ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ফাইনালে ভারতের বিরুদ্ধে বোলাদের দাপটেই মঞ্চ তৈরি হয়েছিল উৎসবের

অভিষেক, শরিফুল ও সাকিবের দুর্দান্ত বোলিং

প্রকাশিত: ০৯:৪৫, ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২০

অভিষেক, শরিফুল ও সাকিবের দুর্দান্ত বোলিং

মোঃ মামুন রশীদ ॥ প্রথমবার অনুর্ধ-১৯ বিশ্বকাপের ফাইনাল। সে কারণেই হয়তো রক্ষণাত্মক কৌশল বেছে নেন বাংলাদেশ অনুর্ধ-১৯ দলের অধিনায়ক আকবর আলী। টস জিতেও ভারত অনুর্ধ-১৯ দলকে ব্যাটিংয়ে পাঠান তিনি। ক্রিকেট বিশ্লেষকরা বলছিলেন, পচেফস্ট্রুমের এমন উইকেটে টস জিতে ফাইনালের মতো স্নায়ুচাপের ম্যাচে আগে ব্যাটিং করাটাই শ্রেয়। তবে দক্ষিণ আফ্রিকায় এবারের যুব বিশ্বকাপে ভারত যে কয়েকটি ম্যাচে পরে ব্যাটিং করেছে প্রতিপক্ষ দলকে স্বাচ্ছন্দ্যেই হারিয়ে দিয়েছে। তবে কোয়ার্টার ফাইনালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে আগে ব্যাট করে দারুণ প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জিততে হয়েছে ভারতীয়দের। এসব ভেবেই হয়তো আকবর টস জিতেও ফিল্ডিং নিয়েছেন, তবে আগেরদিন বৃষ্টিতে আবহাওয়াতে যে আর্দ্রতা ছিল তা কাজে লাগাতেও চেয়েছেন তিনি। সতীর্থ পেসারদের ওপর ভরসাও ছিল তার। অধিনায়কের আস্থা পূরণ করেছেন বাংলাদেশের তিন পেসার অভিষেক দাস, শরীফুল ইসলাম ও তানজিম হাসান সাকিব। এ পেসত্রয়ী ৭ উইকেট তুলে নিয়েছেন এবং রান দেয়ার ক্ষেত্রে ছিলেন দারুণ মিতব্যয়ী। অভিষেক ৩টি এবং শরীফুল ও সাকিব ২টি করে উইকেট তুলে নেন। তাদের ভয়ানক বোলিংয়ে শেষ ২১ রানে ৭ উইকেট হারিয়ে শক্তিশালী ভারত প্রথম ব্যাট করে মাত্র ১৭৭ রানেই গুটিয়ে যায়। এবারের বিশ্বকাপে আগের ম্যাচগুলো খেলার সুযোগ হয়নি অভিষেক দাসের। ব্যাডমিন্টনে তিনবার জুনিয়র পর্যায়ে জেলা চ্যাম্পিয়ন হলেও মাশরাফি বিন মর্তুজাকে দেখে ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন নড়াইলের এ তরুণ। গ্রুপপর্বে পাকিস্তানের বিপক্ষে একাদশে সুযোগ মিললেও বোলিংয়ের সুযোগ হয়নি ম্যাচটি বৃষ্টিতে পরিত্যক্ত হওয়ায়। সেই ম্যাচে ব্যাট হাতে ২০ রান করেছিলেন। পরবর্তী ম্যাচ খেলার জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছে ফাইনাল পর্যন্ত। কারণ মাঝে দক্ষিণ আফ্রিকা ও নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচ থাকার কারণে মূলত স্পিননির্ভর একাদশ গড়েছিল বাংলাদেশের যুবারা। ফাইনালে প্রতিপক্ষ ভারত এবং আগেরদিন প্রচুর বৃষ্টি হওয়াতে স্পিনার হাসান মুরাদকে বাদ দিয়ে ডানহাতি পেসার অভিষেককে একাদশে নেয়া হয়। টুর্নামেন্টের মাঝপথে নির্ভরযোগ্য পেসার মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরী ইনজুরিতে পড়ার কারণেই ফাইনালের মতো গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে সুযোগ পেয়েছেন। আর সেই সুযোগটা কাজেও লাগিয়েছেন তিনি। যুব বিশ্বকাপে প্রথমবার বোলিংয়ের সুযোগ পেয়েই জ্বলে ওঠেন ১৮ বছর বয়সী অভিষেক। ৬ ফুট উচ্চতার এ ডানহাতি ভারতীয় ইনিংসের সপ্তম ওভারে প্রথম বল হাতে নেন। তখন রান করতে গিয়ে রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছিলেন এবারের আসরে সর্বাধিক রান করা ভারতীয় ওপেনার যশস্বী যশওয়াল ও অন্যতম রান সংগ্রাহক দিব্যনাশ সাক্সেনা। প্রথম ওভারেই এসে আঘাত হানেন অভিষেক। সাজঘরে ফিরিয়ে দেন সাক্সেনাকে (২)। প্রথম সাফল্য দলকে এনে দিলেও শরীফুল ও সাকিবের মতো মিতব্যয়িতা দেখাতে পারেননি অভিষেক। টানা ৪ ওভার বোলিং করে ১৮ রান দিয়ে প্রথম স্পেল শেষ করেন অভিষেক ১ উইকেট নিয়ে। পরে ২৩তম ওভারে এসে টানা দুই ওভারে আর মাত্র ৯ রান দিলেও কোন উইকেটের দেখা পাননি। ৩৯তম ওভারে আবার ফিরে টানা ২ ওভার বোলিং করে তিনি ১১ রান দিয়েছেন। তবে মূল আঘাতটা হেনেছেন ৪৫তম ওভারে এসে। তখন রান তোলার জন্য ছটফট করছিল ভারতীয় ব্যাটসম্যানরা। সেই সুযোগটা নিয়েই ওই ওভারে জোড়া আঘাত হানেন অভিষেক। সেই ওভারে মাত্র ২ রান দিয়ে তুলে নেন অথর্ব এ্যাঙ্কোলেকারকে (৩) বোল্ড ও কার্তিক ত্যাগিকে (০) উইকেটের পেছনে ক্যাচে পরিণত করে। ৯ ওভারে ৪০ রান দিয়ে ৩ উইকেট নিয়ে শেষ হয় অভিষেকের স্পেল। কারণ ভারতীয় দল আগেই অলআউট হয়ে গেছে। অভিষেকের এটিই যুব ওয়ানডেতে ক্যারিয়ারসেরা বোলিং নৈপুণ্য। মাত্র ১১ যুব ওয়ানডে খেলেছেন তিনি, সবমিলিয়ে উইকেট এখন ১৫টি। সুযোগটা পেয়েই স্বপ্নের ফাইনালে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করেছেন অভিষেক। তবে তার এই সাফল্যের মঞ্চটা প্রস্তুত করে দিয়েছিলেন তারচেয়ে লম্বায় ৩ ইঞ্চি বড় বাঁহাতি পেসার শরীফুল এবং আরেক ডানহাতি পেসার সাকিব। এ দু’জন পেসার প্রথম থেকেই রীতিমতো আতঙ্ক ছড়িয়েছেন ভারতীয় ব্যাটিং লাইনআপে। দুর্দান্ত বোলিং করেন তারা ইনিংসের শুরুতে মাঠের আর্দ্রতা কাজে লাগিয়ে। ফাইনালের মতো ম্যাচে টস জিতে আগে বোলিং নেয়া নিয়ে যে আলোচনা চলছিল তা ঢাকা পড়ে যায় এ দু’জনের মিতব্যয়ী ও ভয়ঙ্কর বোলিংয়ে। টানা দুই ওভার মেডেন দেন তারা দু’জনে। তাদের গতি আর সুইংয়ে বিপর্যস্ত ছিলেন ভারতের সফলতম দুই ব্যাটসম্যান যশওয়াল ও সাক্সেনা। শরীফুল ও সাকিবের সঙ্গে তাদের তর্কও বেধে যায় এবং আম্পায়ারকে মধ্যস্থতা করতে হয়েছে। এতে যেন ফাইনালের উত্তেজনা বেড়ে যায় আরও। প্রথম ৬ ওভারে ভারতের স্কোরবোর্ডে মাত্র ৮ রান জমা হয়। অধিনায়ক আকবর পেসনির্ভর একাদশ গড়েছিলেন এমন আশাতেই। সাকিব ৩ ওভারে ২ মেডেনসহ মাত্র ১ রান আর পঞ্চগড়ের কৃষক সন্তান শরীফুল ৩ ওভারে ১ মেডেনে ৭ রান দেন। সপ্তম ওভারে আর শরীফুল বোলিং করতে পারেননি হাল্কা চোট নিয়ে মাঠ ছেড়ে আসায়। দলের অন্যতম স্ট্রাইক বোলার শরীফুল এত আগেভাগে মাঠ ছেড়ে যাওয়ার কারণে বাংলাদেশ দলের তাঁবুতে দুঃশ্চিন্তা তৈরি হয়েছিল। কিন্তু অভিষেক সেই শঙ্কা কাটিয়েছেন। অপরপ্রান্তে সাকিব বোলিং করে গেছেন দুর্দান্তভাবে। অষ্টম ওভারে ক্লান্ত সাকিবের বলে প্রথম চারের দেখা পায় ভারতীয় দল যশওয়ালের ব্যাট থেকে। এরপরও প্রথম ১০ ওভারে মাত্র ২৩ রান করতে পেরেছে তারা। টানা ৫ ওভার বোলিং করা সাকিব ২ মেডেনে ৯ রান দিয়ে বিশ্রামে যান। ইনিংসের ১৯তম ওভারে বোলিংয়ে ফিরেছেন শরীফুল। টানা ২ ওভারে তিনি ৫ রানের আগের মিতব্যয়িতা ধরে রেখে মাত্র ৫ রান দিলেও সাফল্য পাননি। উইকেটের সাফল্য পেতে শরীফুল ও সাকিবকে অপেক্ষা করতে হয়েছে ২৯তম ওভার পর্যন্ত। বোলিংয়ে ফিরেই তিলক ভার্মাকে (৩৮) সাজঘরে ফিরিয়ে ৯৪ রানের দীর্ঘ দ্বিতীয় উইকেট জুটিতে ভাঙ্গন ধরান সাকিব। তার সেই সাফল্যে উজ্জীবিত হয়ে রাকিবুল হাসান দ্রুতই ফিরিয়ে দেন ভারতীয় অধিনায়ক প্রিয়াম গর্গকে (৭)। তবে অর্ধশতক হাঁকিয়ে ক্রমেই সেঞ্চুরির দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন যশওয়াল। ৩৮তম ওভারে শরীফুল এসে চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু ৬ রান দেন সেই ওভারে। নিজের সপ্তম ওভারে প্রথম চার হজম করেন তিনি ৪০তম ওভারে এসে। যশওয়ালের সঙ্গে ইনিংসের শুরু থেকেই শরীফুলের স্নায়বিক লড়াই চলছিল, তার কাছ্ইে বাউন্ডারি হজম করেন। তবে পরের বলেই প্রতিশোধ নেন তিনি ৮৮ রান করা যশওয়ালকে শিকার করে। প্রথম সাফল্য পান শরীফুল। পরের বলেই আবার সিদ্ধেশ ভীরকে (০) এলবিডব্লিউ করে হ্যাটট্রিকের সুযোগ পেয়েছিলেন, তবে তা কাজে লাগাতে পারেননি। শেষ পর্যন্ত ১০ ওভারে ১ মেডেনে ৩১ রান দিয়ে ২ উইকেট নেন শরীফুল। আর সাকিব তার দ্বিতীয় সাফল্য পান ইনিংসের ৪৮তম ওভারে সুশান্ত মিশ্রকে তুলে নিয়ে। এর মাধ্যমে ১৭৭ রানে গুটিয়ে যায় ভারতীয় যুবাদের ইনিংস। সাকিব ৮.২ ওভারে ২ মেডেনে ২৮ রান দিয়ে ২ উইকেট নেন সাকিব। অভিষেক, শরীফুল ও সাকিবের পেস তান্ডবের সামনে পচেফস্ট্রুমে এমনই অসহায় ছিল ভারতীয় যুবারা।
×