ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বিদেশী কর্মীদের অনিয়ম

রেমিটেন্সের মাধ্যমে বছরে পাচার হচ্ছে ২৬ হাজার ৪শ’ কোটি টাকা

প্রকাশিত: ১১:০৩, ৬ ফেব্রুয়ারি ২০২০

রেমিটেন্সের মাধ্যমে বছরে পাচার হচ্ছে ২৬ হাজার ৪শ’ কোটি টাকা

স্টাফ রিপোর্টার ॥ বাংলাদেশে মোট ২১ ধরনের পেশায় কর্মরত কমপক্ষে আড়াই লাখ বিদেশী কর্মী অবৈধভাবে রেমিটেন্সের মাধ্যমে তাদের দেশে বছরে ২৬ হাজার ৪০০ কোটি টাকা পাচার করছেন। যার ফলে বছরে সরকারের রাজস্ব ক্ষতি হচ্ছে ১২ হাজার কোটি টাকা। একই সঙ্গে বিদেশে অর্থ পাচারের ফলে দেশে চলমান উন্নয়নের সুফল থেকে দেশবাসী বঞ্চিত হচ্ছেন বলে মন্তব্য করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। বুধবার ধানম-ির মাইডাস সেন্টারে বাংলাদেশে বিদেশী কর্মীদের কর্মসংস্থান: সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায় শীর্ষক সংস্থাটির গবেষণা প্রতিবেদনে এই তথ্য উঠে এসেছে। টিআইবির রিসার্চ এ্যান্ড পলিসি বিভাগের প্রোগ্রাম ম্যানেজার মঞ্জুর ই খুদা প্রতিবেদনটি তুলে ধরেন। এ সময় টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, নির্বাহী ব্যবস্থাপনা উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়ের এবং গবেষণা ও পলিসি বিভাগের পরিচালক মোঃ রফিকুল হাসান উপস্থিত ছিলেন। টিআইবি ২০১৮ সালের এপ্রিল থেকে ২০১৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত করা গুণগত গবেষণার মাধ্যমে শুধু তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করে সরকারী-বেসরকারী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা ও গণমাধ্যমকর্মীদের সাক্ষাতকার এবং আইনী নথি-নীতিমালা, সরকারী-বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের তথ্য, গবেষণা প্রতিবেদন ও গণমাধ্যমের তথ্যের ভিত্তিতে এ গবেষণা করেছে বলে জানায়। টিআইবি বলছে, বাংলাদেশে বৈধ ও অবৈধভাবে কর্মরত বিদেশী কর্মীর প্রকৃত সংখ্যা ও পাচার করা অর্থের পরিমাণ নিয়ে নির্ভরযোগ্য প্রাতিষ্ঠানিক কোন তথ্য না থাকলেও গবেষণার সার্বিক পর্যবেক্ষণে অর্থ পাচার ও রাজস্ব ক্ষতির যে পরিমাণ উঠে এসেছে তা উদ্বেগজনক। পর্যবেক্ষণে বলা হয়, বাংলাদেশে বিদেশী কর্মী নিয়োগে কোন সমন্বিত ও কার্যকর কৌশলগত নীতিমালা নেই। বিদেশী কর্মী নিয়ন্ত্রণে দায়িত্বপ্রাপ্ত সুনির্দিষ্ট কোন কর্তৃপক্ষ নেই। ফলে এসব বিদেশী কর্মী নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থায় সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন কর্তৃপক্ষের মধ্যে কার্যকর সমন্বয়হীনতা লক্ষণীয়। ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, বাংলাদেশ থেকে যে পরিমাণ রেমিটেন্স বিদেশে যাচ্ছে এবং অবৈধভাবে অর্থ পাচার হচ্ছে তা খুবই উদ্বেগজনক। দেশ এখন উন্নয়নের রোল মডেল। তবে বিদেশে অর্থ পাচারের ফলে এ উন্নয়নের সুফল দেশবাসী পাচ্ছেন না। তিনি বলেন, আমরা এর আগেও একটি গবেষণা করেছিলাম। সেখানে দেখা গেছে, যে ছয়টি দেশে বাংলাদেশী কর্মীদের কোন টাকা লাগে না সেখানেও ভিসা করাতে বছরে ২ দশমিক ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার লেনদেন হয়। বাংলাদেশে যারা বৈধ ও অবৈধভাবে কাজ করছেন তারাও বছরে ৩ দশমিক ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার পাচার করছেন। বিদেশী নিয়োগে দেশে কোন নিয়মকানুন মানা হয় না। বিদেশী নিয়োগের পূর্বশর্ত হলো ওই কাজের জন্য দেশে যোগ্য কেউ আছে কিনা খোঁজ করা। তবে আমাদের নিয়োগ কর্তারা আগে থেকেই বিদেশী নিয়োগের জন্য মনস্থির করেন। টিআইবির নির্বাহী পরিচালক বলেন, বৈধভাবে বিদেশী নিয়োগে সাতটি ধাপ অনুসরণ করতে হয়। এর মধ্যে স্থানীয় নিয়োগ প্রক্রিয়া শেষে বোর্ডের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পুনঃবিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে বিদেশী কর্মী নিয়োগ করতে হয়। বিডা (বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ), বেপজা (রফতানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল কর্তৃপক্ষ), এনজিও ব্যুরো থেকে ভিসার সুপারিশপত্র নিতে হয়। বাংলাদেশ মিশনে ভিসার আবেদন করতে হয়। নিরাপত্তা ছাড়পত্রের জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়,এনএসআই ও এসবিতে আবেদন করতে হয়। বিডা, বেপজা, এনিজিও ব্যুরোতে কাজের অনুমতির জন্য আবেদন করতে হয়। ট্যাক্স আইডেন্টিফিকেশন সংগ্রহ ও ব্যাংক এ্যাকাউন্ট খুলতে হয় এবং ভিসার মেয়াদ বৃদ্ধির জন্য ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদফতরে আবেদন করতে হয়। অবৈধভাবে বিদেশী কর্মী নিয়োগে এত প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হয় না। এক্সপার্টের সঙ্গে বিদেশে থেকেই যোগাযোগ করে নিয়োগ দেয়া হয়। নিয়োগপ্রাপ্ত ভ্রমণ ভিসায় বাংলাদেশে আসেন এবং কাজ করেন। সাধারণত বাংলাদেশে তিন মাসের ভ্রমণ ভিসা দেয়া হয়। ভিসার মেয়াদ শেষ হলে ওই কর্মী আবার স্বদেশে ফিরে যান এবং ভ্রমণ ভিসার জন্য আবেদন করেন। ইফতেখার বলেন, বাংলাদেশে মোট ২১ ধরনের বিদেশী কর্মী রয়েছেন। এদের মধ্যে তৈরি পোশাক শিল্প, টেক্সটাইল, বায়িং হাউস, বিদ্যুত উৎপাদন কেন্দ্র, তেল-গ্যাস কোম্পানিতে লোকজন বেশি কাজ করছে। গবেষণা প্রতিবেদনের উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি বলেন, বৈধ ও অবৈধভাবে বাংলাদেশে প্রায় আড়াই লাখ বিদেশী কর্মী কাজ করেন। যার মধ্যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুযায়ী বৈধ কর্মী রয়েছেন ৯০ হাজার। এদের ন্যূনতম গড় মাসিক বেতন দেড় হাজার মার্কিন ডলার। সে হিসেবে বিদেশী কর্মীদের বার্ষিক আয় ৪ দশমিক ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ৩০ শতাংশ স্থানীয় ব্যয় বাদে প্রায় ৩ দশমিক ১৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিদেশে চলে যায়। এর মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে বৈধভাবে বিদেশে যায় মাত্র ৪৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। বাকি অর্থ অবৈধভাবে বিদেশে পাচার হয়ে যায়। টাকার অঙ্কে যা প্রায় ২৬ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। যার মাধ্যমে সরকারের বার্ষিক রাজস্ব ক্ষতি ১২ হাজার কোটি টাকা। তিনি বলেন, বাংলাদেশে কর্মরত বিদেশীদের মধ্যে ভারতীয়র সংখ্যা বেশি। প্রায় ৩০ থেকে ৩৫ হাজার ভারতীয় বাংলাদেশে কাজ করছেন। এমনকি সরকারী প্রকল্পে যেসব বিদেশী কাজ করছেন তারাও ভ্রমণ ভিসায় বাংলাদেশে এসে কাজ করছেন।
×