ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

স্বরূপে ফিরছে সিরাজগঞ্জের ইলিয়ট ব্রিজ

প্রকাশিত: ০৭:৩১, ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২০

স্বরূপে ফিরছে সিরাজগঞ্জের ইলিয়ট ব্রিজ

বাবু ইসলাম, সিরাজগঞ্জ ॥ অবারিত জলরাশি/সকলের মুখে হাসি, নদী বহে নিরবধি/দু’কূল ছাপিয়ে ওঠে ঢেউ..... বড়পুলের নিচেই বড়াল নদী। কাটাখালি নিয়ে প্রত্যাশা খুব যে বেশি তা কিন্তু না। তবে সিরাজগঞ্জে কাটাখালির আপন ঐতিহ্যের নৈবদ্য নাগরিক সভ্যতায় নতুনভাবে অভ্যুদয় হবে এমন আকাক্সক্ষা স্পর্ধা হিসেবে চিহ্নিত হলেও এটাই বাস্তবতা। জেগেছে নতুন প্রজন্ম। কাকের চোখের মতো স্বচ্ছ পানিতে তাদের অবয়ব প্রতিবিম্বিত হবে। আমরা আশাবাদী। সিরাজগঞ্জ শহরের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত বড়াল নদী যা কাটাখাল নামে পরিচিত সেটি পুনর্খনন কাজ শুরু হয়েছে। ছোট নদী, খাল ও জলাশয় পুনর্খনন প্রকল্পের আওতায় পানি উন্নয়ন বিভাগ কাটাখালি পুনর্খনন কাজ করছে। ঢাকার হাতিরঝিল প্রকল্পের আদলে এই কাটাখাল সংস্কার করার উদ্যোগ নিয়েছিল সিরাজগঞ্জ পৌরসভা। কাটাখাল খনন করে এর চারপাশে নানা স্থাপনা নির্মাণসহ সৌন্দর্য বৃদ্ধি করার একটি প্রকল্প তৈরি করা হয়েছিল। সেই প্রকল্পের টেন্ডার করে কাজও শুরু করা হয়েছিল। খনন কাজে চার কোটি টাকা খরচ করার পর মাঝপথে এ প্রকল্পের মাটি খনন কাজ থেমে যায়। এ কারণে শহরবাসীর প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। হাতিরঝিলের স্বপ্ন, আঁতুড়ঘরেই অপমৃত্যু হয়েছে বলে গুঞ্জন ওঠে। পরে এ প্রকল্প পুনরুজ্জীবিত করার লক্ষ্যে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীনে ৬৪ জেলার ছোট নদী, খাল ও জলাশয় পুনর্খনন প্রকল্পে অন্তর্ভুক্ত করে ২২ কি.মি. কাটাখাল খনন কাজ শুরু করা হয়। যমুনা নদীর উৎসমুখ সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার বাঐতারা থেকে শহরের মিরপুর, বাজার স্টেশন, রেলওয়ে কলোনি হয়ে সিরাজগঞ্জ সরকারী কলেজের পাশ দিয়ে জানপুর, বাহিরগোলা এবং চন্দ্রকোণা হয়ে তা কালিঞ্জার ভেতর দিয়ে ইছামতি নদী পর্যন্ত ২২ কি.মি. খাল খননে ব্যয় বরাদ্দ ধরা হয়েছে ১৫ কোটি টাকা। কাজের শতকরা ৩০ ভাগ অগ্রগতি হয়েছে এবং চলতি অর্থবছরের জুন নাগাদ তা শেষ হবে বলে পানি উন্নয়ন বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী শফিকুল ইসলাম জানিয়েছেন। সম্প্রতি এই কাটাখালের খনন কাজের উদ্বোধন করেন পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব কবির বিন আনোয়ার। সিরাজগঞ্জ শহরের মাঝখান দিয়ে বয়ে যাওয়া কাটাখালি খালের আসল পরিচিতি বড়াল নদী। এই বড়াল নদী দিয়ে ব্রিটিশ বেনিয়াদের প্রমোদ তরী চলাচল করেছে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কার্গো, ছোট-বড় লঞ্চ, পালতোলা নৌকা, বার্জ চলত এই কাটাখাল দিয়ে। যমুনা নদীর সঙ্গে ছিল সরাসরি সংযোগ। ব্রিটিশ আমল থেকে শুরু করে স্বাধীনতার পরবর্তী দু’দশক পর্যন্ত কাটাখাল প্রবাহমান ছিল। কাটাখাল দিয়ে শহরের ঘরবাড়ির পয়ঃপ্রণালির পানি নেমে যেত। মিশে যেত যমুনা ও ফুলজোড় নদীতে। সেভাবেই গড়ে উঠেছিল ড্রেনেজ ব্যবস্থা। কিন্তু যমুনার সঙ্গে সংযোগ বন্ধ হওয়ার পর ক্রমাগত কাটাখালির দুই পাড় অবৈধ দখলে চলে যায়। দখলে-দূষণে বিপন্ন হয়ে পড়ে এর অস্তিত্ব। বড়াল নদীর (কাটাখালি) ওপর নির্মিত হয় খুঁটিবিহীন ইলিয়ট ব্রিজ, যা আজও কালের সাক্ষী হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে। বড়পুল নামে মানুষ চেনেন। ইলিয়ট ব্রিজ সিরাজগঞ্জ শহরের কাটাখালের ওপরে লোহা ও সিমেন্টের সমন্বয়ে তৈরি। সিরাজগঞ্জ শহরকে দেখার জন্য কাঁটাখালের ওপরে ৩০ ফুট উঁচু করে ইংরেজ এসডিও বিটসন বেল আইসিএস, ১৮৮২ সনে বাংলার তৎকালীন ছোটলাট স্যার আলফ্রেড ইলিয়টের নামানুসারে এই ব্রিজ তৈরি করেছিলেন। সে আমলে সন্ধ্যার পর ইলিয়ট ব্রিজের ওপরে দাঁড়িয়ে সিরাজগঞ্জ শহরের একটি ভিন্নতর রূপ নজরে পড়ত। ১৮৮২ সালে নির্মিত ব্রিজটি আজও তার প্রথম দিনের সমৃদ্ধি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সিরাজগঞ্জ শহরে প্রাণকেন্দ্রে। ১৮০ ফুট লম্বা আর ১৬ ফুট চওড়া এই ব্রিজের প্রধানতম বৈশিষ্ট্য হলো এতে কোন পিলার নেই। স্টুয়ার্ট হার্টল্যান্ড নামের ব্রিটিশ বংশোদ্ভূত ইঞ্জিনিয়ারের তৈরি এই পিলারবিহীন ব্রিজ। তৎকালীন সময়ে প্রায় পয়তাল্লিশ হাজার টাকা ব্যয়ে নির্মিত হয় এই ঐতিহাসিক ইলিয়ট ব্রিজ। ইলিয়ট ব্রিজ আজও সিরাজগঞ্জ শহরের একটি আকর্ষণীয় এবং দৃষ্টিনন্দন স্থাপত্য সমূহের অন্যতম। হাজারও মানুষ আজও ছুটে আসে এই ব্রিজটির সৌন্দর্য দেখার জন্য। বিশেষ করে বিকেল হতে রাত পর্যন্ত বিভিন্ন পেশার মানুষেরা ব্রিজটির দুই পাশে আড্ডা দেয় এবং তাদের অবসর সময় এখানে বসে গল্প গুজবের মাধ্যমে অতিবাহিত করে থাকে। এটি সিরাজগঞ্জের অন্যতম ঐতিহ্য। শত শত মানুষের মিলন তীর্থ। গ্রামের মানুষ শহর থেকে ঘুরে গেলে বন্ধুরা বলে থাকেন, ‘তুমি তো শহরে গিয়েছিলে, বলতো বড়পুলের খুটি আছে কিনা এবং কয়টি।’
×