ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

বিকাশ দত্ত

উচ্চ আদালতে বাংলা প্রচলন মাতৃভাষায় পিলখানা হত্যা মামলার রায়

প্রকাশিত: ০৭:৪৬, ৩ ফেব্রুয়ারি ২০২০

 উচ্চ আদালতে বাংলা প্রচলন মাতৃভাষায় পিলখানা হত্যা মামলার রায়

বহুল আলোচিত পিলখানা হত্যা মামলায় সম্প্রতি ৮ জানুয়ারি হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ হয়েছে। রায়টি প্রকাশের সময়কাল ঐতিহাসিক দিক বিবেচনায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, ২০২০ সাল হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী (মুজিববর্ষ) এবং ৮ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে ১০ জানুয়ারি স্বাধীন বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করেন। ২৪ জানুয়ারি (১৯৬৯) ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থান দিবসে বঙ্গবন্ধু আয়ুব খানের কারাগার থেকে মুক্তি পায়। ২১ ফেব্রুয়ারি (১৯৫২) মাতৃভাষা বাংলার জন্য এদেশের ছাত্র-জনতা রাজপথের আন্দোলনে জীবন উৎসর্গ করে, যা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে বিশ্ব দরবারে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। ৭ মার্চ (১৯৭১) রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দিক নির্দেশনামূলক ঐতিহাসিক ভাষণে সমগ্র বাঙালী জাতি মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। ২৬ মার্চ (১৯৭১) ধানমন্ডির ৩২নং রোডের বাড়ি থেকে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। এ সকল ঐতিহাসিক বিষয় বিবেচনায় বাংলা ভাষায় লেখা পৃথিবীর সর্ববৃহৎ রায় প্রকাশের ক্ষণটি ঐতিহাসিকভাবে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। বাংলা ভাষায় এতবড় যুগান্তকারী রায় প্রকাশের পর দেশের সকল জাতীয় দৈনিক পত্রিকা, অনলাইন পত্রিকা, ইলেকট্রনিক মিডিয়াসহ টকশোতে গুরুত্বের সঙ্গে রায়ের সুদীর্ঘ পর্যবেক্ষণ ও নির্দেশনা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হয়েছে, যা এখন পর্যন্ত অব্যাহত আছে। বিশেষ করে বিচারপতি মোঃ আবু জাফর সিদ্দিকীর বাংলায় লেখা রায়ের পর্যবেক্ষণের খন্ডিত অংশ বহুল প্রচারিত ও জাতীয় দৈনিক জনকণ্ঠ, প্রথম আলো, bdnews24.com, jagonews.com সহ অন্য সকল অনলাইন পত্রিকায় ৮ জানুয়ারি থেকে অদ্যাবধি ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হওয়ায় দেশ-বিদেশে আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে। এবং বাংলাদেশ সুপ্রীমকোর্টের ওয়েবসাইটে গবেষণামূলক পূর্ণাঙ্গ রায়টি প্রকাশ হওয়ায় কাক্সিক্ষত রায়ের প্রাসঙ্গিক অংশ পাঠ করার সুযোগ হয়েছে। পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য মতে, মাতৃভাষায় লেখা ১৬,৫৫২ পাতার রায়ে ২৭ লাখ ৯০ হাজার ৪৬৮টি শব্দ ব্যবহার হয়েছে। তথ্যটি জেনে আমি রীতিমতো বিস্মিত হয়েছি। কারণ কেবলমাত্র মাতৃভাষায় নয়, ইংরেজী বা অন্য কোন ভাষায় পৃথিবীতে এতবড় রায় আজ অবধি লেখা হয়নি। অনুসন্ধানে জানা যায়, গিনেস বুক অব রেকর্ডে অন্তর্ভুক্ত সর্ববৃহৎ রায় থেকে পিলখানা হত্যা মামলার রায়টি বহুগুণে বড়। ধারণা করা যায়, অচিরেই পিলখানা হত্যা মামলার রায়টি গিনেস বুক অব রেকর্ডে অন্তর্ভুক্ত হয়ে নতুন রেকর্ড সৃষ্টি করবে। বিচারপতি মোঃ শওকত হোসেন, বিচারপতি মোঃ আবু জাফর সিদ্দিকী ও বিচারপতি মোঃ নজরুল ইসলাম তালুকদারের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের বিশেষ বেঞ্চের বিচারপতিগণ ইংরেজী ও বাংলা ভাষায় ভিন্ন পর্যবেক্ষণে রায় লিখেছেন। বিচারপতি মোঃ নজরুল ইসলাম তালুকদার বিচারপতি মোঃ আবু জাফর সিদ্দিকীর বাংলায় লেখা রায়কে পূর্ণ সমর্থন করে শুরুতেই লিখেছেন : ‘I have gone through the judgments proposed to be delivered by Mr. Justice Md. Shawkat Hossain and Mr. Justice Md. Abu Zafor Siddique. It appears that the judgment written by Mr. Justice Md. Shawkat Hossain is in English while the judgment laid down by Mr. Justice Md. Abu Zafor Siddique is in Bengali. It may be mentioned that I along with the learned judges of the Special Bench have come to a unanimous decision in respect of the convictions and sentences of the accused of this case. However, I fully concur with the views, observations and opinions expressed in the judgment delivered by Mr. Justice Md. Abu Zafor Siddique for the reasons that his lordship has delivered the judgment considering and scrutini“ing the facts and circumstances of the case, the legal evidence and other circumstances giving proper explanations and reasons. Apart from this, his lordship has elaborated his findings and observations in details giving reference to different legal decisions. The judgment delivered by Mr. Justice Md. Abu Zafor Siddique appears to be more speaking, elaborate and well-reasoned. Since the judgment delivered Mr. Justice Md. Abu Zafor Siddique has been prepared perusing the facts and circumstances of the case considering the direct evidence and clinching circumstances.’ বিচারপতি মোঃ আবু জাফর সিদ্দিকীর রায়ে প্রদত্ত পর্যবেক্ষণ, মামলার প্রেক্ষাপট, ঘটনার নৃশংসতা ও পারিপার্শ্বিকতা, পক্ষগণের যুক্তিতর্কে উত্থাপিত আইনের ব্যাখ্যা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে আলোচনা করা হয়েছে। রায়ে উচ্চ আদালতের প্রাসঙ্গিক নজির, ব্যবহারিক ও প্রায়োগিক আইনের ব্যবহার, যৌক্তিক বিশ্লেষণ, সাক্ষ্য পর্যালোচনা, মামলা সংশ্লিষ্ট বিষয়সমূহে পক্ষগণের উত্থাপিত সকল প্রশ্নের আইনানুগ মীমাংসা এবং নিজস্ব মতামতসহ আইনানুগ পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে Speaking ও গবেষণামূলক রায়টি প্রকাশ করায় উহা Public Document হিসেবে রায়ে উদ্ধৃত তথ্য-উপাত্ত নিয়ে সঙ্গত কারণেই আলোচনার দাবি রাখে। বিচারপতি সিদ্দিকীর লেখা পৃথিবীর সর্ববৃহৎ এই রায়টি চলিত ভাষায় লেখা হয়েছে। তিনি রায়ে সর্বাধিক প্রচলিত সহজ শব্দ চয়নের মাধ্যমে অসাধারণ বাক্য গঠন করেছেন। ১৬,৫৫২ পাতার বাংলায় লেখা রায়টির প্রথম বাক্য থেকে শেষ অবধি কোন দুর্বোধ্য শব্দ বা বাক্য ব্যবহার করা হয়নি। অতি সাধারণ মানুষ বা স্বল্প শিক্ষিত ব্যক্তি সহজেই রায়ের ভাবার্থ উপলব্ধি করতে পারবে। দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ সচরাচর যে ভাষায় কথা বলে অনুরূপ বাক্যবিন্যাসে রায়টি লেখা হয়েছে। অনেক খ্যাতিমান লেখক, কবি, সাহিত্যিকের লেখায় বা প্রবন্ধে অধিকাংশ ক্ষেত্রে দুর্বোধ্য ভাষার প্রয়োগ দেখা যায়, এমনকি লেখার অর্থ বুঝতে লেখক পাদটীকা দিয়ে থাকেন। পূর্ণাঙ্গ অর্থ বুঝতে পাঠকের বাংলা অভিধান পর্যন্ত ঘাটতে হয়। বাংলায় লেখা এই রায়ের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো রায়টিতে কোন দুর্বোধ্য শব্দের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। অবশ্য থাকবেইবা কেন? কারণ, বিচারক রায়ের শুরুতেই বলেছেন, ক্ষতিগ্রস্ত ও সাজাপ্রাপ্তসহ সংশ্লিষ্ট সকলের সহজে অনুধাবনের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে তিনি মাতৃভাষায় রায়টি লিখেছেন। রায়টি পড়ে আমার ধারণা এই যে, স্বদিচ্ছা থাকলে উচ্চ আদালতে বাংলা ভাষায় রায় লেখা যায়। অনেক বিজ্ঞজন বলে থাকেন, বাংলা ভাষায় রায় লিখতে পরিভাষা খুঁজে পাওয়া যায় না। সে কারণে উচ্চ আদালতের মাননীয় বিচারকবৃন্দ ইংরেজী ভাষায় রায় লিখতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। ১৯৫২ সালের মাতৃভাষার জন্যে সালাম, বরকত, জব্বারসহ আমাদের সূর্যসন্তানরা মায়ের ভাষা রক্ষার জন্য বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছেন, তাইতো আজ ২১ ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবস থেকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে বিশ্ব দরবারে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। বাংলা ভাষা পৃথিবীর বুকে স্থান করে নেয়ায় সমগ্র বাঙালী জাতি আজ গর্বিত। আর ভাষা আন্দোলনের পথ ধরেই তো আমাদের মুক্তিযুদ্ধ, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বপ্ন দেখতেন বাংলা ভাষাকে পৃথিবীর বুকে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠা করার, তাই বাংলা ভাষার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে মাতৃভাষায় ভাষণ দিয়েছিলেন। তিনি যথার্থই বলেছিলেন, উচ্চ আদালত থেকে শুরু করে রাষ্ট্রের সকল স্তরে মাতৃভাষা ব্যবহার করতে হবে। সে বিবেচনায় বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালে বাংলায় পবিত্র সংবিধান আমাদের উপহার দিয়েছেন। উচ্চ আদালতে পরিভাষার অভাবে রায় লিখতে কষ্ট হলেও দেশের ৯০ ভাগ মানুষের স্বার্থে বাংলা ভাষায় রায় লিখতে হবে। কারণ, যাদের জন্য আদালত রায় লেখেন তাদের মধ্যে ৯০ ভাগ মানুষ ইংরেজী ভাষা বোঝেন না। এখন দেখা যায় আমাদের সুপ্রীমকোর্টের নগণ্য সংখ্যক মাননীয় বিচারপতি কদাচিৎ ২/১টি রায় বাংলা ভাষায় লিখে আসছেন, যা দেশের মানুষের চাহিদা ও মাতৃভাষার প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের জন্য যথেষ্ট কিনা সে প্রশ্ন থেকেই যায়। অবশ্য কিছুদিন থেকে দৃশ্যমান যে, সুপ্রীমকোর্টের ১/২ জন বিচারপতি বাংলা ভাষায় রায় প্রদান করছেন, তাঁরা অবশ্যই প্রশংসার দাবি রাখেন। বাংলা ভাষায় রায় লেখা প্রসঙ্গে আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতির পিতার অভিপ্রায় পূরণের লক্ষ্যে প্রতিনিয়তই বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বাংলা ভাষায় রায় দেয়ার জন্য উচ্চ আদালতের মাননীয় বিচারপতিদের প্রতি জোরালো আহ্বান করে আসছেন। তিনি এও বলেন যে, ইংরেজীতে লেখা রায় ভুক্তভোগীরা বুঝতে পারেন না। তারা রায়ের বক্তব্য বোঝার জন্য আইনজীবীদের শরণাপন্ন হলে কেবল অর্থ ব্যয়ই নয়, প্রতিনিয়তই তারা বিড়ম্বনার শিকার হচ্ছেন। হয়ত এ সকল নানা বিষয় বিবেচনায় নিয়ে পিলখানা হত্যা মামলায় বিচারপতি মোঃ আবু জাফর সিদ্দিকীর ১৬,৫৫২ পাতার রায়ে ২৭ লাখ ৯০ হাজার ৪৬৮টি বাংলা শব্দ ব্যবহার করে মাতৃভাষায় পূর্ণাঙ্গ রায় লিখে এক দুঃসাহসী ভূমিকা পালনের মাধ্যমে রীতিমতো দেশ-বিদেশে আলোড়ন সৃষ্টি করেছেন। মাননীয় বিচারপতি এটা প্রমাণ করেছেন যে, স্বদিচ্ছা থাকলে মাতৃভাষায় উচ্চ আদালতের রায় লিখতে কোন অসুবিধা হয় না। ইংরেজী পরিভাষা পাওয়া যায় না, এটা আংশিক সত্য হলেও সংশ্লিষ্টদের মনস্তাত্ত্বি¡ক বিষয়টিও অস্বীকার করা যায় কি? মাননীয় বিচারপতি মোঃ আবু জাফর সিদ্দিকীকে সাধুবাদ জানানোর ভাষা আমার জানা নেই। কারণ তিনি মাতৃভাষায় পৃথিবীর সর্ববৃহৎ রায় লিখে বাংলাভাষাকে বিশ্ব দরবারে অধিকতর উচ্চ আসনে অধিষ্ঠিত করতে একধাপ এগিয়ে দিয়েছেন। তাছাড়া জাতির পিতার স্বপ্ন পূরণে বাস্তব পদক্ষেপ হিসেবে বাংলা ভাষায় লেখা এই রায়টি ‘মুজিববর্ষের’ অন্যতম সেরা উপহার হিসেবে বিবেচনার দাবি কি অস্বীকার করা যায়? সম্মানিত বিচারকবৃন্দের কাছে জাতির প্রত্যাশা, মুজিববর্ষ থেকে উচ্চ আদালতের রায়ে বাংলা ভাষা প্রচলনে প্রত্যক্ষ ভূমিকা পালনের মধ্য দিয়ে জাতির পিতার স্বপ্ন পূরণে নিশ্চয় তাঁরা সচেষ্ট হবেন। বাংলাদেশের মাননীয় প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ২০১৯ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি জাতীয় শহীদ মিনারের পাদদেশে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ায় দেয়া এক সাক্ষাতকারে বাংলা ভাষায় এই বৃহত্তর রায় লেখার ইঙ্গিত করেছিলেন। পৃথিবীর সর্ববৃহৎ এই রায়টি প্রকাশের মাধ্যমে জাতির কাছে মাননীয় প্রধান বিচারপতির দেয়া প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়িত হয়েছে। পিলখানা হত্যা মামলায় বিচারপতি মোঃ আবু জাফর সিদ্দিকীর বাংলায় লেখা রায়কে একটি ঐতিহাসিক রায় হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। রায়টি নিজেই একটি ইতিহাস। কারণ, গবেষণামূলক রায়ের গর্ভে যা আছে তা পর্যায়ক্রমে আলোচনা করা দেশবাসীর জন্য অত্যন্ত জরুরী। রায়ের শুরুতেই বলা হয়েছে, মামলাটি নিঃসন্দেহে নজিরবিহীন ও ঐতিহাসিক। কারণ, এরূপ ঘটনা পৃথিবীতে কদাচিৎ ঘটে থাকে। সে কারণে ১৫২ জনের মৃত্যুদ- অনুমোদন, ১৬০ জনের যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদ-সহ বিভিন্ন মেয়াদে দন্ড ও সাজাপ্রাপ্তসহ রাষ্ট্রপক্ষের দায়েরকৃত আপীল আইনানুগভাবে নিষ্পত্তির জন্যে প্রাসঙ্গিক বিষয়সমূহের ওপর ব্যাপক গবেষণা চালিয়ে তর্কিত রায়ে প্রদত্ত দ- ও সাজার আদেশ অনুমোদন বা খালাস প্রদানের যথার্থতা নির্ণয়ের চেষ্টা করা হয়েছে। বিচারপতি মোঃ আবু জাফর সিদ্দিকী বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসের বর্ণাঢ্য অবদানের কথা অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে রায়ে আলোচনা করেছেন। প্রাসঙ্গিকভাবে জাতির পিতার ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের কথা উঠে এসেছে। তিনি রায়ে লিখেছেন, ১৯৭১ সালের তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর মুক্তিযুদ্ধের দিক নির্দেশনামূলক ভাষণে এদেশের কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, জনতার সঙ্গে সশস্ত্র বাহিনীসহ ইপিআরের বাঙালী অফিসার ও সৈনিকরা মুক্তিযুদ্ধের জন্যে প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে জাতির পিতা কর্তৃক বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা তৎকালীন ইপিআরের জুনিয়র অফিসার ও জোয়ানরাই ওয়্যারলেসের মাধ্যমে দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে দিয়ে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছিল। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার বার্তা ওয়্যারলেসযোগে প্রচার করায় পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী কর্তৃক ইপিআরের সুবেদার মেজর শওকত আলীসহ ৪ বীর সৈনিক দেশমাতৃকার জন্যে আত্মদান করে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে তারা স্থান করে নিয়েছেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক বিচারপতি মোঃ আবু জাফর সিদ্দিকীর রায়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক হিসেবে দৃঢতার সঙ্গে উল্লেখ করেছেন। রায়ে বলা হয়েছে, ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল বৃহত্তর কুষ্টিয়া জেলার মুজিব নগরে বাংলার মুকুটহীন সম্রাট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলাম উপরাষ্ট্রপতি, তাজউদ্দীন আহমেদকে প্রধানমন্ত্রী এবং অন্যান্য জাতীয় নেতৃবৃন্দকে মন্ত্রিপরিষদের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দিয়ে বাংলাদেশের প্রথম সরকার শপথ গ্রহণের মধ্য দিয়ে আইনানুগ ও নিয়মতান্ত্রিকভাবে শুরু হয় বাংলাদেশের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ। নবগঠিত বাংলাদেশের প্রবাসী সরকার জেনারেল এমএজি ওসমানীকে রণাঙ্গনের প্রধান (সেনাপ্রধান) নিযুক্ত করে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ শৃঙ্খলার সঙ্গে পরিচালনার দায়িত্ব প্রদান করে। রায়ে প্রাসঙ্গিকভাবেই উল্লেখ করা হয়েছে, মুজিব নগর সরকারকে এসপি মাহবুবের নেতৃত্বে ইপিআরের ১২ বাঙালী সৈনিকসহ আনছার সদস্যরা প্রথম গার্ড অব অনার প্রদান করে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে তারা স্থান করে নিয়েছেন। রায়ের এই পর্যবেক্ষণটি নির্দ্বিধায় উল্লেখ করা যায় যে, বাংলাদেশের জন্মের ৪৯ বছর পর জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকীতে হাইকোর্টের ঘোষিত পিলখানা হত্যা মামলার রায়ে প্রাসঙ্গিকভাবেই ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক’ এই ঐতিহাসিক সত্যটি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বাঙালী জাতিকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এক মারাত্মক ভ্রম সংশোধনের মাধ্যমে ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করায় বিচারপতি সিদ্দিকীর লেখা রায়টি বাংলাদেশের ইতিহাসে ইতোমধ্যে স্থান করে নিয়েছে। তবে বিস্ময়ের বিষয় এই যে, মুক্তিযুদ্ধে চূড়ান্ত বিজয়ের পরে ৪৯ বছর পর্যন্ত সরকারী প্রকাশনায় জেনারেল এমএজি ওসমানীকেই মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক হিসেবে স্থান দিয়ে আসছে। কিন্তু কেন? এটা কি অনিচ্ছাকৃত ভুল, না সুপরিকল্পিতভাবে ইতিহাস বিকৃত করার অপচেষ্টা, তা খতিয়ে দেখার সময় এসেছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হলেও এর ভিত্তি রচিত হয়েছে ১৯৪৭ সালে তৎকালীন পাক-ভারত উপমহাদেশ বিভক্ত করে পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের সময়ে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্র গঠনের পর থেকেই। আর এই স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা ছিলেন আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়েছিল একটি নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি দ্বারা গঠিত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের নেতৃত্বে ও কর্তৃত্বে এবং ওই সরকারের রাষ্ট্রপতি ছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাছাড়া মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষিত সৃষ্টি হয়েছে সম্পূর্ণ রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে এবং গোড়া থেকেই এই সিদ্ধান্তের নেতৃত্বে ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। সে কারণ মুক্তিযুদ্ধের ৪৯ বছর পর হলেও সত্য প্রতিষ্ঠার প্রয়াসের জন্য বিচারপতি সিদ্দিকীর সাহসী লেখনীতে হাইকোর্টের এই ঐতিহাসিক রায়টি বাঙালী জাতি চিরদিন কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করবে। এই রায়ে বলা হয়েছে -বাংলাদেশ রাইফেলসের বর্ণাঢ্য ইতিহাস ভূলষ্ঠিত করে বাহিনীর কতিপয় উচ্চাভিলাষী সদস্যের ঔদ্ধত্যপূর্ণ মানসিকতা এবং স্বার্থান্বেষী মহলের প্ররোচনা ও উস্কানিতে বিডিআরের সদর দফতর পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহে ৫৭ নিরস্ত্র সামরিক অফিসারসহ ৭৪ জনকে নৃশংসভাবে হত্যা, অগ্নিসংযোগ, অস্ত্রাগার লুণ্ঠনসহ সেনা পরিবারের সদস্যদের প্রতি অমানবিক আচরণ ও পাশবিক নির্যাতন চালিয়ে জঘন্য অপরাধ করা হয়েছে। এরূপ ঘটনা সংঘটনের পর ডিএডি তৌহিদের নেতৃত্বে বিদ্রোহীরা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠককালে বাংলাদেশ রাইফেলসের সদস্যরা সত্য গোপন করে সাধারণ ক্ষমা প্রদানের জন্য প্রধানমন্ত্রীর ওপর চাপ সৃষ্টির মাধ্যমে ধৃষ্টতা প্রদর্শন করেছে। রায়ে বিদ্রোহ দমনে সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ সেনাবাহিনী, বিমান বাহিনী ও নৌবাহিনীর ভূমিকার প্রশংসা করা হয়েছে। রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা বিনষ্ট, অর্থনৈতিক ও সামাজিক নিরাপত্তার লক্ষ্যে একটি স্বার্থান্বেষী মহলের পরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে দক্ষ ও প্রশিক্ষিত বাহিনীকে ধ্বংসের চক্রান্ত রুখে দেয়ার লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রাষ্ট্রনায়কোচিতভাবে গৃহীত দৃঢ় পদক্ষেপ ছিল সময়োপযোগী। আইনের শাসনের প্রতি শ্রদ্ধা, দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষায় প্রশিক্ষিত দক্ষ ও সুশৃঙ্খল প্রতিষ্ঠান হিসেবে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, বিমান বাহিনী ও নৌবাহিনী দেশের সংবিধান ও গণতন্ত্রের প্রতি অগাধ বিশ্বাস ও অবিচল আস্থা রেখে চরম ধৈর্যের পরিচয় দিয়ে দেশবাসীর ভালবাসা ও সুনাম অর্জনের কথা রায়ের পর্যবেক্ষণে গুরুত্বের সঙ্গে উল্লেখ করা হয়েছে। চলবে... লেখক : জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক, জনকন্ঠ [email protected]
×