ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

হিমালয়কন্যা তেঁতুলিয়া থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা আবছা চোখে পড়ে...

প্রকাশিত: ১০:২১, ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২০

  হিমালয়কন্যা তেঁতুলিয়া থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা  আবছা চোখে পড়ে...

সমুদ্র হক ॥ প্রকৃতির তীর্থভূমি হিমালয়কন্যা আমাদের স্বাধীনতার তীর্থক্ষেত্র। ভোরের আলো ফুটতেই কাঞ্চনজঙ্ঘা অবগুণ্ঠন খুলে তাকায়। স্নিগ্ধ আলোয় চকচক করে ওঠে চূড়া। বরফাচ্ছাদিত কাঞ্চনজঙ্ঘা নানা রঙে ছন্দায়িত হয়ে নিসর্গের ভুবন তৈরি করে যে জায়গায় তার নাম পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া। দেশের প্রান্ত বুঝতে আমাদের উত্তরদুয়ারি তেঁতুলিয়া। প্রাচীন এ জনপদ তেঁতুলিয়া কয়েকটি কাল অতিক্রমের পর সভ্যতার ঊষালগ্নের ইতিহাস তুলে ধরেছে। ঐতিহাসিকরা আজও খুঁজে চলেছেন ইতিহাস। উত্তরের পঞ্চগড় জেলার একটি উপজেলা তেঁতুলিয়া। পাঁচটি গড় নিয়ে গঠিত বলেই নামকরণ হয়েছে পঞ্চগড়। মহানন্দার তীরের তৎকালীন জলপাইগুড়ি জেলার অধীনে তেঁতুলিয়া সবচেয়ে প্রাচীন থানা, ১৮৫৭ সালে গঠিত। এখানে আছে প্রাচীন ইতিহাসের সাক্ষ্য ‘ভিতরগড়’। বগুড়ার মহাস্থানগড়ের পরে নির্মিত হলেও গড়ের আয়তনে দেশের সবচেয়ে বড় এটি। দুর্গ গড়ের বিস্তৃতি প্রায় বিশ কিমি এলাকাজুড়ে। ভিতরগড়কে ঘিরেই, বলা হয়েছে, বিস্তৃতি ঘটেছে সভ্যতার। পরিচিতিতে যুক্ত হয়েছে হিমালয় দুহিতা। প্রাচীন ও মধ্যযুগে তেঁতুলিয়া ছিল সীমান্ত অঞ্চল, আজও তাই। মহানন্দা নদীর পূর্বে ছিল কামরূপ। সামরিক প্রাধান্য বজায় রাখতে দুর্গ ও গড় নির্মাণের পালা শুরু হলে এর ভিত্তিতেই জনপদের নাম। ইতিহাসের অনেক বাঁক বদলে তেঁতুলিয়া আজও সীমান্ত এলাকাই রয়ে গেছে। মহানন্দার বিপরীতে ভারতের তিনটি জেলা পূর্ণিয়া, দার্জিলিং ও জলপাইগুড়ি পরস্পর কোণাকুণি করে অপূর্ব রহস্যময়তা, যা ধরা রয়েছে তেঁতুলিয়া। অতীতে এলাকাটি ছিল বনজঙ্গল-ঝোপঝাঁড়ে পরিপূর্ণ। পরে রাজ পরিবার ও ব্রিটিশরা মাটির নিচে পেয়েছে বহু সম্পদ। তারা বিভিন্ন স্থান থেকে লোক এনে বন কেটে বসতি গড়ে প্রজা বানিয়েছে। সম্পদ লুণ্ঠন ধরে রাখতে কেউ এই অঞ্চল হারাতে চায়নি। দখলের পালায় কেউ ছিটকে পড়েছে, কেউ রাজত্ব পেয়েছে। নিরন্তরের এই খেলায় কাছ থেকে দেখেছে হিমালয় চূড়া কাঞ্চনজঙ্ঘা। কাল, কয়েকটি যুগের ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় এসেছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ। হানাদার পাকবাহিনীকে পরাস্থ করে করে তেঁতুলিয়া হয়েছে আমাদের স্বাধীনতার তীর্থক্ষেত্র। একাত্তরে হানাদার পাকবাহিনী একদিনের জন্যও তেঁতুলিয়ায় ঢুকতে পারেনি। তেঁতুলিয়া ছিল মুক্তাঞ্চল। তেঁতুলিয়ার তাওয়াই নদীর ওপর অমরখানা ব্রিজ (তাওয়াই ব্রিজ) গুঁড়িয়ে দিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা হানাদারদের প্রবেশ বন্ধ করে দেয়। পঞ্চগড়ের সব গড় সুরক্ষিত। ’৭১ সালের ৭ জুলাই প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ এম কামারুজ্জামান, মুক্তিবাহিনী প্রধান কর্নেল এম এ জি ওসমানী তেঁতুলিয়া পাইলট হাইস্কুলে স্থাপিত মুক্তিযুদ্ধের জন্য সংরক্ষিত অস্ত্র গোলাবারুদ পরিদর্শন করেন। মুক্তিযোদ্ধারা সেখানে থেকে অস্ত্র নিয়ে বিভিন্ন সেক্টরে যুদ্ধ যেত। ৬ নম্বর সেক্টরের অধীন তেঁতুলিয়ায় গড়ে তোলা হয় বেসামরিক প্রশাসন। এখান থেকে রণাঙ্গনের দিকনির্দেশনা দেয়া হতো, যা লিখেছেন মুক্তিযুদ্ধকালীন সাপ্তাহিক সংগ্রামী বাংলার সম্পাদক ইতিহাসের দলিলপত্র গ্রন্থের লেখক কাজী মাহবুবর রহমান। ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি যে ঘটে তার প্রমাণ দিয়েছে তেঁতুলিয়া। উঁচু টিলার ওপর তিনশ’ বছরের ঐতিহ্যবাহী ভিক্টোরিয়ান ধাঁচের প্রাচীন ডাকবাংলো থেকে তেঁতুলিয়া সরকারী পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় পর্যন্ত ছিল ব্রিটিশদের সেনানিবাস। এই স্কুল মাঠে ১৮৬০ সালে বাণিজ্যমেলা বসে। পনেরো বছর ধরে পঞ্চগড়ে চার দেশের বাণিজ্যমেলা হয়ে আসছে। তেঁতুলিয়ার কাছে চারটি বেষ্টনীতে সুরক্ষিত ‘ভিতরগড়ে’র প্রাচীন ও পৌরাণিক কয়েক কালের ইতিহাস ধরে রেখেছে। গড়ের বহির্ভাগে সুপ্রশস্ত পরিখা। কেন্দ্রস্থলে বিশাল দীঘি। উত্তর-দক্ষিণে একশ’একর জমির ওপর খনন করা পাড়ের উচ্চতা সমতল থেকে ২০ ফুট ওপরে। দশটি শান বাঁধানো ঘাট, গভীরতা ৪০ ফুট। মহারাজার নামে পরিচিত এই দীঘির জল নির্মল, স্বচ্ছ। তবে ভিতরগড় দুর্গ ও নগর প্রতিষ্ঠা নিয়ে আছে একাধিক মতামত। পৌরাণিক যুগে এই দুর্গ ছিল পৃথু রাজার রাজধানী। খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতকে শুদ্র বংশীয় দেবেশ্বর ছিলেন কামরূপের রাজা। দেবেশ্বরের বংশজাত পৃথুশুল পশ্চিম কামরূপ রাজত্ব করতেন। কীচক বংশীয় নিম্নজাতের এক রাজা পৃথুশুলের রাজ্য আক্রমণ করলে পৃথুশুল পরাজিত হয়ে অনুগত সৈন্য ও পরিবারবর্গ নিয়ে নিরুদ্দেশে যাত্রা করেন। পরে শক্তি সঞ্চয় করে ফিরে এসে পৃথুশুল ভিতরগড় পুনরায় দখল করে রাজ্য স্থাপন ও নগর নির্মাণ করে তিনি সুরক্ষিত ব্যবস্থার আওতায় আনেন। প্রাচীরের উত্তর ও দক্ষিণ প্রান্তে দুটি প্রবেশদ্বার কালদুয়ার ও যমদুয়ার। গড়গুলো ১৫ ফুট উঁচু, দশ ফুট প্রশস্ত। মাটির নিচে পাথর। নবম দশম শতাব্দীতে তীব্বতীয়দের আক্রমণ থেকে রক্ষার জন্য বাংলার পালবংশীয়রা ভিতরগড় দুর্গ সম্প্রসারণ করেন। পুন্ড্র গুপ্ত পাল সেন, মুঘল ও মুসলিম শাসনামলের কয়েক হাজার বছরের ঐতিহ্যকে সমৃদ্ধ করেছে এই ভিতরগড়। এই গড় ঘিরে তেঁতুলিয়ার আয়তন ১৮৯ দশমিক ১২ বর্গ কিমি। জনসংখ্যা ১ লাখ ২৫ হাজার। সাতটি ইউনিয়ন-বাংলাবান্ধা, তিরনইহাট, তেঁতুলিয়া, শালবাহান, বুড়াবুড়ি, জবনপুর ও দেবনগর। কাছাকাছি বয়ে চলেছে ডাহুক মহানন্দা করতোয়া নদী। ভিতরগড় দুর্গ ছাড়াও বুড়াবুড়িতে দুর্গের অংশ ভদ্রেশ্বর মন্দির শিবমন্দির গ্রীক স্থাপত্য শৈলীতে নির্মিত স্থাপনা ১৯৪২ সালের ভূমিকম্পে ধ্বংস হয়ে গেছে। ওই ধ্বংসাবশেষ আজও দৃশ্যমান। মহানন্দার তীরে টিলার ওপর ডাকবাংলোর চারদিকে রয়েছে প্রকৃতির অপরূপ শোভা। এই ডাকবাংলো থেকে সবচেয়ে ভাল দেখা যায় হিমালয়ে অবস্থিত পর্বতশৃঙ্গ কাঞ্চনজঙ্ঘা। ছবির মতো ভেসে ওঠে। দার্জিলিংয়ের পাহাড়ী অঞ্চলের ছায়া আবছা চোখে পড়ে। নদীর ওপারে ভারতের শিলিগুড়ি দার্জিলিং ও সিকিম রাজ্য। কাঞ্চনজঙ্ঘাকে সবচেয়ে ভাল করে দেখতে প্রকৃতির সঙ্গে মিতালি করতে হয়। মেঘ আর কুয়াশামুক্ত গাঢ় নীল আকাশের আবহাওয়ায় অপরূপ অপ্সরা সুন্দরী কাঞ্চনজঙ্ঘা যেন চোখ মেলে তাকায়। সন্ধ্যায় দার্জিলিংয়ের বাতি চোখে পড়ে। ইদানীং তেঁতুলিয়ায় গড়ে উঠেছে চা বাগান। এখন তেঁতুলিয়ার চা দেশের অন্যতম হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। তেঁতুলিয়ার একটি ইউনিয়ন বাংলাবান্ধার বড় পরিচয় চার দেশের প্রবেশ দ্বার। ব্রিটিশ আমলে ভুটান রাজার সঙ্গে বেশ কয়েকবার যুদ্ধ হয় ব্রিটিশদের। ব্রিটিশরা পরে আন্তর্জাতিক সীমানা চিহ্নিত করে। তখন থেকেই নামকরণ বাংলাবান্ধা। বাংলাবান্ধার বৈকণ্ঠপুরে ছিল দেবী চৌধুরানী ও ভবানী পাঠকের অবাধ বিচরণ। অবশ্য শেষ সিকিম যুদ্ধে ব্রিটিশরা বাংলাবান্ধা কেড়ে নেয়। বর্তমানে এই বাংলাবান্ধা থেকেই দেশের সংসদীয় আসন শুরু। তেঁতুলিয়ার শালবাহান এক রাজার নামে নামকরণ। তিনি মাটির নিচে খনিজসম্পদ আবিষ্কার করেছিলেন। পরে এখানেই গড়ে ওঠে তেঁতুলিয়ার সবচেয়ে বড় বাজার। আশির দশকে শালবাহানে তেল উত্তোলনের জন্য খনন শুরু হলেও পরে তা বন্ধ হয়ে গেছে। মহানন্দার ভেতর ও আশপাশের এলাকায় মাটির নিচে পাওয়া নুড়ি ও বড় পাথর দেশের অমূল্য সম্পদ। উন্নয়ন কর্মকান্ডে এই পাথর যায় দেশের বিভিন্ন স্থানে। মহানন্দা করতোয়া শুকিয়ে গেলে অনেক প্রাচীন বড় পাথর পাওয়া যায়। এই পাথর দিয়েই দেশে প্রথম পাথরের জাদুঘর তৈরি করেন শিক্ষাবিদ অধ্যাপক নাজমুল হক (জনকণ্ঠ ’৯৭ সালে পাথরের এই জাদুঘরের রিপোর্ট প্রকাশ করে)। নদীর গভীর থেকে পাওয়া গেছে বিশাল একটি নৌকা, যা পর্তুগীজদের ছিল বলে ধারণা করা হয়। তেঁতুলিয়ার মাটির গভীরে আজও ইতিহাস অনুসন্ধান চলছে। তেঁতুলিয়ার নামকরণ নিয়েও আছে গল্প। যারা খাজনা দিতে পারত না তাদের তেঁতুল গাছের গোড়ায় বেঁধে রাখা হতো। কেউ কেউ বলেন, বর্ধমানের মহারানী প্রজাদের কাছ থেকে তেঁতুলের বীজ নিতেন। সে থেকেই নাম হয়েছে তেঁতুলিয়া। মনুষ্য সৃষ্ট গল্পে যাই থাক হিমালয় দুহিতা তেঁতুলিয়া যে ঐশ্বর্য তুলে ধরেছে তা ইতিহাসের নীরব সাক্ষী।
×