হচ্ছে। মানুষ বইকেনার বিষয়টিকে পরবর্তী ধাপে রেখে অবাধে প্রমোদভ্রমণ করতে পারছে। ঘুরে বেড়ানোর এমন স্বাচ্ছন্দ্য আর কোথায় মিলবে এই ঢাকা শহরে? আমাদের বন্ধু বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কবি কামরুল হাসান সাহিত্য ধাঁচের প্রতিবেদন লিখেই চলেছেন তার ফেসবুক ওয়ালে। মেলা নিয় তিনি যা লিখেছেন তা বহুজনেরই মনের কথা। তার লেখা থেকে তুলে দিচ্ছি : ‘বইমেলায় গেলাম ষষ্ঠ দিনে। সেখানে যাবার আগে এবারের বইমেলার নবতর রূপের প্রশংসা শুনেছি সকলের মুখে। গিয়ে দেখলাম সত্যি তাই, ভাললাগার শুধু নয়, ভালবাসার মতো বইমেলা। এত বড় পরিসরের, এত সুসজ্জিত বইমেলা আগে কখনই হয়নি। বাংলাদেশের জাতীয় বাজেট ও মুদ্রা পাচারের মতো বেড়েই চলেছে বইমেলার পরিসর। এবার সবচেয়ে বেশি টানল লিটল ম্যাগাজিন চত্বরকে বর্ধমান হাউসের পেছন থেকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নিয়ে আসার ঐতিহাসিক ঘটনা। স্বাধীনতা স্তম্ভ ও তার জলাধারকে মেলার ভেতর টেনে এনে কেবল দিগন্তকেই প্রসারিত করা হয়নি, এক অতুলনীয় নান্দনিকতাও আনয়ন করা হয়েছে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ও বাংলা একাডেমির মধ্যবর্তী সড়কে, যে সড়কে মনে পড়ে, নব্বই দশকের বইমেলায় দুপাশে প্রচুর দোকানপাট বসত, সেখানে মেট্রোরেলের খোঁড়াখুঁড়ি। মাটি খুঁড়লে যা হয়, বেরিয়ে আসে ধুলা। ওই সড়কে, গোটা বইমেলায়, প্রধান হুমকি মনে হয় ধুলা। আর সদ্য নির্বাচিত নগরপিতাগণ মশককুলকে সরিয়ে না নেয়া পর্যন্ত তারাও কানের কাছে সঙ্গীত সাধনা করে যাবে। করোনা নামক দৈত্য আসার পরে মশারা এমনিতেই কৌলিন্য হারিয়েছে, আর বইমেলায় লোক বেশি না মশা বেশি সেই পরিসংখ্যানে গেলে এটা ধর্তব্যের মধ্যে নয়। বাকি রইল কেবল ধূলি- যা পুরো হয়ে বসছে বইমেলার তাবত খাবারে। আমি মেলার সৌন্দর্যে বিহ্বলিত বালক স্থির বিশ্বাস নিয়ে ঘুরি আর ভাবি নামে লিটল হলেও তাদের মিলিত শক্তি তো আর লিটল নয়, চোখে পড়বেই। কিন্তু ভূতের আড্ডা যার মাথা থেকে বেরিয়েছিল সেই স্থপতি নির্ঝর যখন থেকে এই মেলার নকশা করার মহৎ দায়িত্বটুকু তার প্রতিভাবান স্কন্ধে তুলে নিয়েছেন, তিনি যে সৌন্দর্যের পাশেই রহস্যময়তা সাজিয়ে রাখবেন, আলোর পাশে ঝুলিয়ে রাখেন মায়াময় অন্ধকার, তিনি যে গোলকধাঁধা তৈরি করবেন- সেটা আর আশ্চর্য কী! আমি ঘুরে ঘুরে হয়রান, খুঁজে পাই না। যেখানে লেখক-পাঠক মুক্তমঞ্চ ছিল, সেখানে ফুড জোন, নাট্যমঞ্চের পেছনে বই প্রকাশ মঞ্চ। এর সমুখেই যে লিটল ম্যাগাজিন চত্বর দেখতে পাইনি। আমি যে নগরে এসে পথ হারিয়ে ফেলা বালক বুঝতে পেরে ডালিয়া দূত পাঠালেন আমাকে উদ্ধারের জন্য। দূত আর কেউ নন, চিরচেনা সুহৃদ মাহমুদ হাফিজ। ডালিয়া বসেছিল ‘ভ্রমণগদ্য’-এর স্টলের সমুখেই, যে পত্রিকার সম্পাদক কবি ও ভ্রামণিক মাহমুদ হাফিজ। গোলকধাঁধার বইমেলায় অন্যপ্রকাশের স্টলের বিন্যাসে বাতিঘরের মতো দাঁড়িয়ে আছেন হুমায়ূন আহমেদ।’ ৯ ফেব্রুয়ারি ২০২০ [email protected]
×