ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

দ্বিতীয় ও তৃতীয় অবস্থানে যথাক্রমে শ্রীলঙ্কা এবং চীন

দেশে কর্মরত বিদেশীদের মধ্যে ভারত শীর্ষে

প্রকাশিত: ০৯:৪০, ৯ ফেব্রুয়ারি ২০২০

দেশে কর্মরত বিদেশীদের মধ্যে ভারত শীর্ষে

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ দেশের বেসরকারী খাতে এখন ভারতীয়দের দাপট। বিশেষ করে তারা পোশাক, বায়িং হাউস, আইটি এবং সেবা খাতে প্রাধান্য বিস্তার করে আছেন। ভারতের পরই শ্রীলঙ্কা ও চীনের অবস্থান। তবে মোট বিদেশীর কমপক্ষে অর্ধেকই ভারতীয়। জার্মানভিত্তিক সংবাদমাধ্যম ডয়চে ভেলের এক বিশেষ প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়েছে। ব্যবসায়ীদের বরাত দিয়ে এতে আশঙ্কা করা হয়েছে, করোনা ভাইরাসের কারণে চীনাদের দাপট কমে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয়ায় ভারতীয়দের দাপট আরও বাড়তে পারে। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) বুধবার তাদের এক প্রতিবেদনে বলেছে, বাংলাদেশে মোট বিদেশী ২ লাখ ৫০ হাজার। তাদের মধ্যে বৈধ ৯০ হাজার। বাকিরা অবৈধভাবে বাংলাদেশে আছেন। আর যারা বৈধভাবে আছেন তাদের মধ্যে ৫০ ভাগ কোন অনুমতি না নিয়েই টুরিস্ট ভিসায় বাংলাদেশে এসে কাজ করছেন। এই বিদেশীরা বছরে ২৬ হাজার ৪০০ কোটি টাকা পাচার করেন। টিআইবি বাংলাদেশে বিদেশীদের হিসাব করেছে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ২০১৮ সালে দেয়া ৮৫ হাজার ৪৮৬ জন বৈধ বিদেশীর তথ্যের ওপর ভিত্তি করে। কিন্তু বাস্তবে এই সংখ্যা বহুগুণ বেশি। বাংলাদেশে দুটি তৈরি পোশাক কারখানার মালিকের সঙ্গে কথা বলে ডয়চে ভেলে জেনেছে, নানা কারণে পোশাক খাতে ভারতীয়দের অবস্থান শক্ত। এর মধ্যে পোশাক খাতে জিজাইনসহ আরও কয়েকটি বিষয়ে দক্ষ জনশক্তির অভাব আছে। আর পোশাকের বায়িং হাউসগুলো নিয়ন্ত্রণ করে ভারতীয়রা। ফলে পোশাক কারখানাগুলো বায়ার পেতে তাদের কারখানায় মার্কেটিং এবং হিসাব বিভাগেও ভারতীয়দের নিয়োগ করে। তাদের মতে, বাংলাদেশের পোশাক কারখানাগুলোতে এক লাখেরও বেশি ভারতীয় কাজ করেন। অন্যদিকে বায়িং হাউসে এই সংখ্যা আরও বেশি। পোশাকের পরে আইটি খাতে দাপট রয়েছে ভারতীয়দের। এছাড়া আরও অনেক সেবা খাত আছে যেখানে ভারতীয়রা কাজ করেন। এমনকি বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যম, বিজ্ঞাপন, কনসালটেন্সি-এসব খাতেও ভারতীয়রা রয়েছেন। প্রতিবেদনে বলা হয়, সবমিলিয়ে বাংলাদেশে কম করে হলেও পাঁচ লাখ ভারতীয় কাজ করে বলে ধারণা করা হয়। কিন্তু তাদের অধিকাংশেরই কোন ওয়ার্ক পারমিট নেই। তারা ট্যুরিস্ট ভিসায় আসেন আর তাদের বেতন অনেক বেশি। ট্যুরিস্ট ভিসায় যারা কাজ করেন তাদের আয় করা পুরো অর্থই অবৈধ পথে বাংলাদেশের বাইরে চলে যায়। বাংলাদেশের আইটি খাতের একজন উদ্যোক্তা জানান, ‘সফটওয়্যার ও ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমে ভারতীয় কৌশল ব্যবহারের কারণে ওই দেশের জনশক্তিকেও কাজ দিতে হয়। শুধু তাই নয়, অনেক ক্ষেত্রে তাদের লোক রাখার শর্ত জুড়ে দেয়া হয়। আবার ট্রাভেল এজন্টদের বড় একটি অংশ ভারতীয়দের নিয়ন্ত্রণে। তাই তাদের সফটওয়্যার ও তাদের লোক বলে কাজ হয়। এটা সরকারের পলিসির বিষয়। সরকার পলিসি ঠিক করলে তাদের দাপট কমবে।’ বাংলাদেশের চাকরির বাজার নিয়ে কাজ করা সবচেয়ে বড় প্রতিষ্ঠান হলো বিডিজবস ডটকম। প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী ফাহিম মাশরুর বলেন, ‘কর্মরত বিদেশীদের মধ্যে ভারতীয়রাই শীর্ষে। তারপরে শ্রীলঙ্কা, চীন, থাইল্যান্ড। এদের মধ্যে শতকরা ১০ ভাগেরও ওয়ার্ক পারমিট নেই। অধিকাংশই অবৈধভাবে কাজ করেন। তাদের পেমেন্টও এখানে করা হয় না। ভারতীয় হলে তার পেমেন্ট ভারতেই দেয়া হয়। যারা নিয়োগ করেন তারা এ রকম একটা সিস্টেম গড়ে তুলেছেন।’ বাংলাদেশ থেকে কত রেমিটেন্স দেশের বাইরে যায় সেই হিসাবটি দেখলে বাংলাদেশে কর্মরত বিদেশীদের সংখ্যা সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়া যায়। আর বাংলাদেশ থেকে ভারতেই বেশি রেমিটেন্স যায়। পোশাক খাতের আয়েরও বড় একটি অংশ তাদের টেকনিশিয়ান ও ডিজাইনাররা নিয়ে যান বলে তাদের প্রতিবেদনে জানিয়েছে জার্মানির এই সংবাদমাধ্যম। এ্যাকাউন্টেন্ট, প্রশাসনিক কাজেও বাইরে থেকে লোক আনা হয় বলে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) অর্থনীতিবিদ ড. নাজনীন আহমেদ। তিনি জানান, ‘প্রতিবছর আমাদের দেশ থেকে চার-পাঁচ বিলিয়ন ডলার দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে। আর এবার আমাদের রেমিটেন্সের টার্গেট ২০ বিলিয়ন ডলার। তাহলে আমরা যা আনতে পারি তার পাঁচ ভাগের এক ভাগ আবার বিদেশি কর্মীদের দিয়ে দিতে হয়। এ থেকে বাংলাদেশে কর্মরত বিদেশীদের সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়া যায়। এটা আমি বলছি বৈধ চ্যানেলের কথা। অবৈধভাবে কত যায় সেটা সরকার উদ্যোগ নিলে জানতে পারে কিন্তু উদ্যোগ নেই। এই অর্থ সবচেয়ে বেশি যায় ভারত ও শ্রীলঙ্কায়। আমার কাছে অবাক লাগে, এখানে এ্যাকাউন্টেন্ট, প্রশাসনিক কাজেও বাইরে থেকে লোক আনা হয়।’ দেশে লাখ লাখ শিক্ষিক বেকার থাকা সত্ত্বেও লাখ লাখ ভারতীয় জনবল বাংলাদেশে কাজ করায় বিস্ময় প্রকাশ করেছেন পাওয়ার এ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) নির্বাহী সভাপতি এবং বেসরকারি সেবা সংস্থা ব্র্যাকের চেয়ারম্যান ড. হোসেন জিল্লুর রহমান। তিনি বলেন, ‘শিক্ষায় আমরা উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আনতে পেরেছি। কিন্তু শিক্ষার মান নিয়ে যে কেউ প্রশ্ন তুলতে পারেন। আর এটিই হচ্ছে চ্যালেঞ্জ। লাখ লাখ শিক্ষিত বেকার। এত বেকার থাকার পরও বাংলাদেশের মতো ছোট্ট একটি দেশে কাজ করছে ভারতের কয়েক লাখ মানুষ। তারা এ দেশের শ্রমবাজার দখল করে রেখেছে। নিয়োগদাতারা বাংলাদেশের শিক্ষিতদের সার্টিফিকেট গ্রহণ করছে না। দেশে এত শিক্ষিত বেকার! ভারতের লাখ লাখ জনবল এসে কাজ করছে কিভাবে? এটি তো রীতিমতো ভাবনার বিষয়।
×