ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

বইমেলায় আনন্দ

প্রকাশিত: ০৭:৩৭, ৮ ফেব্রুয়ারি ২০২০

বইমেলায় আনন্দ

রিহান লাফাচ্ছে। লাফাচ্ছে মানে সত্যিই লাফাচ্ছে। বিছানার ওপর উঠে আনন্দে লাফাচ্ছে সে। কয়েকবার মামনি তাকে বলেছে বিছানা থেকে নামতে। এভাবে লাফাতে থাকলে কখন যেন খাটটাই ভেঙে পড়ে যায়! এতবার বলার পরেও যেহেতু রিহান শুনছে না, মামনি এবার চোখ পাকিয়ে বলল, তুমি এভাবে লাফালাফি করতে থাকলে কিন্তু বুক ফেয়ারে নিয়ে যাব না তোমাকে! কথাটা যেন জাদুর মতো কাজ করল। রিহান এক মুহূর্তে লাফানো বন্ধ করে ধপাস করে বিছানায় বসে পড়ল। তারপর করুণ করে বলল, আমি থেমে গেছি মামনি। প্লিজ আমাকে বুক ফেয়ারে নিয়ে যেও! মামনি হেসে ফেলল। রিহানের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, ঠিক আছে। আগে এসো লাঞ্চ করে নেবে। তারপর একটু রেস্ট করে বিকেলে আমরা বুক ফেয়ারে যাব। রিহান লাফাতে লাফাতে মামনির সঙ্গে ডাইনিং টেবিলে চলে এলো। দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পর এক সেকেন্ডও বিশ্রাম নিল না রিহান। কোন রকম নাকেমুখে খেয়েই ছুটে চলে গেল তার ঘরে। ড্রয়ার থেকে সবচেয়ে প্রিয় জামাটা বের করে পরে ফেলল। প্রিয় স্যান্ডেলটা বের করে পায়ে দিল। তারপর ছুটে মামনির কাছে চলে এলো। মামনি তাকে দেখে অবাক হয়ে বলল, কী ব্যাপার রিহান? তুমি এত আগে রেডি হয়েছ কেন? রিহান খুব উত্তেজনা নিয়ে বলল, বুক ফেয়ারে যাব না মামনি? তাই রেডি হয়েছি। মামনি হেসে বলল, সেটা তো বিকেলে যাব, বাবা। এখন একটু রেস্ট নাও তুমি, যাও। এই কড়া রোদে বাইরে যাওয়া যাবে না। কে শোনে কার কথা! রিহান একটুও বিশ্রাম নিল না। পুরোপুরি তৈরি হয়ে বসার ঘরের সোফায় বসে পা দোলাতে লাগল। শেষমেশ মামনি আর কী করে! সেও শাড়ি পাল্টে তৈরি হয়ে নিল। বাবাকে ফোন করে বলে দিল যেন সে অফিস থেকে তাড়াতাড়ি বইমেলায় চলে আসে। তারপর রিহানকে নিয়ে মামনি বেরুল বইমেলার উদ্দেশে। রিকশায় যেতে যেতে রিহান প্রশ্নে প্রশ্নে জর্জরিত করে ফেলল মামনিকে। বুক ফেয়ারে কেমন বুকস পাওয়া যায়? সেখানে কি রাইমসের বুকস আছে? বুক ফেয়ার কি অনেক বড়? শত প্রশ্ন তার। এত প্রশ্নের উত্তর দিতে মামনি রীতিমতো হিমশিম খেয়ে যাচ্ছিল। অবশেষে মামনি বলল, রিহান, আমরা চলে এসেছি। এখন তুমি নিজেই দেখতে পাবে বুক ফেয়ার কেমন, এখানে কী হয়। মামনির হাত ধরে তিড়িংবিড়িং করতে করতে দোয়েল চত্বরের রাস্তাটা ধরে হেঁটে গেল রিহান। বইমেলার গেট দিয়ে ঢুকেই সে অবাক হয়ে গেল। এত বইয়ের দোকান কখনও একসঙ্গে দেখেনি সে। কোনটা ফেলে কোথায় যাবে তাও সে ঠিক করতে পারল না। তখন মামনি বলল, এখানে চিলড্রেনস কর্নার আছে। সেখানে গেলে তুমি তোমার পছন্দমতো সব বুকস পাবে। চল আমরা সেখানেই আগে যাই। শিশু কর্নারের ঝলমলে রঙিন স্টলগুলো দেখে বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে রইল রিহান। সে একটা স্টলে দাঁড়িয়ে বই নাড়াচাড়া করতে শুরু করল। উফ! সবগুলো বই-ই কী সুন্দর! কী চমৎকার করে চার রঙে ছাপা বই! কী সুন্দর ছবি আঁকা বইগুলোতে! রিহানের ইচ্ছে হলো সে পুরো স্টলটাই কিনে বাসায় নিয়ে যায়। সে বই পছন্দ করতে শুরু করল। সব বই-ই তার পছন্দ হচ্ছে। তবুও সে বেছে বেছে চার-পাঁচটা বই বের করল। মামনিকে বলার পর মামনি বলল, ঠিক আছে। দাঁড়াও, আমি একবার দেখি এগুলো। তারপর কিনে দিচ্ছি। মামনি বইগুলো হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে ভ্রু কুঁচকে বলল, তুমি সব বাংলা বই নিয়েছ কেন রিহান? রিহান বলল, এগুলো অনেক বিউটিফুল, মামনি। মামনি বলল, এগুলোর ইংরেজী বইও আছে রিহান। বাংলা নিতে হবে না। রিহান মন খারাপ করে বলল, কিন্তু বাংলা লেখা তো সুন্দর, মামনি। আমি তো কখনোই বাংলা বুকস পড়ি না। একবার কিনি না, প্লিজ? মামনি বিরক্তি নিয়ে বলল, রিহান, বাংলা বই পড়লে তুমি ইংরেজি শিখবে কীভাবে? বাংলা ভাষা তো এমনিই জানো তুমি। এটা তো নতুন করে শেখার কিছু নেই। ইংরেজী বই পড়লে ইংরেজী শিখতে পারবে। মামনি কথা বলতে বলতে কোত্থেকে যেন বাবা চলে এল। রিহানের কাঁধে হাত রেখে দাঁড়িয়ে বলল, রিহানকে কি তুমি বাংলা বই কিনে দিতে রাজি হচ্ছো না, রিহানের মামনি? মামনি কিছু বলার আগেই রিহান বলল, বাংলা বইগুলো কত সুন্দর, দেখো বাবা! বাংলা পড়তে আমার খুব ভাললাগে। কিন্তু মামনি আমাকে বাংলা বই পড়তেই দেয় না! বাবা রিহানকে আদর করে দিয়ে মামনিকে বলল, শোন রিহানের মামনি, অন্য ভাষা শেখার জন্য নিজের ভাষা ভুলে যেতে হয় না। তুমি বলছিলে না, রিহান বাংলা জানে, তাই শেখার দরকার নেই? দেখ, তোমার ছেলে কিন্তু বইমেলাকে বইমেলা বলছে না। বুক ফেয়ার বলছে! এত সুন্দর একটা কথা- বইমেলা। সেটা বাদ দিয়ে বুক ফেয়ার কেন বলছে? কারণ তুমি তাকে ইংরেজী ভাষায় পারদর্শী করতে চাও, তাই তাকে সবকিছু ইংরেজীতে শেখাচ্ছ। কিন্তু দেখো, এই যে এত বড় করে আমরা বইমেলা আয়োজন করি- এর উদ্দেশ্য কী? যে ভাষার জন্য একদিন এই দেশের মানুষ প্রাণ দিয়েছিল, সেই প্রাণের বাংলা ভাষাকে শ্রদ্ধা জানানো, সেই ভাষাকে বইয়ের মাধ্যমে সবার কাছে পৌঁছে দেয়া। রিহানের মামনি, ইংরেজী অবশ্যই শিখতে হবে। কিন্তু বাংলা ওর মাতৃভাষা। মাতৃভাষাকে ভুলে যদি অন্য কোন ভাষা শিখতে হয়, তবে সেই ভাষা শেখার কোন মূল্য নেই। আর রিহানের মাতৃভাষা পৃথিবীর সেই একমাত্র মাতৃভাষা, যা রক্ষা করার জন্য প্রাণ দিতে হয়েছে। মামনি বলল, দেখো, আমি কিন্তু একবারও বলিনি যে রিহানকে বাংলা শিখতে হবে না। আমি শুধু বলছি যে বাংলা তো ওর মাতৃভাষা, সেটা নতুন করে শেখার তো কিছু নেই। বাবা বলল, শেখার তো কোন শেষ নেই। আর বাংলা ভাষাকে জানার আছে অনেক। শুধু বাংলায় কথা বলতে পারাই বাংলা ভাষা জানা না। বাংলার ইতিহাস, ঐতিহ্য, সৌন্দর্য লুকিয়ে আছে এই ভাষার সাহিত্যে। এই একই বই যদি রিহান ইংরেজীতে পড়ে, তবে হয়ত গল্পটা সে জানবে, কিন্তু বাংলার মাধুর্য সে বুঝবে না কখনই। মামনি আর কিছু বলার আগেই বাবা তার হাত থেকে রিহানের পছন্দ করা সবগুলো বই নিয়ে স্টলের বিক্রয়কর্মীকে বলল, এগুলো প্যাকেট করে দিন আমাদেরকে। তারপর রিহানকে বলল, চলো রিহান। তুমি আর যতগুলো বই কিনতে চাও, সব কিনব আমরা। অলঙ্করণ : প্রসূন হালদার
×