ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মোঃ সাখাওয়াত হোসেন

সন্ত্রাসবাদের নেপথ্য নিয়ামক

প্রকাশিত: ০৭:৫৬, ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২০

 সন্ত্রাসবাদের নেপথ্য নিয়ামক

সন্ত্রাসবাদ নিয়ন্ত্রণ, মূলোৎপাটন ও এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার পূর্বে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ কিছু নির্দেশক নিয়ে কাজ করা প্রয়োজন। যে নির্দেশকগুলো সন্ত্রাসবাদের গোড়াপত্তন নিয়ে তথা সন্ত্রাসবাদের বিষবাষ্প সম্বন্ধে সম্যক ধারণার পাশাপাশি সমাধানকল্পে আশু পদক্ষেপের বিষয়েও জানান দিয়ে থাকে। সন্ত্রাসবাদ গবেষণায় বিশেষজ্ঞরা মনে করেন সাধারণত তিনটি প্রশ্নের মাধ্যমে সামগ্রিক বিষয়গুলোকে তুলে নিয়ে আসা সম্ভবপর হবে। প্রথমত কোন পেশা-শ্রেণীর মানুষ সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে সম্পৃক্ত হচ্ছে? দ্বিতীয়ত সন্ত্রাসবাদের অনুঘটক হিসেবে কোন বিষয়গুলো কাজ করে? তৃতীয়ত সন্ত্রাসীরা কিভাবে বিভিন্ন মতাদর্শে পরিপুষ্ট হয়ে সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে সম্পৃক্ত হয়? এ তিনটি নির্দেশককে যদি যথাযথ প্রক্রিয়ায় চিহ্নিত করে ব্যবস্থা গ্রহণসাপেক্ষে পদক্ষেপ নেয়া যায় তাহলে সন্ত্রাসবাদ কখনই ভয়াবহ আকার ধারণ করবে না এবং পর্যায়ক্রমে সন্ত্রাসবাদের ঘটনাও শূন্যের কোটায় নেমে আসবে। খোলা চোখে যদি আমরা দেখি তাহলে দেখা যাবে উল্লিখিত বিষয়ের বাইরে খুব বেশি নিয়ামক নেই যার ওপর ভিত্তি করে একদল মানুষ সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে যুক্ত হবে। যদিও এটি খুব সহজ কাজ নয়। সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে সম্পৃক্ত গবেষকগণ মতামত প্রদান করেছেন সুনির্দিষ্ট কোন আচরণের চরিত্রায়ন দিয়ে সন্ত্রাসবাদের প্রবৃত্তিকে চিহ্নিত করা সম্ভব নয়। এমনও দেখা যায় দীর্ঘদিন ধরে বিকারগ্রস্ত মানুষ সন্ত্রাসবাদে সম্পৃক্ত হচ্ছে না, আবার কেউ কেউ সুস্থ স্বাভাবিক জীবনযাপন করেও সন্ত্রাসবাদে সম্পৃক্ত হচ্ছে। যাহোক শিশুকালে অপ্রবৃত্তি আচরণে আদিষ্ট ভবিষ্যতে সন্ত্রাসবাদে আদিষ্ট হবে না এমন যেমন বলা যায় আবার বিপরীতভাবেও বলা যায় শিশুকালে বিকৃতি রুচিসম্পন্নরা সন্ত্রাসবাদে সম্পৃৃক্ত হবে। সন্ত্রাসবাদ কার্যক্রম যেমন বোমা হামলা, গুলি করা, অপহরণ করা ইত্যাদি রাজনৈতিক চরিতার্থ সম্পন্ন করার জন্য হয়ে থাকে যেখানে একটি পক্ষকে জিম্মি করে বৃহৎ স্বার্থ উদ্ধার করা হয়ে থাকে। সন্ত্রাসবাদে উদ্বুদ্ধ করার জন্য নিম্নোক্ত অনুপ্রাণনগুলো প্রভাবক হিসেবে কাজ করে থাকে। সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ায় একজন মানুষ সমাজে প্রকৃত মানুষ হিসেবে নিজেকে যেমনভাবে তৈরি করতে পারেন ঠিক তেমনিভাবে সমাজ ব্যবস্থায় ত্রুটি-বিচ্যুতির কারণে পথভ্রষ্ট হয়ে নানাবিধ অপরাধ কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়ে। ব্যক্তির মধ্যে যখন বিরহ এবং বিচ্ছিন্নতা বিশ্বাসযোগ্য হিসেবে আবির্ভূত হয় সে অবস্থায় ব্যক্তি সন্ত্রাসবাদের মতো যে কোন ধরনের গর্হিত কাজ করতে দ্বিধাবোধ করে না। গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে সন্ত্রাসীরা দরিদ্র শ্রেণীর নয় এবং তাদের শিক্ষাগত যোগ্যতাও কম নয়। আক্ষরিক অর্থে বলতে হয় অনেক সন্ত্রাসী উঁচু শ্রেণীর এবং শিক্ষিত। ওসামা বিন লাদেন যখন জিহাদে অংশগ্রহণ করেন তখন তিনি একজন বিলিয়োনিয়ার এবং তার কিছু সংখ্যক অনুসারী উচ্চ শিক্ষিত ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ছিল। বর্তমানকালের সন্ত্রাসীরা ইন্টারনেট ব্যবহার করে সন্ত্রাসী কার্যক্রম পরিচালনা করে, তাদের অভিযানগুলো দুর্দান্ত এবং ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণও বেশি। সন্ত্রাসীদের রয়েছে নিজস্ব লেখালেখি, তত্ত্ব এবং প্রচারপত্র, যেগুলো সমাজের উঁচু শ্রেণীর মানুষদের টার্গেট ধরে প্রচারপত্র বিলি করা হয়, গরিব এবং শোষিতদের জন্য প্রচারপত্র বিলি করা হয় না। মার্ক স্যাগমেন এক্ট্রিমিস্ট ইসলামিস্ট গ্রুপের উপর গবেষণা করে তিনি দেখেন যে, তাদের অধিকাংশ শিক্ষিত, তার মধ্যে শতকরা ৬০ শতাংশ উচ্চ শিক্ষিত। শতকরা ৭৫ শতাংশের ওপরে আসে উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে। যখন তারা সন্ত্রাসী সংগঠনে আসে তাদের অধিকাংশই পেশাগত চরিত্রের (যেমন, ডাক্তার ও প্রকৌশলী) অধিকারী হয়ে থাকে অথবা কম অভিজ্ঞ (যেমন : সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারী), ২৫ শতাংশ বেকার ও কম মর্যাদাসম্পন্ন কাজ করে থাকে। স্যাগমেন আরও দেখান, তাদের মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশ বিবাহিত এবং তাদের ঘরে সন্তান রয়েছে। সুতরাং বলা যায়, উন্মত্ততা, দারিদ্র্য, শিক্ষার অভাব, অজ্ঞতার কারণে কখনও কেউ সন্ত্রাসবাদে সম্পৃক্ত হয় না। স্যাগমেন আরও দেখেছেন, ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদে সম্পৃক্তদের সামাজিক বন্ধন ও সামাজিক নেটওয়ার্ক সুবিস্তৃত ও সুদৃঢ় থাকে। যখন তারা সমাজের অন্য অংশ থেকে যে কোন কারণে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে ঠিক তখনই পারিবারিক বন্ধন ও বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশ সন্ত্রাসবাদে উদ্বুদ্ধ করে থাকে। তিনি তার গবেষণায় আরও দেখান যে, জিহাদীরা সাধারণত বিদেশে বসবাসরত অবস্থায় সন্ত্রাসী দলের সঙ্গে যুক্ত হয়। বিদেশ থেকে যারা স্বদেশে ফেরত আসতে চায়, সেক্ষেত্রে তারা তাদের মতো জনগোষ্ঠীর অনুসন্ধান করে এবং ক্ষেত্রবিশেষে উপাসনালয়ে পেয়ে যায়। ধর্মীয় আবেগে যখন তারা প্রভাবিত হয়ে থাকে, ঠিক তখনই বিদেশের মাটিতে সমমনা মানুষের অনুসন্ধান করে থাকে এবং পরিচয়ের সূত্র ধরে পাশাপাশি ফ্ল্যাটে কিংবা একই ফ্ল্যাটে বসবাস করে, একই সঙ্গে খাবার দাবার খায় এবং ব্যক্তিগত পারস্পরিক বিষয়াদি শেয়ার করে থাকে। ওই গ্রুপের কেউ যদি সন্ত্রাসবাদে সম্পৃক্ত হয় তাহলে বাকিরাও তাকে অনুসরণ করে সন্ত্রাসবাদে সম্পৃক্ত হয়। মনোবৃত্তিক ভিউ : সকল সন্ত্রাসী মনোজাগতিক ঘাটতিতে থাকে না। তবে যারা সন্ত্রাসী তাদের অধিকাংশের মধ্যে প্রচন্ড আবেগী মানসিকতার (নানাবিধ ফ্যাক্টরের জন্য হয়ে থাকে) কারণে ভায়োলেন্ট গ্রুপের সঙ্গে সংযোগ ঘটে যায়। মনোজাগতিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রেক্ষিতে বলা যায়, সন্ত্রাসবাদ যতটা রাজনৈতিক কারণে সংঘটিত হয়ে থাকে, তার থেকেও বেশি মনোজাগতিক ঘাটতির কারণে সংঘটিত হয়ে থাকে। তবে একজন সন্ত্রাসবাদ বিশেষজ্ঞ জেরোল্ড এম পস্ট বলেন : মনোজাগতিক প্রবৃত্তিকে নিবৃত করার জন্য রাজনৈতিক সন্ত্রাসীরা সহিংস অপরাধের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয় এবং নিজের সঙ্গে হিসাব-নিকাশ (মনোবৃত্তিক চরিতার্থ) করে সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের দিকে নিজেকে ধাবিত করে থাকে। তবে মনোজাগতিক ঘাটতি থাকার জন্য কেউ সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে সম্পৃক্ত হয় এমন বিষয়াদি গবেষণায় খুব কমই এসেছে। বিশেষ করে সুইসাইড বোম্ব সন্ত্রাসীর ক্ষেত্রে দেখা যায়, তাদের মধ্যে মনোবৃত্তিক সমস্যা থাকায় কিছু মানসিক সমস্যা দেখা যায়, হতাশায় ভোগে এবং তারা তাদের নিজের জীবন পথপরিক্রমা নিজেদের মতো বেছে নেয়। মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ রেন্ডি বোরামের মতামত অনুযায়ী, সন্ত্রাসবাদ বর্ণনায় মানসিক সমস্যা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে চিহ্নিত করা যায় না। কেননা সকল সন্ত্রাসীই মানসিক রোগী নয়। সন্ত্রাসীদের জীবনবৃত্তান্তে শিশুকালে নানাভাবে নির্যাতনের শিকার ও বিচারহীনতার বিষয় উঠে এলেও মানসিক বৈকল্যকে সন্ত্রাসবাদ ব্যাখ্যায় বিবেচনায় নেয়া যাবে না। চার্লস রুবি সন্ত্রাসীদের মানসিক পরিস্থিতি নিয়ে গবেষণা করে দেখতে পান যে, মানসিক বৈকল্য (খুব কম সংখ্যক) সন্ত্রাসবাদের নেপথ্য কারিগর হিসেবে কাজ করে। সন্ত্রাসবাদ বিষয়ে গবেষণা করে অভিজ্ঞরা বলছেন, অর্থনৈতিক সুবিধার অপ্রতুলতা ও অর্থনৈতিক মন্দাবস্থা সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে নানাভাবে সম্পর্কিত। যুবক বয়সের মহিলা ও পুরুষরা সাধারণত রাজনৈতিক এবং সামাজিক ফ্রন্টলাইন থেকে দূরে থাকায় সন্ত্রাসবাদে জড়িয়ে পড়ে। বিচ্ছিন্নতা ভর করায় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিভিত্তিক প্রতিযোগিতামূলক সমাজ ব্যবস্থা থেকে অনেকাংশে পিছিয়ে পড়ে। আধুনিক সমাজ থেকে যারা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে তারা বিশ্বাস করে আত্মহত্যা প্রবণতা (সুইসাইড বোম্বিং) তাদের দুর্নীতিগ্রস্ত আধুনিক বিশ্ব থেকে দূরে রাখতে পারে। এই মতবাদের মাধ্যমে জানা যায়, বন্ধু, পরিবার এবং সমাজ থেকে যখন কেউ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় তখন তাদের মধ্যে মানসিক অবসাদ বাসা বাঁধে। অনেকেই তাদের বিপরীত পক্ষের বিরুদ্ধে তাদের জোরালো প্রতিবাদলিপি গ্রোথিত করে, কেননা তারা মনে করে বিপরীত পক্ষ কর্তৃক তারা নানাভাবে নির্যাতিত এবং বঞ্চিত হচ্ছে। পাশাপাশি সমাজ এবং রাষ্ট্রের শোষকদের কর্তৃক নির্যাতিত হয়ে থাকে। বিভিন্ন রিপোর্ট থেকে আরও জানা যায়, অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিকভাবে যখন কোন যুবক দুর্বল এবং অকার্যকর হয়ে পড়ে, তখন তারা তাদের পরিবার বিশেষ করে বাবা কর্তৃক নিগ্রহের শিকার হয়ে থাকে। পরিবারের মধ্যে বিচ্ছিন্নতা, বাবার অনুপস্থিতি, যদিও বাবা পরিবারে থাকেন তথাপি কোন ভূমিকা না থাকায় ওই সব পরিবারের ছেলেমেয়েরা বিষণন্নতায় ভোগে। ওই সব পরিবারের ছেলেমেয়েরা সহজেই সন্ত্রাসী সংগঠন ও কর্মকা-ের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে এবং সেখানে ক্যারিশম্যাটিক লিডারের সন্ধান পায়, যারা বাবার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে থাকে। কাজেই বোঝা যাচ্ছে, পরিবার, বন্ধুমহল এবং সমাজ থেকে বিচ্ছিন্নরা হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে সন্ত্রাসবাদে সম্পৃক্ত হয়ে পড়ে। অন্য একটি দৃষ্টিভঙ্গি যেখানে মতাদর্শ প্রাধান্য পায়, সেখানে প্রাধান্য দেবার ক্ষেত্রে চরম মাত্রায় মতাদর্শে দীক্ষিত হয় এবং চরম মাত্রা অবশ্যই নেতিবাচক অর্থে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। তারা বিশ্বাস করে সরকার এবং তথাকথিত কিছু গ্রুপের দ্বারা তারা বিভিন্নভাবে শোষণের শিকার। তারা আরও মনে করে থাকে অবস্থার পরিবর্তন হতে পারে সরকারের সংস্কারের মাধ্যমে। কিন্তু সেটা হচ্ছে না কিংবা হবে না। তাই তারা নিজেরাই প্রচলিত সিস্টেমকে পরিবর্তনের জন্য সহিংস আচরণের দিকে ধাবিত হয়ে সন্ত্রাসবাদে জড়িয়ে পড়ে। সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যকে সামনে রেখে সন্ত্রাসীরা তাদের ছক সাজায়, যার প্রেক্ষিতে সরকার তাদের সঙ্গে আলোচনায় বসতে বাধ্য হয় কিংবা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায় এবং দেশী-বিদেশীদের যোগসাজশে মধ্যস্থতায় বসে দু’পক্ষ। ফলে সন্ত্রাসীরা সরকারের পক্ষ থেকে নানা ধরনের ফায়দা লোটার চেষ্টা করে। কাজেই বলা যাচ্ছে, সমাজ বিচ্ছিন্নতা, সামাজিকীকরণ, মনোবৃত্তিক বাসনা ও মতাদর্শ ইত্যাদি নিয়ামকগুলো সন্ত্রাসবাদের অন্যতম প্রধান অনুঘটক হিসেবে কাজ করে। উপরোল্লিখিত আলোচনায় সন্ত্রাসবাদের নেপথ্য নিয়ামক হিসেবে বেশ কিছু অনুঘটককে চিহ্নিত করা হয়েছে। সুতরাং সন্ত্রাসবাদকে চিরতরে বাংলাদেশ থেকে বিতারণের স্বার্থে যথেষ্ট কাজ করার সুযোগ রয়েছে। বিশেষ করে সমাজ ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানো উচিত। সমাজের প্রচলিত রীতি নীতি, আচারাদি, মূল্যবোধ, উৎসব, পার্বণ ইত্যাদির সঙ্গে সঠিকভাবে নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের পরিচয়ের সঙ্গে সঙ্গে বাঙালী সংস্কৃতি ও সভ্যতার চর্চাকে প্রত্যেকের মননে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে, যার প্রেক্ষিতে দেশপ্রেমের দ্যোতনায় উজ্জীবিত হয়ে সকল ধরনের সহিংস ও সমাজবিরোধী কর্মকান্ড থেকে সকলেই নিবৃত থাকে। পাশাপাশি পরিবারকে সন্তান লালন পালনের সকল দায়ভার বহন করে সুনাগরিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে, কেননা পরিবারই শিশুর সর্বশ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ। বর্তমান সমাজে দেখা যায় বাবা-মায়ের সঙ্গে সন্তানদের একটি অঘোষিত দূরত্ব রয়েছে যার কারণে সন্তানের সার্বিক বিষয়ে খোঁজখবর রাখা সম্ভব হয়ে ওঠে না। ব্রোকেন ফ্যামিলি, বাবা-মায়ের মধ্যকার দূরত্ব, বাবা-মায়ের সঙ্গে ছেলেমেয়েদের দূরত্ব ইত্যাদি কারণে কিশোর-কিশোরীরা ডেলিনকোয়েন্ট আচরণ প্রদর্শন করে। পরবর্তীতে সেটি সহিংস আচরণের দিকে ধাবিত হয়। কাজেই প্রত্যেক পরিবারকেই সার্বিক বিষয়ে দায়িত্ব নিতে হবে তাদের সন্তানের কথা ভেবে, সমাজের কথা ভেবে, রাষ্ট্রের কথা ভেবে। পরিবারের পাশাপাশি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে সন্ত্রাসবাদের অনুঘটকগুলোকে উপশম করার জন্য। উক্ত দুটি প্রতিষ্ঠানই শিক্ষার্থীদের প্রকৃত মানবিক, দায়িত্বশীল ও নৈতিক মানুষ হিসেবে গড়ে তোলে। উঠতি বয়সী ছেলেমেয়েদের সহিংস কর্মকান্ডে সংযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যর্থতাকেই সামনে নিয়ে আসে। শিক্ষকদের সামনে শিক্ষার্থীদের নানা অপকর্মে যুক্ত হতে দেখা যায়। শিক্ষকগণকে শুধু শ্রেণীকক্ষে পাঠদানে সীমাবদ্ধ না থেকে শিক্ষার্থীবান্ধব হয়ে শিক্ষার্থীদের স্বাভাবিক ও সুস্থভাবে বেড়ে ওঠার সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টি করে সুস্থ স্বাভাবিক বাংলাদেশ গড়ার নিয়ামক হিসেবে কাজ করা উচিত। সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোও কিশোর- কিশোরীদের মনোবৃত্তিক চেতনাকে ইতিবাচক হিসেবে গড়ে তুলতে বিশেষ ভূমিকা নিতে পারে, যার ফলে তাদের মধ্য থেকে হতাশা দূর হবে, সঠিক চিন্তা-চেতনা করার বীজ বপন করা হবে, দেশমাতার টানে প্রকৃত দায়িত্বশীল হিসেবে ভূমিকা নিতে অনুপ্রাণিত হবে। অন্যদিকে যদি দৃষ্টি দেয়া যায় তাহলে দেখা যাবে, সন্ত্রাসবাদ এবং জঙ্গীবাদের সঙ্গে যতগুলো দল কিংবা সংগঠনের অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে, তাদের অনতিবিলম্বে নিষিদ্ধ করতে হবে এবং সংগঠনের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। ভিন্নভাবে বলতে গেলে, সন্ত্রাসী কার্যক্রম পরিচালনায় নানাবিধ যন্ত্রাংশ প্রদানকারী ও বিক্রিকারী প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন। জিহাদী সংগঠনের যে চক্র বিশ্বব্যাপী রয়েছে, সে চক্রের বিনাশকল্পে বিরামহীনভাবে কাজ করে যেতে হবে। আর এ জন্য আন্তর্জাতিকভাবে সন্ত্রাসী সংগঠনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণাকারী প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনের সঙ্গে সম্মিলিতভাবে কাজ করে যেতে হবে বাংলাদেশকে। পাশাপাশি সন্ত্রাসী সংগঠনের ব্যয় পরিচালনার জন্য যে বা যারা অর্থ সাহায্য প্রদান করে বিভিন্ন অজুহাতে তাদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ সন্ত্রাসবাদের বিষবাষ্পকে বহুলাংশে কমিয়ে আনতে পারে। লেখক : প্রভাষক, ক্রিমিনোলজি এ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
×