ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

আজ শুধুই স্মৃতি ॥ হারিয়ে গেছে দোলাই খাল

প্রকাশিত: ১০:৫৬, ৯ ফেব্রুয়ারি ২০২০

আজ শুধুই স্মৃতি ॥ হারিয়ে গেছে দোলাই খাল

শাহীন রহমান ॥ রাজধানীর বুকজুড়ে এক সময় প্রমত্তা নদীর মতো বয়ে চলত দোলাই নামে খালটি। কালক্রমে এটি ধোলাই খাল হিসেবে পরিচিতি পায়। গত শতাব্দীর ষাটের দশক পর্যন্ত দোলাই খালের সঙ্গে ঢাকার নাম ছিল ওতপ্রোতভাবে জড়িত। কিন্তু আজ সবই ইতিহাস, সবই স্মৃতি। নামে পরিচিত থাকলেও অস্তিত্ব নেই সেই প্রবহমান খালের। আর এই খাল হারিয়ে যাওয়ার বিষময় ফল আজ ঢাকাবাসীকে বহন করতে হচ্ছে। আজকের ঢাকা শহরের বিপর্যয়ের পেছনেও এই খাল ধ্বংস হয়ে যাওয়াকে বিশেষজ্ঞরা অন্যতম প্রধান কারণ বলে মনে করছেন। রাজধানীতে খাল না থাকা এবং দোলাই খালের মতো বড় বড় খাল হারিয়ে যাওয়ায় প্রতিবছরই বর্ষায় ভয়াবহ জলাবদ্ধতার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। সামান্য বৃষ্টি হলেও পানিতে ডুবে যাওয়ার ঘটনা খুবই স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। জলাবদ্ধতার কারণে রাজধানীর যানজট দুঃসহ আকার ধারণ করে। জলজট আর যানজটের কবলে পড়ে রাজধানীবাসীকে চরম ভোগান্তি পোহাতে হয়। বর্ষা মৌসুমেও রাজধানীর বহু সড়কে খোঁড়াখুঁড়ি চলে। ড্রেনেজ ব্যবস্থা ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা দুর্বল হয়ে পড়েছে এই খাল না থাকার কারণে। এসব নিয়ে প্রতিবছর ঢাকা সিটি কর্পোরেশন রাজউক, নগর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, ঢাকা ওয়াসা থেকে নানা প্রকল্প নেয়া হলেও জলাবদ্ধতা রোধ করা যায়নি। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, খাল দখল হয়ে যাওয়াই এই জলাবদ্ধতার প্রধান কারণ। খালগুলো রক্ষা করা গেলে আজ ঢাকায় এই বিপর্যয় সৃষ্টি হতো না। তারা বলছেন, ঢাকা নগরীর ৬৫টি খাল এক সময় ঢাকার পানি নিষ্কাশনে বিশেষ ভূমিকা রাখত। কিন্তু এই খালগুলো এখন খুঁজে পাওয়া কঠিন। বেশিরভাগ দখল করে বহুতল ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। যেগুলো টিকে আছে সেগুলো এখন দখলের কবলে। আবর্জনায় ভরপুর। ফলে প্রতিবছর নানা দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে এসব খালকে ঘিরে। এই ৬৫ খালের মধ্যে দোলাই খালই ছিল ঢাকার প্রাণ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই খাল বেঁচে থাকলে আজ ঢাকা এত বিপর্যয়ের সৃষ্টি হতো না। পরিবেশ অধিদফতরের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক প্রকৌশলী আব্দুস সোবহান জনকণ্ঠকে বলেন, খালগুলো দখল হয়ে যাওয়ার কারণে একটু বৃষ্টি হলেই জলাবদ্ধতা দেখা দিচ্ছে। এমনভাবে দখল করা হয়েছে যে বৃষ্টির পানি দাঁড়ানোর কোন জায়গা নেই। খাল দখল করে অপরিকল্পিত নগরায়ণের কারণেই এই বিপর্যয়ের সৃষ্টি হচ্ছে। এর হাত থেকে রক্ষা পেতে হলে খাল উদ্ধার ও রক্ষণাক্ষেণের কোন বিকল্প নেই। তিনি বলেন, ঢাকার বুকে যে দোলাই ও বেগুনবাড়ি খাল বিভিন্ন শাখা প্রশাখা বয়ে চলত এখন বৃষ্টি হলে সব পানি এই খাল দিয়ে প্রবাহিত হতো। খালগুলোর আবার নদীর সঙ্গে সংযোগ ছিল। ফলে আগে বর্ষায়ও কোন জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়নি। এখন পরিস্থিতি সম্পূর্ণ উল্টো। ঐতিহাসিক বিবরণ থেকে জানা যায়, আজকে পুরান ঢাকার দোলাই খাল নামের যে জায়গাটি পরিচিত, সেটি এক সময়ে ঢাকার বুকে বয়ে যাওয়া প্রমত্ত খাল ছিল। যা ঢাকার ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছিল। নামের অস্তিত্ব থাকলেও সেখানে আজ সারি সারি বহুতল ভবনের দেখা মেলে। গড়ে উঠেছে বহু বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানসহ দোকানপাট। নতুন প্রজন্ম এই নামের সঙ্গে পরিচিত থাকলেও এই নামে ঢাকায় যে একটি খাল ছিল তা বেশিভাগেরই অজানা। তবে খাল সম্পর্কে তাদের জানা না থাকলেও এই খালেরই রয়েছে লম্বা এক ইতিহাস ও ঐতিহ্য। যা মুঘল আমল থেকেই চলে আসছে। মুঘল সুবাদার ইসলাম খা এই খালকে ঢাকা রক্ষার পরীখা হিসেবেই ব্যবহার করতেন। খাল দিয়ে যান চলাচল, মানুষের আয় রোজগারের মাধ্যম এবং বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতার হাত থেকেও ঢাকার নগরীকে সুরক্ষা দিয়েছে বহু যুগ ধরে। ঐতিহাসিক বিবরণে এই খাল সম্পর্কে উল্লেখ করা হয়েছে, দোলাই খাল এক সময়ে নগরী সৌন্দর্যবর্ধন করত। পানির চাহিদার সবটুকুই এই খালের মাধ্যমে করা সম্ভব ছিল। ঢাকার ভেতর দিয়ে বয়ে যাওয়া দোলাই খালের একটি শাখা শহরটাকে বিভক্ত করেছিল। তা থেকে প্রচুর শাখা প্রশাখা বের হয়ে চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল। সেগুলোও আবার চারদিকে খাল নালার সঙ্গে মিলিত ছিল। এগুলো আবার বালু বুড়িগঙ্গা ও শীতলক্ষ্যা নদীর সঙ্গে সংযোগ রক্ষা করে চলত। বর্ষায় এসব খালগুলো টইটুম্বুর হয়ে শহরের ঠিক মাঝখানে দীঘির মতো মনে হতো। ইতিহাসবিদ অধ্যাপক মুনতাসীর মামুনের স্মৃতি বিস্মৃতি ঢাকা বইয়ে এই দোলাই খালের উৎপত্তি ও ধ্বংসের পুরো ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছে। এই খাল সম্পর্কে দেশী-বিদেশী বহু ঐতিহাসিক বিবরণী লিখে গেছেন। যা মুনতাসীর মামুন তার বইয়ে উল্লেখ করেছেন। এতে দেখা যায় যে ১৮৭২ সালে দোলাই খালের স্বত্ব হস্তান্তর করা হয় ঢাকা পৌরসভাকে। এর আগে ১৮৬৪ এবং ৬৫ সালে পঁচিশ হাজার টাকা ব্যয়ে সংস্কার কাজ করা হয়। ১ এপ্রিল ১৯৬৭ সালে সরকার এই খালে চলাচলকারী যানবাহনের উপর কর ধার্য করে আয় বাড়ানোর ব্যবস্থা করেন। ওই সময়েই দোলাই খাল থেকে বছরে ৩ হাজার টাকার বেশি আয় হতো। উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে ময়মনসিংহ থেকে ঢাকায় আসতে এবং বর্ষায় সিলেট থেকে আসা নৌকাও এই খাল ব্যবহার করত। অন্যদিক দিয়ে ঘুরে যাওয়ার চেয়ে এই খাল দিয়ে গেলে সময় বাঁচত। ইংরেজ সরকারের নথি থেকে জানা যায়, দোলাই খালে পণ্যবাহী নৌকার জন্য কর দিতো হতো। কর আদায়ের জন্য রাজধানীর ত্রিমোহীনিতে ছিল টল ঘর। কিন্তু উনিশ শতকের দ্বিতীয় ভাগ থেকে খালের দুই তীরে বাড়িঘর নির্মাণ হতে থাকে। প্রায় সব বাড়িঘরের পেছন দিক ছিল খালের দিকে। এ কারণে সব মলমূত্র খালে পতিত হতো। ফলে দোলাই খাল ক্রমশ পরিণত হয় নোংরা দূষিত ও দুর্গন্ধময় এক খালে। গত শতাব্দীর ষাটের দশকেও জলপথ হিসেবে এর গুরুত্ব কম ছিল না। কিন্তু কালক্রমে এটি দখল দূষণে পড়ে বিলুপ্তি হয়ে যাওয়ায় কোন সরকার এই খাল রক্ষায় উদ্যোগ নেননি। ফলে খালটি হারিয়ে ঢাকা এক বিপর্যস্ত নগরীতে পরিণত হয়েছে। পরিবেশ অধিদফতরের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক এবং পরিবেশবিদ প্রকৌশলী আব্দুস সোবহান বলেন, পরিবেশ বিপর্যয়ের হাত থেকে ঢাকাকে রক্ষা করতে হলে খাল উদ্ধারের কোন বিকল্প নেই। দোলাই খাল এবং রাজধানীর বেগুন বাড়ি খাল এক সময়ে ঢাকা ঐতিহ্য বহন করলেও আজ তা শুধুই স্মৃতি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন ঢাকার চারদিকে নদী দ্বারা বেষ্টিত হওয়ার কারণেই নিরাপদ স্থান হিসেবে ঢাকার নগরীর পত্তন হয়েছিল। তেমনি দোলাই খালকে তারা বিভিন্ন সময় নিরাপত্তার দুর্গ হিসেবে ব্যবহার করতেন। এই দোলাই খালই ছিল এ সময়ে ঢাকার প্রধান জলপথ ও নগর রক্ষার প্রধান পরীখা। কিন্তু কালক্রমে এটি পরিণত হতে থাকে নগরীর আবর্জনার শেষ উৎস হিসেবে। কালক্রমে তা দখল হতে হতে এখন নামটিই টিকে আছে। খালের কোন অস্তিত্ব নেই। ঢাকা নগরীতে বসবাস করে এমন কেউ নেই যে দোলাই খালের নাম শোনেনি। কিন্তু বাস্তবে তারা এই খাল কোনদিন চোখেও দেখেনি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন এই খাল এক সময় ঢাকা শহরকে দুভাগে বিভক্ত করেছিল। খালটি এতই প্রমত্ত ছিল যে অনেকে এটিকে নদী হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তবে দোলাই খাল না নদী ছিল তা নিয়েও বির্তক রয়েছে। ইতিহাস থেকে জানা যাচ্ছে ঢাকার ভেতর দিয়েই দোলাই নামে একটি নদীও প্রবাহিত ছিল। তার একটি অংশ যেটি ঢাকার মাঝবরাবর বয়ে যেত তা দোলাই খাল নামে পরিচিত ছিল। খালের এই অংশ সুবাদার ইসলাম খাঁ কেটে ছিলেন বলেই উল্লেখ পাওয়া যায়। ইতিহাসবিদ অধ্যাপক মুনতাসীর মামুনের বইয়ে ললিনীকান্ত ভট্টশালীর উদ্ধৃতি দিয়ে লিখেছেন ঢাকার প্রথম মুঘল সুবাদার ইসলাম খাঁ এই দোলাই খাল কাটিয়েছিলেন। তার উদ্দেশ্যে ছিল নগর রক্ষার জন্য একটি পরীখা নির্মাণ এবং জলপথ হিসেবে ব্যবহারের। এ প্রসঙ্গে নাথানের উদ্ধৃতি দিয়েছেন। নাথান লিখেছেন জলপথে ঢাকার দিকে অগ্রসর হওয়ার পথে দেখলেন ঢাকার কাছে দোলাই নদী দুভাগে বিভক্ত। একটি শাখার ডেমরার কাছে মিলিত হয়েছে লক্ষ্যা নদীর সঙ্গে। আরেকটি খিজিরপুরের কাছে একই নদীতে মিলিত হয়েছে। এর যে শাখাটি ডেমরার দিকে প্রবাহিত ছিল তাই এক সময় দোলাই খাল নামে পরিচিত ছিল। এটি উত্তর পূর্বে প্রবাহিত হতো। যার একটি শাখা বালু নদীতে মিশেছিল। আনেকটি শীতলক্ষ্যা নদীতে। পুরান ঢাকার মাঝখান দিয়ে যে খালটি কিছুদিন আগেও বয়ে যেত সেই অংশটি খনন করেছিলেন সুবাদার ইসলাম খাঁ তা আরও অনেকেই লিখে গেছেন। তার বিররণী থেকে আরও পাওয়া যায় খালের উৎপত্তি বাবু বাজারের পাকুরতলির কাছ থেকে। তারপর জিন্দাবাহার গোয়ালনগর, নওয়াবপুর, নারিন্দা, জালুয়ানগর, হালশরফতগঞ্জ হয়ে লোহারপুলের নিচ দিয়ে বুড়িগঙ্গায় পড়েছিল। এই খালের উপর মুঘলরা লোহার সুন্দর পুল বা ব্রিজ নির্মাণ করেছিল বলেও রয়েছে। যার থেকেই নামকরণ করা হয়েছে নারিন্দাপুল, আমির খার পুল, মৈশন্ডীর পুল, শ্রীচক পুল, বাবু বাজার পুল, নাজিরা বাজার পুল এবং চানখার পুল। নামগুলো থেকে বোঝা যায় এখান দিয়ে খালটি প্রবাহিত হতো। তবে নাম থাকলে সেই খাল নেই, পুল নেই। মুনতাসীর মামুন লিখেছেন মুঘল আমলে দোলাই খালই ঢাকার প্রধান জনপথ হিসেবে ব্যবহৃত হতো। শহরের সৌন্দর্য বেড়েছিল এই খালের কারণে। তারা খালটি যতেœর সঙ্গে রক্ষণাবেক্ষণ করতেন। ইংরেজ আমলে খালটি দুবার সংস্কার করা হলে তারা বিশেষ যতœ নেয়নি। ইংরেজ লেখক জেমস টেলর এই খালের বিবরণে লিখেছেন, দোলাই খালের একটি শাখা শহরকে দু’ভাগ করে রেখেছে। এটির নানা শাখা প্রশাখা ঢাকার চারদিকে ছড়িয়ে রয়েছে। বর্ষায় এটি টইটম্বুর হয়ে শহরের মাঝখানে দীঘির মতো মনে হতো। হৃদয়নাথ মজুমদার লিখেছেন বাবু বাজার খাল দুভাগ করেছে ঢাকা শহরকে। খালের উত্তর এবং পশ্চিমে পুরনো অংশ অবস্থিত। রায়ের বাজার থেকে শুরু করে ঢাকার উত্তরের এবং পূর্বে পুরানা পল্টন ও রমনার মাঠ এই শহরের অন্তর্গত। ইতিহাস থেকে জানা যায় ১৯০৯ সালে ঢাকার প্রকৌশলীরা দোলাই খাল ও তার শাখা প্রশাখাসহ ১২ মাইল জলপথ বন্ধ করে দেয়ার সুপারিশ করেন। তবে ১৯১৭ সালে ঢাকার নগর পরিকল্পনা করতে গিয়ে নগর পরিকল্পনাবিদ গেড্ডেস ওই প্রকৌশলীদের রেফারেন্স টেনে উল্লেখ করেন চমৎকার পুরনো দোলাই খাল, আর নগরীর উত্তর পূর্ব আর পশ্চিমজুড়ে তার জালিকাবিন্যাসকে খোলামন নিয়ে দেখার জন্য প্রকৌশলীদের প্রতি আহ্বান জানান। বলেন, তিনি এগুলো ভরাট হয়ে যাওয়ার কথা ভেবে শুধুই বিস্মৃত হবেন না। আবারও অবাক হবেন তার বর্তমান অবস্থার কারণেও। মুসতাসীর মামুন উল্লেখ করেন, গত শতাব্দীর ষাট দশকের দিকে জমি দখলের প্রক্রিয়ায় দোলাই খাল হারিয়ে যেতে থাকে। এক সময় তা পুরো ভরাট করে ফেলা হয়। এর বিষময় ফল এখন ঢাকাবাসীকে বহন করতে হচ্ছে।
×