ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

কবিতা দুঃখের তপস্যা, নিজেকে ক্ষয় করে করে লিখতে হয়

প্রকাশিত: ০৯:৪৬, ৩ ফেব্রুয়ারি ২০২০

কবিতা দুঃখের তপস্যা,  নিজেকে ক্ষয় করে  করে লিখতে হয়

মোরসালিন মিজান ॥ কবিতার জন্য আলাদা করে একটি উৎসব। দুদিনের উৎসবে, না, শুধু বাংলাদেশের কবি বা কবিতা নয়। বিভিন্ন দেশ থেকে আমন্ত্রিতরা যোগ দিয়েছেন। কবিতার আকালের দিনে অদ্ভুত আবেগ আর ভালবাসা নিয়ে কবিতা পড়ছেন রচয়িতারা। কবির ভেতরে কী চলছে, বলে দিচ্ছে কবিতাই। এভাবে প্রথম দিনেই বেশ জমে উঠেছে উৎসব। প্রতিবারের মতোই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হেকিম চত্বরে এ উৎসবের আয়োজন করেছে জাতীয় কবিতা পরিষদ। এবার অবশ্য একদিন পিছিয়ে ২ ফেব্রুয়ারি রবিবার উৎসবের আয়োজন করা হয়। করতে হয়। বিদ্রোহ বিপ্লবের ঐতিহ্য ধারণ করা কবিতা উৎসবের এবারের স্লোগান: মুজিব আমার স্বাধীনতার অমর কাব্যের কবি। এ স্লোগানে সকাল ১০টার কিছু পরে মেলার আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয়। কথা ছিল, উদ্বোধন করবেন সমকালীন বাংলাদেশের প্রধানতম কবি মহাদেব সাহা। কিন্তু বহুদিন ধরে অসুস্থ কবি এদিনও ভক্ত অনুরাগীদের আসতে পারেননি। তবে চমৎকার একটি লিখিত বক্তব্য আসে তার কাছ থেকে। লেখাটি পাঠ করেন খ্যাতিমান আবৃত্তি শিল্পী হাসান আরিফ। লিখিত বক্তব্যে মহাদেব সাহা বলেন, রাজনীতির সীমান্তরেখা থাকলেও সংস্কৃতির ঠিক কোন সীমান্তরেখা নেই। রবীন্দ্রনাথের গানের মতো কবিতাকে আমি মনে করি পৃথিবীর মাতৃভাষা। একইসঙ্গে আমি বাংলা কবিতার মহৎ ঐতিহ্যের কথাও স্মরণ করি। তিনি বলেন, বাংলাদেশের কবিতার মূল ধারা গণআন্দোলন, প্রতিবাদ ও মিছিলের উষ্ণ সাহচর্যে বেড়ে উঠেছে। বাংলাদেশের কবিতা তাই শিল্পে প্রতিবাদে মানবিকবোধে দীপ্র। মানব সভ্যতার বিকাশে ও বিনির্মাণে কবিতার অবদান অসামান্য। এর পর যেন নিজের একান্ত উপলব্ধির কথা বলেন কবি। তিনি বলেন, কবিতা এক প্রতারক শিল্প। নিজেকে ক্ষয় করে করে কবিতা লিখতে হয়। কবিতা যেমন অপার সুখ তেমনি অপার দুঃখ। রবীন্দ্রনাথ থেকে উদ্ধৃত করে তিনি বলেন, ‘অলৌকিক আনন্দের ভার/বিধাতা যাহারে দেয়, তার বক্ষে বেদনা অপার,/তার নিত্য জাগরণ; অগ্নিসম দেবতার দান/ঊর্ধ্বশিখা জ্বালি চিত্তে আহোরাত্র দগ্ধ করে প্রাণ...। এই সত্যও মনে রাখার আহ্বান জানান তিনি। মহাদেব সাহা বলেন, কবিতা হচ্ছে আজীবন দুঃখের তপস্যা। পৃথিবীর মহৎ কবিদের জীবন তার প্রমাণ। উৎসবের সাফল্য কামনা করে তিনি বলেন, এই আকাশ হয়ে উঠবে কবিতার আকাশ, মাটি ও নক্ষত্রপল্লী ছেয়ে যাবে কবিতায়, সেই দিনটি আমি চোখ বুঁজে দেখতে পাচ্ছি। উৎসবের ঘোষণাপত্র পাঠ করেন কমি মুহম্মদ নুরুল হুদা। ঘোষণায় বলা হয়, বাঙালীর বিবর্তনজাত বিজয়ের অনেক যুক্তির মধ্যে প্রধানতম যুক্তি এই যে, স্মরণপূর্ব কাল থেকে নানা উত্থান পতনের মধ্য দিয়ে বাঙালী টিকে আছে নিদেনপক্ষে তার ব্যক্তি পরিচয়ে। তার প্রথম অস্ত্র তার ভাষা যা তার মায়ের মুখ থেকে শেখা। দ্বিতীয় অস্ত্র তার সদাচার। আর তৃতীয়টি সংঘবদ্ধতা যা তার পরিবার বা গোত্র বা জাতি তাকে শিখিয়েছে। এই সমন্বিত অস্ত্রটি বাঙালী প্রয়োগ করেছে তার সত্যস্বরে উচ্চারিত প্রতিটি মুক্তশব্দ তথা কবিতা দিয়ে। এবারের উৎসব বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে উৎসর্গ করার কথা জানিয়ে ঘোষণায় বলা হয়, আমরা মনে করি স্বাধীন জাতির স্বাধীন পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শুধু শতবর্ষী নন, তিনি অবশ্যই অনন্তবর্ষী। মুজিববর্ষে বঙ্গবন্ধুর মানবিক ও নান্দনিক আদর্শ সকলকে অনুসরণের আহ্বান জানানো হয় ঘোষণায়। পরিষদের সাধারণ সম্পাদক তারিক সুজাতের বক্তৃতায় ছিল ক্রমে জৌলুস হারানো কবিতা উৎসবের কথা। বাস্তবতা মেনে নিয়েই যেন তিনি বলেন, হয়তো আমাদের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে চোখ ধাঁধানো তেমন জৌলুস নেই কিন্তু আমাদের হৃদয়ের উদ্বোধনে- চেতনার রঙে, কবিতার অক্ষরে বাঙালী সত্তার শিল্পীত সুষমার যে বর্ণাঢ্য বিস্তার- তার সঙ্গে সংযোগ এই পলি বিধৌত জনপদের প্রান্তিক মানুষের। সরকার ও প্রশাসনে থাকা ব্যক্তিদের অনেকেই সংস্কৃতির প্রতি অনাগ্রহ দেখান এমন অভিযোগ তুলে ধরে তিনি বলেন, যে সকল প্রতিষ্ঠান সরকারের হয়ে দেশের সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডকে গতিশীল করবে- সুবিবেচনা ও যোগ্যতর অভাবে অনেক সময় তারা সেই দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হচ্ছেন। মূল ধারার সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডকে উপেক্ষা করে তারা কৃত্রিম এ্যাকুরিয়াম সংস্কৃতিকে পৃষ্ঠপোষকতা করছেন। সংস্কৃতি বিষয়ক ক্যাডার সার্ভিসেরও দাবি জানান তিনি। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন পরিষদের সভাপতি মুহাম্মদ সামাদ। আহ্বায়কের বক্তব্য তুলে ধরেন কবি শিহাব সরকার। বিদেশী কবিদের মধ্যে এদিন মাতিয়ে রাখেন বেঙত্ সোদারহল। সুইডেনের খ্যাতিমান এ কবি স্বরচিত কবিতা পাঠ করার পাশাপাশি চমৎকার গান করেন। তার গান উৎসবে নতুন মাত্রা যোগ করে। রবীন্দ্রনাথের একটি কবিতার ইংরেজী অনুবাদ করে শোনান তিনি। বলেন, এখানে এসে ভীষণ ভাল লাগছে। মঞ্চে উঠেও আমি নার্ভাস নই। বরং আনন্দিত। সম্মানিত বোধ করছি। উৎসবে প্রথমবারের মতো যোগ দিয়েছে উজবেকিস্তান। দেশটির কবি নাদিরা আবদুল্লায়েভা এদিন তার ভাষায় লেখা কবিতা পাঠ করে শোনান। নেপালের বিখ্যাত কবি ও লোক সংগ্রাহক ড. তুলসি দিওয়াসা বলেন, আমি আগেও চার পাঁচবার বাংলাদেশে এসেছি। বাংলাদেশের কবিতা বাংলাদেশের সংস্কৃতিকে আমি ভালবাসি। তাই শর্ট নোটিসে চলে এসেছি। বাংলাদেশী কবিদের উদ্দেশ্য দিনি বলেন, আপনারাও যদি কবিতার সম্পর্কে নেপালে আসেন, খুশি হব। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের আবৃত্তি শিল্পী সৌমিত্র মিত্র অনুষ্ঠানে নির্মলেন্দু গুণের বিখ্যাত কবিতা ‘স্বাধীনতা, এই শব্দটি কীভাবে আমাদের হলো’ আবৃত্তি করে শোনান। কবিতার ভাষায় রাজনীতির কবি শেখ মুজিবের প্রতি প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন তিনি। জানা যায়, ভারতের পশ্চিমবঙ্গ থেকে আরও এসেছেন বীথি চট্টোপাধ্যায়, সেবন্তী ঘোষ, নীলাঞ্জনা বন্দ্যোপাধ্যায়, অমিত গোস্বামী, দীধিতি চক্রবর্তী। আসাম থেকে এসেছেন অনুভব তুলাসি। ত্রিপুরা থেকে এসেছেন রাতুল দেব বর্মণ, অর্পিতা আচার্য্য, তমাল শেখর দে। মেঘালয় থেকে এসেছেন ফাল্গুনি চক্রবর্তী। দ্বিতীয় ও শেষদিনে আজ সোমবারও চলবে স্বরচিত কবিতা পাঠ। আবৃত্তি। গান সেমিনারসহ নানা আয়োজন।
×