ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

সুনামগঞ্জে হাওড় রক্ষা বাঁধ নির্মাণ

কাগজ-কলমে কৃষক ॥ নিয়ন্ত্রণে সিন্ডিকেট

প্রকাশিত: ০৯:৫৬, ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২০

কাগজ-কলমে কৃষক ॥ নিয়ন্ত্রণে সিন্ডিকেট

নিজস্ব সংবাদদাতা, সুনামগঞ্জ, ৯ ফেব্রুয়ারি ॥ নীতিমালায় উল্লেখ রয়েছে বাঁধের নিকটে জমি থাকা ওই ইউনিয়নের কৃষকই প্রকল্পের সভাপতি ও সদস্য সচিব হিসেবে নির্বাচিত হবেন। নীতিমালা রক্ষার জন্য পিআইসি’র সভাপতি ও সদস্য সচিবের নাম কেবল কাগজ-কলমে যুক্ত রয়েছে। শাল্লা উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন ও কাবিটা স্কিম প্রণয়ন কমিটি নিজেদের সিন্ডিকেটের মাধ্যমে পিআইসি গঠন করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এ নিয়ে স্থানীয় কৃষক ও পিআইসিরা ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ, কাজ করানো, পিআইসি সভাপতি ও সদস্য সচিবের সই নিয়ে ব্যাংক থেকে টাকা উত্তোলন, বরাদ্দের টাকা বাড়ানো-কমানো, রদ-বদল সবই ওই সিন্ডিকেটচক্র করছেন। এরাই অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প তৈরি করা, কাজে অনিয়ম কিংবা অসময়ে কাজ শুরুকরণের হোতা। তাদের সহযোগিতা করছেন কিছু অসাধু কর্মকর্তারা। বলছিলেন নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক পিআইসি সভাপতি ও সদস্য সচিব। হাওর রক্ষা বাঁধের কাজ নিয়ে উপজেলার সর্বত্র আলোচনা ও সমালোচনার ঝড় স্থনীয় বাজারের চায়ের কাপে। শুধু তাই নয়, শাল্লা উপজেলায় এ বছর অপ্রয়োজনীয় বাঁধগুলোতে বেশি বেশি বরাদ্দ দেয়ার অভিযোগ উঠেছে উপজেলাজুড়ে। কিন্তু এসব কোন কিছুর তোয়াক্কা করছেন না সিন্ডিকেটচক্র। এই চিত্র সুনামগঞ্জের প্রায় সকল হাওড়ের বাঁধে। জেলায় হাওড়রক্ষা বাঁধের ৭২৫টি প্রকল্প অনুমোদিত হয়েছে। পিআইসি (প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি) গঠন হয়েছে ৭২৫টি। এই প্রকল্পগুলোর কাজ বাস্তবায়নের জন্য ১২৮ কোটি ৮৪ লাখ ৮২ হাজার টাকা বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে। জানা যায়, ১৫ ডিসেম্বর থেকে প্রত্যেক প্রকল্পের কাজ শুরু এবং ২৮ ফেব্রুয়ারি’র মধ্যে কাজ শেষ করার কথা। কিন্তু এখনও কিছু প্রকল্পে কাজই শুরু হয়নি। আবার কোন কোন প্রকল্পে নামেমাত্র কাজ হয়েছে, অকাল বন্যা, পাহাড়ী ঢল বা পানির অপেক্ষা করছেন প্রকল্প সিন্ডিকেটচক্র। কোন কোন বাঁধে মাটি দেয়া হলেও কমপ্লেক্স, ঘাস লাগানো, কলমি লাগানো হয়নি নীতিমালা অনুযায়ী। সরেজমিনে বাঁধের কাজ ঘুরে দেখার সময় জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আব্দুল আহাদও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন পিআইসি’র সভাপতি ও সদস্য সচিবসহ সংশ্লিষ্টদের ওপর। সরেজমিনে দেখা যায়, উপজেলার ছায়ার হাওড়ে উপ-প্রকল্প নং ৯৮এর সাইনবোর্ডে ৪৮০ মিটার জায়গায় ১৫ লাখ ১৩ হাজার ১শ’ ৪৩ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। কাগজ-কলমে দেখানো হলেও বাস্তবে দেখা যায়নি ৪৮০ মিটারের কাজ। এই পিআইসির সামনের দিকে উঁচু কবরস্থান। আর পেছনে সাবমার্সিবল রাস্তা। কবরস্থানের সামনের দিকে ১০/১৫ মিটার ক্লোজার থাকলেও ৪৮০ মিটার প্রাক্কলন ধরে অপ্রয়োজনীয় বাঁধ তৈরি করে ভাগ বাটোয়ারার মাধ্যমে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়ার পাঁয়তারা চলছে। এছাড়াও মনুয়া গ্রাম এলাকায় এই বাঁধ থাকলেও এই গ্রামের কোন ব্যক্তিকে পিআইসির সভাপতি কিংবা সদস্য সচিব করা হয়নি। এই এলাকায় যার কোন জমি নেই তাদেরই পিআইসির সভাপতি ও সদস্য সচিব করা হয়েছে। আর দেখা যায়, বাঁধে সামন্য কিছু জায়গায় মাটি ফেলে দুরমুজ না করেই কাজ শেষের দিকে নিয়ে আসছেন। যে ক্লোজারে মাটি ফেলার কথা সেখানে না ফেলে গত বছরের অক্ষত বাঁধে মাটি ফেলা হয়েছে। এই বাঁধটি অপ্রয়োজনীয় বলে দাবি করছেন স্থানীয় কৃষকরা। উপজেলার ছায়ার হাওড় উপ-প্রকল্পের ৮৫ নম্বর পিআইসি যাদের দিয়ে করা হয়েছে, তারা কেউই কৃষক নয় দাবি করে এই হাওড়পাড়ের সুখলাইন গ্রামের কৃষক মৃদুল দাস জানালেন, ‘এই বাঁধের কাজ করাচ্ছেন একজন অবসরপ্রাপ্ত সরকারী কর্মচারী। বেড়াডহর উপ-প্রকল্পের ৫০ নম্বর পিআইসি সভাপতি আবদুল খালেক উপজেলা কৃষকলীগের প্রভাবশালী নেতা। ১৮৮ মিটার কাজে বরাদ্দ পেয়েছেন সাড়ে ১১ লাখ। নীতিমালার তুয়াক্কা না করেই কাজ করাচ্ছেন খেয়ালখুশিমতো। কমপ্লেক্স, কলমি লাগানো হয়নি এখনও। বাহাড়া ইউনিয়ন থেকে হবিবপুর ইউনিয়নের ভা-ারবিল উপপ্রকল্প ২৭ নং নওয়াগাঁও গ্রামের নিতেশ দাসকে সভাপতি করা হয়েছে। বাহাড়া ইউনিয়ন থেকে কি ভাবে হবিবপুর ইউনিয়নের হাওড় রক্ষা বাঁধের কাজ পায় এ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। স্থানীয় কৃষক বাতেন মিয়া বলেন, এখানে এই পুরো বাঁধের কোন প্রয়োজন ছিল না। যেখানে বাঁধ করার কথা সেখানে মাটি না ফেলে অপ্রয়োজনীয় স্থানে মাটি ফেলা হয়েছে। কবরস্থানের সামনে কিছু জায়গা ভাঙ্গা রয়েছে। এই ভাঙ্গায় মাটি ফেললেই যথেষ্ট। কবরস্থানের পেছনে মাটি ফেলার কোন প্রয়োজন নাই। কবরস্থান ডুবে হাওড়ে পানি প্রবেশ করার কোন সম্ভাবনা নেই। এই প্রকল্পের সভাপতি প্রদ্যুৎ দাসের এই হাওড়ে কোন জমি নেই বলেও তিনি জানান। একই গ্রামের কৃষক লাহেজ মিয়া বলেন, প্রতি বছরই সরকারের লাখ লাখ টাকা ব্যয়ে হাওড়ের বাঁধ দেয়া হয়। এসব বাঁধে যদি তদারকি করে পিআইসি গঠন করা হতো তাহলে অপ্রয়োজনীয় বাঁধগুলোর নামে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়ার কোন সুযোগ পেত না সিন্ডিকেটর। প্রকল্পের সভাপতি প্রদ্যুৎ দাস বলেন, এই হাওড়ে আমার জমি নেই এটা সত্য। তবে উপজেলা কমিটি আমাকে পিআইসি দিয়েছে বিধায় আমি কাজ করছি। এ বিষয়ে উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন ও কাবিটা স্কিম প্রণয়ন কমিটির সদস্য সচিব, শাল্লা উপজেলা শাখা কর্মকর্তা আব্দুল কাইয়ুম বলেন, আমি নতুন আসছি। মাঠ পর্যায়ে তদারকি করছি। এগুলো মূলত আগের প্রকৌশলী মহোদয় দিয়ে গেছেন। সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী (পওর-২) শফিকুল ইসলাম বলেন, অপ্রয়োজনীয় বাঁধ চিহ্নিত করার জন্য পুনরায় তদন্ত করে প্রতিবেদন দেয়ার জন্য উপজেলা এলজিইডির প্রকৌশলী দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। প্রতিবেদন আসলে বোঝা যাবে কোনটি অপ্রয়োজনীয় বাঁধ। নামে একজন, কাজ করাচ্ছে অন্যজন এমন একটি অভিযোগ গণমাধ্যমকর্মীর মাধ্যমেই জানতে পারি। এই বিষয়ে সকলকে সচেতন হতে হবে। কোন সমস্যা হলে দায় কিন্তু যার কাগজে নাম আছে, তাকেই নিতে হবে। ভবিষ্যতে উপজেলা কমিটিগুলোকে এসব বিষয়ে সতর্ক করে দেয়া হবে। জেলা স্থানীয় সরকার বিভাগের উপ-পরিচালক কাবিটা স্কিম প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন কমিটির অভিযোগ নিষ্পত্তিকারী কর্মকর্তা মোহাম্মদ এমরান হোসেন বলেন, প্রত্যন্ত উপজেলায় প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি গঠনের জন্য জেলা হাওড়রক্ষা বাঁধ বাস্তবায়ন কমিটির দায়িত্বশীলদের যাওয়া সম্ভব ছিল না। উপজেলা থেকে প্রস্তাব পাঠানোর সময় প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটিতে কাদের কাদের নাম আসছে, সেই ব্যাপারে উপজেলা কমিটিকে আরও আন্তরিকভাবে যাচাই করা প্রয়োজন ছিল।
×