ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ড. মোঃ আমির হোসেন

বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ

প্রকাশিত: ০৮:১৬, ৮ ফেব্রুয়ারি ২০২০

  বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ

ভারতে মহাত্মা গান্ধীর প্রথম অসহযোগ আন্দোলনের প্রারম্ভিক মুহূর্তে, সাম্প্রদায়িক সমাজ-পরিবেশে, ব্রিটিশ শাসিত কৃষিনির্ভর পূর্ব বাংলায়, অপরূপ প্রাকৃতিক পরিবেশ সজ্জিত নদী পাড়ের টুঙ্গিপাড়ার ঐতিহ্যবাহী মধ্যবিত্ত শেখ পরিবারে জন্ম নেন মা-বাবা, আত্মীয়-স্বজনের আদরের খোকা, রাজনীতির কবি, বাঙালীর অবিসংবাদিত নেতা, বাংলাদেশ মহাকাব্যের মহানায়ক, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্রষ্টা, জাতির পিতা, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। নদীর পাড়ের হিজল ডালে, হিজলের ছায়াতলে বসে শৈশবেই তিনি অবলোকন করেন বাংলার নৈসর্গিক প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, বাঙালীর আচার-আচরণ, হাসি-আনন্দ, দুঃখ-বেদনা, অভাব-অনটন, অনাহার-অর্ধাহার, বন্যা-খরা-দুর্ভিক্ষ, জনসংখ্যার চাপ, বেকারত্বের অভিশাপ, পশ্চাৎপদ কৃষিনির্ভর সমাজ, জমিদারি প্রথার নৃশংসতা, ব্রিটিশ শাসন-শোষণ-নির্যাতন এবং মধ্যযুগীয় ধর্মান্ধতা। বাংলার শব্দ, চিত্র, রং এবং বাঙালীর ব্যথা-বেদনা, সুখ-দুঃখ, আশা-আকাক্সক্ষা, চিন্তা-চেতনা ও সংস্কৃতি ধারণ করে তাঁর মন ও মানসিকতার বিকাশ ঘটে। হয়ে ওঠেন মনে-প্রাণে বিশুদ্ধ বাঙালী। অমিত আত্মবিশ^াসী, সাধারণ মানুষের প্রতি অবিচল আস্থাশীল বঙ্গবন্ধুর শক্তি, ব্যক্তিত্বের সৌরভ, সঙ্কল্প, রাজনৈতিক ক্রিয়াকর্ম, সরব ও স্বতঃস্ফূর্ত সাহসী জীবনপ্রবাহ শোষিত বঞ্চিত বাঙালী জনগোষ্ঠীর অন্তরে লালিত স্বাধীনতার সুপ্ত বাসনাকে জাগ্রত করে, যা ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু হয়ে রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধে বিস্তৃত হয়। তাঁর তীক্ষ্ণ রাজনৈতিক মেধা ও অসাধারণ, অপ্রতিরোধ্য, প্রগতিশীল নেতৃত্বে বাঙালী স্বাধীনতা অর্জন করে, বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। চলনে-বলনে, কথা-বার্তায়, আচার-আচরণে, পোশাকে-আষাকে, বিচার-বিবেচনায়, আন্দোলন-সংগ্রামে বঙ্গবন্ধু ছিলেন বিশুদ্ধ বাঙালী। বাংলার মাটি ও মানুষের সঙ্গে ছিল তাঁর নিবিড় ও অটুট বন্ধন। তাঁর ধ্যানে-মনে, চিন্তা-চেতনায়, বিশ্বাসে ও অস্তিত্বজুড়ে ছিল বাংলাদেশ, বাংলাদেশের মানুষ এবং বাংলা ভাষা। বাঙালীর প্রতি তাঁর ভালবাসা ছিল অকৃত্রিম, ব্যক্তিস্বার্থের উর্ধে। সেজন্যই দৃঢ়চিত্তে, দীপ্তকণ্ঠে বঙ্গবন্ধু উচ্চারণ করেনÑ ‘ফাঁসির মঞ্চে যাওয়ার সময় আমি বলব, আমি বাঙালী, বাংলা আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা। জয় বাংলা।’ একজন বিদেশী ঐতিহাসিকের মতে ‘প্রায় বারো শ’ বছর পর বাঙালী জাতির পুনর্জন্ম হয়েছে এবং হাজার বছর পর বাংলাদেশ এমন একজন নেতা পেয়েছে, যিনি রক্ত-বর্ণে-ভাষায় এবং জাতি বিচারে একজন খাঁটি বাঙালী। বাংলাদেশের মাটি ও ইতিহাস থেকে তাঁর সৃষ্টি এবং তিনি বাঙালী জাতির স্রষ্টা।’ বঙ্গবন্ধুর ঋজু বলিষ্ঠ দৈহিক গঠন, কোমলতা ও দৃঢ়তা মিশ্রিত সম্মোহনী শক্তিধর প্রবল ব্যক্তিত্ব, জলদগম্ভীর কণ্ঠস্বরে বাঙালী খুঁজে পায় তাদের অস্তিত্ব, আশা-আকাক্সক্ষার প্রতিচ্ছবি ও আত্মপরিচয়। তিনি হয়ে ওঠেন বাঙালীর ভালবাসার মানুষ ও প্রিয় নেতা। সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে সিদ্ধহস্ত বঙ্গবন্ধু চরম সঙ্কটকালে থাকতেন স্থির ও অবিচল। তাঁর বক্তৃতা ছিল মাদকতায় ভরা বিস্ফোরক শব্দাবলির নিপুণ বিন্যাস। নিপুণ শিল্প। যেন মন্ত্রাচ্চারণ। যা বাঙালীর হৃদয়কে সহজেই স্পর্শ, চেতনাকে সমৃদ্ধ ও শাণিত করে স্বাধীনতার সুপ্ত বাসনাকে জাগ্রত করে। কথা-বার্তায়, চিন্তা-চেতনায়, আচার-আচরণে, বিশ্বাসে বঙ্গবন্ধু ছিলেন জাতীয়তাবাদী, গণতন্ত্রী, সমাজতন্ত্রী এবং ধর্মনিরপেক্ষ। যা তাঁর আদর্শের চার স্তম্ভ। তিনি এই আদর্শ ধারণ, লালন ও চর্চা করেন আমৃত্যু। তিনি ছিলেন শোষিতের গণতন্ত্রে বিশ্বাসী। বহুবার বলেছেন- ‘আমি শোষকের নয়, শোষিতের পক্ষে।’ মুক্তিযুদ্ধের পর দেশে ফিরে এসে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের বিশাল জনসভায় বলেন- ‘আজ আমি মুক্ত বাংলার মাটিতে দাঁড়িয়ে দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে ঘোষণা করছি, আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতা।’ বঙ্গবন্ধু জন্মেছিলেন হীনমন্য সাম্প্রদায়িক সমাজ-পরিবেশে। তবু জন্মলগ্ন থেকেই নিজের চেতনায় ধারণ করেন অসাম্প্রদায়িক বোধ, বর্জন করেন হীন সাম্প্রদায়িক মানসিকতাকে। এই অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে লালন করতে গিয়ে তিনি বক্তৃতায় সাম্প্রদায়িক বৈরী আচরণের শিকার হন, ব্যাথিত হন। কিন্তু অসাম্প্রদায়িক চেতনা থেকে কখনও বিচ্যুত হননি। বরং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির জন্য কাজ করেন, হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গারোধে রাখেন ভূমিকা। ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের নাম থেকে মুসলিম শব্দ বাদ দিতে সোচ্চার হন। ৭ মার্চের ভাষণে বলেন- ‘..... এই বাংলায় হিন্দু-মুসলিম, বাঙালী-ননবেঙ্গলী যারা আছে তারা আমাদের ভাই, তাদের রক্ষার দায়িত্ব আপনাদের উপর, আমাদের যেন বদনাম না হয়।’ ৩ জানুয়ারি ১৯৭১ সালে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সংসদ সদস্যদের শপথ অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেন- ‘হিন্দু, খ্রীস্টান, বৌদ্ধ ভাইয়েরা আপনারা শুনে রাখুন, আপনারাও এ দেশের সমান নাগরিক। ..... এই দেশ একা কারও নয়। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলের এই দেশ। ধর্মের নামে ব্যবসা চলবে না, শোষণ চলবে না। আমাদের লক্ষ্য একটি শোষণহীন সমাজতান্ত্রিক, গণতান্ত্রিক দেশ প্রতিষ্ঠা। ধর্মনিরপেক্ষতাই হবে রাষ্ট্রীয় নীতি।’ অকুতোভয়, দৃঢ়চেতা, আপোসহীন, আত্মপ্রত্যয়ী, উদার, সংস্কৃতিমনা, দূরদর্শী বঙ্গবন্ধুর শৈশব থেকেই ছিল সাধারণ মানুষের প্রতি অপরিসীম ভালবাসা। তিনি উপেক্ষিত, দুর্দশাগ্রস্ত, দৈন্যপীড়িত, বন্যা, খরা, মহামারী, দুর্ভিক্ষ, জলোচ্ছ্বাস, হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গায় আহত অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ান, সংখ্যালঘুদের রক্ষা করেন ও আশ্রয় দেন। গরিব শিক্ষার্থীদের সাহায্যার্থে তিনি ৭ম শ্রেণীতে থাকাকালীন ’মুসলিম সেবা সমিতি’তে যোগ দিয়ে মুষ্টি ভিক্ষার চাল উঠান। অন্যায়, অবিচার, অত্যাচার, নির্যাতন, বৈষম্য ও শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেন, প্রতিরোধ গড়েন। ছাত্রজীবনেই তিনি দাবি-দাওয়া প্রণয়ন ও আদায় করার দক্ষতা ও সক্ষমতা প্রদর্শন করেন। মুখ্যমন্ত্রী শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক গোপালগঞ্জ স্কুল পরিদর্শন করতে গেলে বর্ষা মৌসুমে স্কুল ঘরে পানি পড়ার অভিযোগ উত্থাপন করে তা সংস্কারের দাবি করেন। ইংরেজ তাড়ানোর তাগিদ অনুভব করে স্বদেশী আন্দোলনের প্রতিও আকৃষ্ট হন এবং নেতাজী সুভাষ বসুর হলওয়েল মনুমেন্ট অপসারণ আন্দোলনে যোগ দেন। সাম্প্রদায়িক বিরোধের কারণে কংগ্রেসের রোষানলে পড়ে বঙ্গবন্ধু জীবনে প্রথমবার জেলে যান। এই সময় পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টির লক্ষ্যে গোপালগঞ্জে মুসলিম ছাত্রলীগ গঠন করে সম্পাদকের দায়িত্ব নিয়ে রাজনৈতিক জীবন শুরু করেন। প্রাদেশিক মুসলিম লীগ কাউন্সিলের সদস্য হন। সদস্য হয়ে তিনি জমিদার, জোতদার ও নবাবদের সংগঠন মুসলিম লীগকে সাধারণ জনগণের সংগঠনে পরিণত করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টির পক্ষে, বাংলা ভাগের বিপক্ষে এবং জমিদারি প্রথা বিলোপের লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু বিরামহীন কর্মযজ্ঞে লিপ্ত থাকেন। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর আপোসহীন সাহসী ভূমিকা ও সাংগঠনিক দক্ষতা কলকাতার প্রগতিশীল মহলে ব্যাপক প্রশংসিত হয়। বঙ্গবন্ধু রাজনীতিতে যুক্ত হয়ে উপমহাদেশের তৎকালীন রাজনৈতিক বাস্তবতায় পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টির আন্দোলনের পক্ষে থাকলেও বাংলা ভাগ তাঁকে ক্ষতবিক্ষত করে। বাংলার পূর্বাংশ পূর্ব পাকিস্তান হওয়ার পর তিনি অনুধাবন করেন যে, বাঙালীর আত্মপরিচয় বিলীন হতে বসেছে। দেড় সহস্র মাইলের দূরত্ব ও বিচ্ছিন্নতা ছাড়াও পূর্ব বাংলার জাতীয়তা, ভাষা-সংস্কৃতি, আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক চরিত্র পশ্চিম পাকিস্তানের চেয়ে আলাদা। পরাধীনতার গ্লানিমুক্ত হয়নি বাঙালী। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের পরিবর্তে পাকিস্তানী ঔপনিবেশিক শাসন বহাল হয়েছে। পূর্ব বাংলায় শাসন, শোষণ ও নির্যাতন চলবে। ধর্ম হবে হাতিয়ার। বাঙালীর মানসিক ও ব্যবহারিক সম্পদ ভাষা কেড়ে নেয়ার ঔদ্ধত্য দেখে তাঁর উপরোক্ত ধারণা বিশ^াসে পরিণত হয়। স্বাধীনতা ছাড়া বাঙালীর মুক্তি নাই এই সত্য তিনি অনুধাবন করেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি বঙ্গবন্ধু শুরু করেন এখান থেকেই। ভাবী সময়ে তাঁর লক্ষ্য ও প্রত্যয় আরও স্পষ্ট ও দৃঢ় হয়। শুরু হয় তাঁর রাজনৈতিক জীবনের গৌরবময় ও অবিস্মরণীয় দ্বিতীয় অধ্যায়। বাঙালী জাতিসত্তার বিকাশ ও আত্মপরিচয় নির্মাণ এবং বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার উপাখ্যান। আদর্শ ও নীতিতে অটল অবিচল থেকে, মানুষের হৃদয়কে উজ্জীবিত করে তিনি সামাজিক শক্তির বিকাশ ঘটান। বাঙালীর স্বপ্ন, ভাবনা, চেতনা ও লক্ষ্য ধারণ করে হয়ে ওঠেন জনগণের মুখপাত্র, বাঙালীর জাতীয় চেতনার উন্মেষ, বিকাশ, ব্যাপ্তি, সফলতার মূল স্থপতি এবং ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বাঙালীর অখ-িত সত্তা ও শক্তির প্রতীক। বঙ্গবন্ধু ৫০-এর দশকে বলেন, পাকিস্তান এ্যাসেম্বলিতে পূর্ব পাকিস্তান বলা যাবে না, বলতে হবে পূর্ব বাংলা। ১৯৫৫ সালে পাকিস্তান গণপরিষদে দুর্জয় মনোবল ও বজ্রকঠিন দৃঢ়তা নিয়ে বলেন- ‘অন্য কোন ভাষা জানি কি না জানি আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ নয়, আমরা এখানে বাংলাতেই কথা বলতে চাই। ..... যদি আমাদের অনুমতি না দেয়া হয় তবে আমরা হাউজ পরিত্যাগ করব। বাংলাকে অবশ্যই গ্রহণ করে নিতে হবে, এটাই আমাদের স্ট্যান্ড।’ ১৯৫৭ সালের ৩ এপ্রিল পূর্ব বাংলা প্রাদেশিক পরিষদে স্বায়ত্তশাসনের প্রস্তাব উত্থাপিত হলে বঙ্গবন্ধু এই প্রস্তাব সমর্থন করে বক্তব্য রাখেন। ১৯৫৮ সালে ইস্ট বেঙ্গল লিবারেশন পার্টি গঠিত হয়। এই পার্টির লক্ষ্য ছিল সশস্র বিপ্লবের মাধ্যমে পূর্ব বাংলাকে স্বাধীন করা। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে এই দলের যোগাযোগ ছিল এবং তিনি এই দলকে আর্থিক সাহায্যও করেছিলেন। ১৯৬১ সালে আইয়ুববিরোধী আন্দোলনের কর্মসূচীতে পূর্ব বাংলার স্বাধীনতার দাবি অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব দেন। তিনি বলেন- ‘একটা কথা আমি খোলাখুলি বলতে চাই, আমার বিশ্বাস, গণতন্ত্র, স্বায়ত্তশাসন এসব কোন দাবিই পাঞ্জাবীরা মানবে না। কাজেই স্বাধীনতা ছাড়া বাঙালীর মুক্তি নাই। স্বাধীনতার দাবিটা আন্দোলনের কর্মসূচীতে রাখা দরকার।’ ৫ ডিসেম্বর ১৯৬৯ সালে শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যু দিবসে বঙ্গবন্ধু বলেন- “এক সময়ে এ দেশের বুক হইতে, মানচিত্রের পৃষ্ঠা হইতে ‘বাংলা’ কথাটির সর্বশেষ চিহ্নটুকুও চিরতরে মুছিয়া ফেলার চেষ্টা করা হইয়াছে... একমাত্র ‘বঙ্গোপসাগর’ ছাড়া কোন কিছুর নামের সঙ্গে ‘বাংলা’ কথাটির অস্তিত্ব খুঁজিয়া পাওয়া যায় নাই.... আমি ঘোষণা করিতেছি আজ হইতে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশটির নাম হইবে পূর্ব পাকিস্তানের পরিবর্তে শুধু ‘বাংলাদেশ’।” ১৯৬৬ সালে হোটেল ইডেনে আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে ঘোষণা করেন- ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটিই হবে বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত। ৩ জানুয়ারি ১৯৭১ উত্তাল সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের বিশাল জনসমাবেশে বক্তৃতায় শোষণ, বঞ্চনা, নির্যাতন ও জাতিগত নিপীড়নের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়ে স্বাধীনতা ও মুক্তির লক্ষ্যে মরণপণ লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত থাকার আহ্বান জানান এবং শপথবাক্য পাঠ করান- ‘আমাদের কার্যক্রমের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির প্রয়াসী যে কোন মহল ও অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে আমরা প্রবল প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তুলব এবং সাধারণ মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে যে কোনরূপ ত্যাগ স্বীকার করে আপোসহীন সংগ্রামের জন্য আমরা সর্বদা প্রস্তুত থাকিব।’ ১৯৭১ সালের ২০-২১ ফেব্রুয়ারি, মধ্যরাতে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের পাদদেশে দাঁড়িয়ে তিনি বলেন, ‘সামনে আমাদের কঠিন দিন। আমি আপনাদের মাঝে নাও থাকতে পারি। মানুষকে একদিন মরতে হয়। আমি জানি না, আবার কবে আপনাদের সামনে দাঁড়াতে পারব। তাই আজ আমি আপনাদের এবং সারা বাংলার মানুষকে ডেকে বলছি, চরম ত্যাগের জন্য প্রস্তুত হন। বাঙালী যেন আর অপমানিত লাঞ্ছিত না হয়। শহীদদের রক্ত যেন বৃথা না যায়।’ সমাজ, ইতিহাস, রাজনীতি, অর্থনীতি, অসহযোগ, বিভেদের বিরুদ্ধে সাবধানতামিশ্রিত দিগন্ত বিদীর্ণ ও প্লাবিত করা আবেগমথিত জলোচ্ছ্বাসময় ৭ মার্চের বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাষণে লাখ লাখ বাঙালীর উপস্থিতিতে স্বভাবসুলভ দৃঢ়তা নিয়ে বঙ্গবন্ধু বজ্রকণ্ঠে বাঙালীর প্রাণের দাবি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি ও পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেন। অর্থাৎ ধাপে ধাপে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে এগিয়ে যান এবং বাংলার মানুষকে স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুত করেন। বঙ্গবন্ধুর নিরলস কর্মযজ্ঞে, দূরদর্শী, গতিশীল এবং ঐন্দ্রজালিক নেতৃত্বে আমাদের সমাজ, সংস্কৃতি বিকশিত হয়, মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে বাংলার আপামর জনতা, ত্রিশ লাখ মানুষ প্রাণ উৎসর্গ করে এবং দুই লাখ মা-বোন সম্ভ্রম হারায়, আমরা অর্জন করি গৌরবোজ্জ্বল আত্মপরিচয়- স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। এর জন্য বঙ্গবন্ধু দলীয় সংকীর্ণতা ও শ্রেণীগত সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করেন। সুখ-স্বস্তি, আরাম-আয়েশ, ভোগ-বিলাস বিসর্জন দেন। অনাহারে-অর্ধাহারে, অসুস্থতায়, আর্থিক অনটনে দিন কাটান। বিশ^বিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার হন। মা-বাবা, ভাই-বোন, আত্মীয়-স্বজন, স্ত্রী-পুত্র-কন্যা থেকে বিচ্ছিন্ন এক যুগেরও বেশি সময় দুঃসহ ও নিঃসঙ্গ কারাজীবনে জুলুম-নির্যাতন ভোগ করেন। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার প্রধান আসামি হন। জীবনের ঝুঁকি নেন। দল পুনর্গঠনের লক্ষ্যে স্বেচ্ছায় মন্ত্রিত্ব ত্যাগ করেন। তিনি তাঁর সত্তার সবটুকু বিসর্জন দেন। তাঁর আদর্শ, ত্যাগ-তিতিক্ষা, নিষ্ঠা, সংগ্রাম, অধ্যাবসায় বাঙালীর হৃদয়কে স্পর্শ করে। হয়ে ওঠেন বাঙালীর পরম আত্মীয়, আশা-আকাক্সক্ষার মূর্ত প্রতীক, বিস্ময়কর ভালবাসার সর্বোচ্চ জনপ্রিয় মানুষ। কর্মী থেকে মুজিব ভাই, মুজিব ভাই থেকে নেতা, নেতা থেকে অবিসংবাদিত নেতা, বঙ্গবন্ধু, জাতির পিতা ও হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালী। ইতিহাসের সৃষ্টি ও স্রষ্টা। বাঙালীর স্বার্র্থ সংরক্ষণ ও আত্মপরিচয় সৃষ্টির পেছনে ফজলুল হক, সোহরাওয়ার্দী, ভাসানীসহ অনেকের অবদান ছিল। এঁদের রাজনৈতিক কর্মকান্ড ও দর্শন বঙ্গবন্ধুকে ভীষণভাবে প্রভাবিতও করে। কিন্তু বাঙালীর সহস্র বছরের সুপ্ত আকাক্সক্ষা জাগরিত করেন বঙ্গবন্ধু। জাতীয়তাবোধকে শাণিত, সমৃদ্ধ ও সম্প্রসারিত করে জাতীয়তাবাদী চেতনায় মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেন, জাতীয়তাবাদী আন্দোলন গড়ে তোলেন। জাগিয়ে তোলেন ভাষা, জীবন-জীবিকা, শিক্ষা ও অর্থনৈতিক অধিকারবোধ। জাতীয়তাবাদী ও গণতান্ত্রিক এবং আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক আন্দোলনকে একীভূত করে বাংলাদেশের মানুষের চেতনা জাগ্রত করেন। অন্যায়, অবিচার, শোষণ, নির্যাতন ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে বাঙালীকে লড়তে শেখান। মুক্তি ও স্বাধীনতার আকাক্সক্ষাকে প্রবল আন্দোলনে রূপান্তর করে মুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করেন। এসব করেন তিনি গণতান্ত্রিক যুবলীগ, ছাত্রলীগ গঠন করে, আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সম্পাদক, সাধারণ সম্পাদক ও সভাপতি নির্বাচিত হয়ে, ভাষা আন্দোলন, বাঙালী পুলিশ হত্যার বিরুদ্ধে আন্দোলন, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের নিম্নবেতনভোগী কর্মচারীদের ধর্মঘট, যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন, শিক্ষা আন্দোলন, স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন, ৬ দফা আন্দোলন, ১১ দফা আন্দোলন, ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ৭০-এর নির্বাচন এবং সীমিত অসহযোগিতা থেকে বৃহত্তর অসহযোগিতার মাধ্যমে। যুদ্ধকালীন সময়ে পাকিস্তানের কারাগারে আটক থাকা সত্ত্বেও দেশে-বিদেশে এবং বাঙালীর চেতনায়, বিশ^াসে তিনিই ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের নায়ক। বঙ্গবন্ধু বহুবার বলেছেন- ‘জল্লাদের কারাগার থেকে আমাকে মুক্ত করার জন্য, দেশের স্বাধীনতার জন্য আমার ডাকে সাড়া দিয়ে কত ভাই-বোন রক্ত দিয়েছে। বুকের রক্ত দিয়েই আমি একদিন তাদের রক্তের ঋণ শোধ করে যাব।’ তিনি আরও বলতেনÑ ‘আমার মাথা কিনতে পারে পৃথিবীতে এমন শক্তি কারুর নেই। চিরদুখিনী বাংলার দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফুটিয়ে তুলতে গিয়ে, শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সোনার বাংলা গড়তে গিয়ে আমাকেও হয়ত আলেন্দের ভাগ্য বরণ করতে হবে-মরতে হবে প্রতিক্রিয়াশীল আর ষড়যন্ত্রকারীদের হাতে। কিন্তু আমি নতি স্বীকার করব না। মৃত্যু ভয়ে কম্পিত নয় আমার বুক।’ বঙ্গবন্ধুর আশঙ্কা সত্যি হয়। আলেন্দের ভাগ্যই বরণ করেন তিনি। তিনি রক্ত দেন। তাঁর প্রাণ নেয় আন্তর্জাতিক ও স্বাধীনতাবিরোধী প্রতিক্রিয়াশীল চক্র এবং দলীয় ও দেশীয় ষড়যন্ত্রকারীরা। কিন্তু বঙ্গবন্ধু নতি স্বীকার করেননি এবং কেউ তাঁর মাথাও কিনতে পারেনি। ২৫ মার্চ বঙ্গবন্ধু বলেন- ‘আমি আত্মগোপন করলে ওরা সমস্ত মানুষকে হত্যা করবে। আমি স্থির করলাম আমি মরব, দেশবাসী রক্ষা পাবে। আমি নেতা, দেশবাসীকে পরিত্যাগ করে আমি কেন যাব। যে মানুষ মরতে রাজি, কেউ তাকে মারতে পারে না।’ খুনীরা শুধু বঙ্গবন্ধুর দৈহিক সত্তা কেড়ে নিয়েছে, মারতে পারিনি। তিনি বাংলাদেশের মানুষের অবিচ্ছিন্ন ধমনী-স্পন্দন। আমাদের হৃদয়ে, সত্তায়, চেতনায় চিরভাস্বর। তিনি অম্লান ও সূর্যের মতো দেদীপ্যমান। বঙ্গবন্ধু এক আদর্শের নাম। আদর্শের মৃত্যু নেই। তিনি মৃত্যুঞ্জয়ী। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ, দর্শন, চলার পথ ও স্বপ্নই হবে বাংলাদেশের চালিকাশক্তি। আমরা তাঁর জীবনাদর্শ থেকে খুঁজে পাব আত্মশক্তি। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ও দর্শন ধারণ করেই বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা সফলতার সঙ্গে দেশকে এগিয়ে নিচ্ছেন এবং গড়ে তুলছেন। এই আদর্শের বিকল্প নেই। নয়ন সম্মুখে তুমি নাই, নয়নের মাঝখানে নিয়েছ যে ঠাঁই। লেখক : প্রো-ভিসি (প্রশাসন), জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
×